ছাত্র-জনতার ওপর হামলা : বিএমইউর ৩৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিচ্যুত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ৩৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সিন্ডিকেট সূত্র বলছে, গত বছরের ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে এই ৩৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ওপর নৃশংস হামলা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সামনে এক ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ)।
সূত্রে জানা গেছে, চাকরিচ্যুতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বেশ কয়েকজন নেতাসহ আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা রয়েছেন। এসব শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চার ধরনের অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি। এর মধ্যে কেবিন ব্লকের সামনে একজন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ১৫ জন, ছাত্র-জনতার সঙ্গে মারামারিতে জড়িত ছিলেন প্রায় শতাধিক শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। নেপথ্যে থেকে ওই ঘটনার নেতৃত্বদান ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন ২৩ জন।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, গত শনিবার (৩১ মে) অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত সিন্ডিকেট সভায় ৩৪ জনকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে ‘ক’ ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যাচেষ্টায় সরাসরি জড়িতদের এবং ‘খ’ ক্যাটাগরিতে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
‘ক’ ক্যাটাগরিতে অভিযুক্ত ১৫ জন হলেন—প্যালিয়েটিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. আবু তোরাব মীম, চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগে মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ রিয়াদ সিদ্দিকী, পরিচালক (হাসপাতাল) অফিসের পেইন্টার নিতীশ রায় ও মো. সাইফুল ইসলাম, এমএলএসএস মেহেদী কাজী, সহকারী ড্রেসার মো. শহিদুল ইসলাম, সুইপার সন্দীপ দাস, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অফিস সহকারী উজ্জ্বল মোল্ল্যা, পরিবহন শাখার ড্রাইভার সুজন বিশ্ব শর্মা, ওপিডি-১ এর এমএলএসএস ফকরুল ইসলাম জনি, ল্যাবরেটরি সার্ভিস সেন্টারের কাস্টমার কেয়ার অ্যাটেনডেন্ট রুবেল রানা, ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের এমএলএসএস শাহাদাত, সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স শবনম নূরানী, ওয়ার্ড মাস্টার অফিসের এমএলএসএস মো. আনোয়ার হোসেন এবং কার্ডিওলজি বিভাগের এমএলএসএস মো. মুন্না আহমেদ।
‘খ’ ক্যাটাগরিতে অভিযুক্ত ১৯ জন হলেন—ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারুক হোসেন, নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আহসান হাবিব, ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লাহ, নিউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুভাষ কান্তি দে, অনকোলজি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার ডা. মোহাম্মদ জাহান শামস্, সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নূর-ই-এলাহী, অটোল্যারিংগোলজি- নাক কান গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হাসানুল হক, শিশু নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কে এম তারিকুল ইসলাম, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশীষ কুমার সরকার, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল-মামুন, নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শাহনেওয়াজ বারী, কার্ডিওলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. অমল কুমার ঘোষ, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. পবিত্র কুমার দেবনাথ।
এ ছাড়া এ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, জেনারেল সার্জারি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মাঈদুল হাসান, অর্থোপেডিক্স সার্জারি বিভাগের গবেষণা সহকারী/স্ব-বেতনে কনসালটেন্ট ডা. মোহাম্মদ তারিকুল মতিন, ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেশিয়াল সার্জারি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. ওমর ফারুক এবং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ কুতুবউদ্দিন।
তদন্ত প্রতিবেদনে ‘খ’ ক্যাটাগরি তালিকায় ২৩ জনের নাম এলেও তাদের মধ্য থেকে চারজনের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করে পরবর্তীতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। তারা হলেন—অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. জিল্লুর রহমান ভূইয়া, নিউরোসার্জারি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মনোয়ার হোসেন, সহকারী পরিচালক ও উপপরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. বেলাল হোসেন সরকার ও প্রন্থোডনটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আবিদ।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবিন ব্লকের সামনে এক শিক্ষার্থীকে প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে যেভাবে নির্যাতন করা হয়, তার ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষ্য সুস্পষ্ট। ওই ঘটনায় ‘ক’ ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত ১৫ জন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা সরাসরি অংশ নিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশের ৫(ঘ), ৫(ঝ) এবং ৫(ট) ধারায় আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে পদচ্যুত করার সুপারিশ করেছে কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় সংখ্যক চিকিৎসক-কর্মকর্তার একযোগে চাকরিচ্যুতির সুপারিশ।
এ ছাড়া ‘খ’ ক্যাটাগরিতে থাকা ২৩ জনের মধ্যে ১৯ জনের বিরুদ্ধে সরাসরি ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, ভাঙচুর ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগে অংশ নেওয়ার অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিটিভি রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই ব্যক্তিরা হামলার সময় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাদের ক্ষেত্রেও অধ্যাদেশের ৬(ঠ) ধারা অনুযায়ী চাকরি থেকে পদচ্যুত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী, তাদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসক ও প্রশাসনিক পদে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।
তদন্ত কমিটি আরও বলেছে, অভিযুক্তরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালাই লঙ্ঘন করেননি বরং ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন। অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, শারীরিক নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার মতো ঘটনা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির আওতাভুক্ত গুরুতর অপরাধ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের এবং তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট তাদের প্রোফাইল, প্রমাণ ও তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তরের সুপারিশ করেছে কমিটি।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) তদন্ত কমিটির একাদিক সদস্য এনটিভি অনলাইনকে বলেন , আরও তদন্ত হবে সেখানে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাদের বিষয় সিদ্ধান্ত জানানো হবে। ইতোমধ্যে আরও কয়েক জনের বিষয়ে তদন্ত চলছে।
তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন যারা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দক্ষতা ও শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ’ এর ৮ (ক) (২) ধারা অনুযায়ী গঠিত কমিটির সভাপতি ছিলেন উপউপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. কুদরত-এ-খুদা তালুকদার। তার সঙ্গে ছিলেন মেডিসিন, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, অ্যানাটমি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা। ছিলেন ফ্যাকাল্টি অব মেডিকেল টেকনোলজি ও ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অনুষদের ডিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের উপাচার্য প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং নাগরিক নিরাপত্তা, চিকিৎসা সহায়তা ও শৃঙ্খলা কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্যরা। এ তদন্ত কমিটি টানা ৩৬টি সভা করে চূড়ান্তভাবে ৩৪ জন চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি।