গলাব্যথা কেন হয়?

শুকনো খটখটে গলা, গলায় খুসখুসে ভাব, গলাব্যথা অনেকের কাছে শুনতে সাধারণ ধরনের ব্যাপার বলে মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। গলা নিয়ে এই যে বিভিন্ন অসুবিধা, এগুলো কিছু রোগের লক্ষণ।
কিন্তু রোগটা কী? টনসিলের প্রদাহ, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস (ছত্রাক) বা ভাইরাসের সংক্রমণ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যালার্জি না টিউমার? এই গলাব্যথা উপসর্গ নিয়ে যেসব রোগের কারণে রোগীরা সচরাচর চিকিৎসকের কাছে ধরনা দেন, সেসব রোগ সম্বন্ধে কিছুটা আলোচনা করা হলো।
প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রেই গলার অসুবিধাগুলো ছাড়াও অন্যান্য কিছু লক্ষণ উল্লেখ করা হলো, যেন রোগীরা কোন ধরনের রোগের জন্য কখন চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হবেন, তা বুঝতে পারেন।
১. মুখগহ্বর বা অন্ননালিতে ‘থ্রাশ’ বা ক্যানডিডোসিস বা মনিলিয়াসিস
এ রোগের জন্য দায়ী এক ধরনের ছত্রাক। এটি মুখগহ্বর, অন্ননালি ছাড়া দেহত্বককেও আক্রমণ করে। এই ফাঙ্গাস আক্রান্ত জায়গাগুলোতে সাদা সাদা পনিরের চাকাসদৃশ পর্দার মতো পাতলা আবরণ তৈরি হয়। এটি খুঁটিয়ে উঠিয়ে ফেললে রক্তক্ষরণ হতে থাকে।
উপসর্গের মধ্যে রয়েছে : গলাব্যথা, গলা শুকিয়ে যাওয়া, খাবারের স্বাদ না বোঝা, জিহ্বা, গাল, গলায় ছত্রাকের সাদা সাদা পর্দাসদৃশ আবরণ। রোগটির এই লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় এবং সাধারণত ১০-১২ দিন পর্যন্ত বেশ অসুবিধা করে।
চিকিৎসা না করালে যে অসুবিধা হতে পারে তা হলো : স্বরযন্ত্রের প্রদাহ, শ্বাস নিতে অসুবিধা, দম বন্ধ হওয়ার মতো কষ্ট।
যাদের কিডনির রোগ আছে, ডায়াবেটিস আছে, বিভিন্ন ওষুধে কাজ হয় না বা রেজিস্ট্যান্স আছে, তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে তাৎক্ষণিক বা সঙ্গে সঙ্গেই।
রোগ প্রতিরোধের উপায় হলো : রোগাক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা, একই চামচ দিয়ে খাবার না খাওয়া, যেসব মায়ের স্তনের ত্বকে এ রোগ আছে তারা সন্তানকে দুধ পান না করানো।
চিকিৎসাক্ষেত্রে ছত্রাকবিরোধী ওষুধ বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ব্যবহার করা হয়।
২. গ্লান্ডিউলার জ্বর বা ইনফেকশাস মনোনিউক্লিওসিস
‘এপস্টাইন-বার ভাইরাস’-এ রোগের সংক্রমণের জন্য দায়ী। কম বয়সী স্ত্রী-পুরুষের বেশি দেখা যায়। ধীরে ধীরে এ রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায় এবং প্রায় ছয় সপ্তাহ এ রোগের প্রকোপ থাকে।
উপসর্গের মধ্যে রয়েছে : গলাব্যথা, টনসিল এবং আশপাশে গ্রন্থিগুলোর স্ফীতি, মাথাব্যথা, প্রচণ্ড অবসাদগ্রস্ততা, মুখে দুর্গন্ধ, যকৃৎ এবং প্লীহার স্ফীতি।
চিকিৎসা না করালে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। তাৎক্ষণিক ভাইরাসের উপস্থিতির জন্য রক্ত পরীক্ষা করতে হবে।
এ রোগ খুব সংক্রামক। একে ‘কিসিং ডিজিজ’ বলা হয়, অর্থাৎ চুমুর মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। গ্লাস বা কাপ থেকে পানি, চা, কফি ইত্যাদি পান করলেও ছড়িয়ে যাবে। তাই একই থালায় কখনো খাবেন না। অর্থাৎ সোজা কথায় রোগীর লালা যেন সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ না করে।
চিকিৎসাক্ষেত্রে লক্ষণগত চিকিৎসা করতে হবে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর চিকিৎসা এখানো আবিষ্কৃত হয়নি।
৩. সাইনোসাইটিস
করোটির হাড়ের ভেতরে কিছু বায়ুকুঠুরি থাকে। এগুলোতে যখন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে, তখন এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। ১০-১২ দিনের মতো থাকে।
উপসর্গ হলো : গলার প্রদাহ এবং ব্যথা, হাঁচি, নাক দিয়ে অনবরত পানি পড়া, নাক বন্ধ থাকা, নাকের পাশে, ওপরে বা চোখের নিচের হাড়ের ওপরে ব্যথা ও মাথা ধরা।
চিকিৎসা না করালে যে অসুবিধা হতে পারে তা হলো : বায়ুকুঠুরিগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা। কথা বলার সময় নাকি সুর থাকে, বছরের প্রায় সারা সময়ই নাক দিয়ে পানি ঝরতে থাকে।
যদি রোগীর অবস্থা বেশ খারাপ থাকে অথবা যদি এক সপ্তাহের বেশি সময় রোগের বিভিন্ন লক্ষণ থাকে, তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ উপায় হলো : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, ঠান্ডা না লাগানো, প্রাথমিক অবস্থায় রোগটিকে হেলাফেলা না করা।
চিকিৎসাক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক, ন্যাসাল ডিকনজেসট্যান্ট ব্যবহার করা হয়।
৪. ল্যারিনজাইটিস
ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস যখন স্বরযন্ত্রকে আক্রান্ত করে, তখন এ রোগের সূচনা হয়। রোগটি হঠাৎ করে বা ধীরে ধীরে যেকোনোভাবে শুরু হতে পারে। ৭ থেকে ১০ দিন আপনাকে ভোগাবে।
উপসর্গের মধ্যে রয়েছে : স্বরবিকৃতি, কর্কশ স্বর, গলাব্যথা, গলা বসে যাওয়া, জ্বর ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরনের ভাব।
চিকিৎসা না করালে সাধারণত খুব একটা অসুবিধা দেখা যায় না। তবে অস্বাভাবিকভাবে কারো ক্ষেত্রে কাশির সঙ্গে রক্ত আসতে পারে, দম আটকে আসা ভাব তৈরি হতে পারে।
স্বরবিকৃতি বা কর্কশ স্বর যদি এক সপ্তাহের বেশি থাকে, তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন।
ঠান্ডা লাগাবেন না। ইনফেকশন হলে চটপট সারিয়ে ফেলবেন। সন্তানকে না ফুটানো পানি, দুধ খেতে দেবেন না তাহলেই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
চিকিৎসাক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। কথা বলতে নিষেধ করা হয়।
৫. এপিগ্লোটাইটিস (আলজিহ্বায় প্রদাহ)
মূলত হিমোফাইলাস ধরনের ব্যাকটেরিয়া এর জন্য দায়ী। তবে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াও ভূমিকা রাখতে পারে। হঠাৎ করেই শুরু হয়ে তিন-চার দিন থাকে। শিশুদের বেশি হয়, শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
উপসর্গগুলো হলো : উচ্চমাত্রায় স্বর খারাপ বা পানি গিলতে অসুবিধা, শ্বাস নিতে অসুবিধা।
চিকিৎসা না করালে শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে মৃত্যুও হতে পারে।
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে সঙ্গে সঙ্গেই। কারণ, মৃত্যুর আশঙ্কা খুব বেশি।
ঠান্ডা লাগাবেন না। সন্তানকে কখনোই অপরিষ্কার পাত্রে পানি বা দুধ খেতে দেবেন না। পানি বা দুধ ফুটিয়ে খাওয়াবেন।
চিকিৎসাক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। শ্বাস নিতে যেন সুবিধা হয়, সে জন্য মুখ দিয়ে শ্বাসনালিতে নল প্রবেশ করানো হয়, অক্সিজেন দিতে হতে পারে।
৬. ক্রু
কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস এ রোগের মূল কারণ। স্বরযন্ত্রে, শ্বাসনালিতে প্রদাহ ও ইনফেকশন হয়। হঠাৎ করেই শুরু হয়, তিন-পাঁচ দিন থাকে। নবজাতক সন্তান ও শিশুদের বেশি হয়।
উপসর্গগুলো হলো : কর্কশ ও উঁচু স্বরের কাশি, গলায় ব্যথা ও প্রদাহ, শ্বাস নিতে কষ্ট, ভাঙা গলার স্বর ও জ্বর।
চিকিৎসা না করালে শ্বাসনালি ও স্বরযন্ত্রের প্রবেশ পথ ফুলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা দেখা দেবে। শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। শিশুর মৃত্যুর আশঙ্কাও আছে।
শিশুর অন্য কোনো রোগ থাকলে তার থেকে সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখবেন। ঠান্ডা লাগাতে দেবেন না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
চিকিৎসাক্ষেত্রে শিশুকে শিশুর উপযুক্ত কামরায় রাখা হয়। গরম তরল খাওয়ানো হয়।
৭. টিউমার বা ক্যানসার
এ রোগের কারণ হলো : শ্বাসনালি, অন্ননালি, স্বরযন্ত্রের টিউমার, এসব অঞ্চলের অগ্রগামী ক্যানসার বা অন্য কোনো অঞ্চল থেকে এ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া ক্যানসার। ধীরে ধীরে অনেক সময় নিয়ে রোগটি দেখা দেয়। সাধারণত বয়সকালেই দেখা যায়। তবে কম বয়সে একদম হতেই পারে না, তা বলা ঠিক নয়।
উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে : অনেক দিন ধরে গলাব্যথা, শ্বাস নিতে ও খাবার গিলতে অসুবিধা হয়, স্বর ভেঙে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হতে পারে। কাশি বা বমি, সঙ্গে রক্ত উঠতে পারে, গলায় চাকা দেখা যায়। দ্রুত ওজন কমে যেতে পারে।
চিকিৎসা না করালে সম্পূর্ণ শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে যেতে পারে, মৃত্যুর বেশ আশঙ্কা আছে।
যদি গলাব্যথা বা কর্কশ স্বর এক সপ্তাহের বেশি থাকে, যদি কফের সঙ্গে বা লালার সঙ্গে রক্ত আসে, গলায় চাকা দেখা দেওয়ার পর ওজন কমে গেলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। অবশ্যই বায়োপসি করতে হবে।
রোগ প্রতিরোধে তামাক ও মদ পরিহার করে চলুন।
চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে অপারেশন বা অস্ত্রোপচার, রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।