ডায়রিয়া মারাত্মক দিকে যাচ্ছে, কীভাবে বুঝবেন

ডায়রিয়া থেকে কখনো কখনো মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৫৬৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. সুবাস চন্দ্র সাহা। বর্তমানে তিনি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : ডায়রিয়া খারাপ দিকে যাচ্ছে। এ বিষয়গুলো মায়েরা কীভাবে বুঝতে পারবেন?
উত্তর : প্রথমেই যদি আমি বলি, ডায়রিয়া কাকে বলে? ডব্লিউএইচও থেকে নির্ধারিত ডায়রিয়ার একটি ছোট্ট সংজ্ঞা আছে। একটা বাচ্চা যদি ঘন ঘন পানির মতো পায়খানা করে, কতবার করল এর থেকে পায়খানার ধরনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি বাচ্চা যদি ২৪ ঘণ্টায় তিন বা তার বেশিবার পাতলা পানির মতো পায়খানা করে, তাকেই ডায়রিয়া বলা হয়। এখানে পাতলা পানির মতো বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এর গুরুত্বটা বোঝার দরকার এ কারণে, যেসব বাচ্চা খুব ছোট, যারা শুধু বুকের দুধ খায়, তাদের কিন্তু একটু একটু করে সব সময় পায়খানা হতে থাকে। একে এই ডায়রিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। পায়খানার আগের ধরন যা ছিল, সেখান থেকে হঠাৎ পরিবর্তন হলে, একদম পাতলা পানির মতো হয়ে গেলে, ২৪ ঘণ্টায় তিনবার বা তার বেশি হয়ে গেল, তখন একে আমরা ডায়রিয়া বলে থাকি।
তো, তখন আমাদের করণীয় কী? যেহেতু ডায়রিয়ায় শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যাচ্ছে, পানির সঙ্গে কিছু ইলেকট্রোলাইট চলে যাচ্ছে, সে জন্য তার শরীরে পানিশূন্যতা হতে পারে। আমাদের মূল কাজ হচ্ছে, পানিশূন্যতা যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা করা। অথবা হলে তার প্রতিস্থাপন করতে হবে। এখন একজন বাচ্চা যদি তিন ব্যাগ বা চার ব্যাগ পায়খানা করল, সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরে যে পানিশূন্যতা হয়ে যাবে, সেটি নয়। পানিশূন্যতারও পর্যায় আছে, আমরা কোনো পানিশূন্যতাকে বলি মারাত্মক পানিশূন্যতা, এর পর বলা হয় কিছু পানিশূন্যতার লক্ষণ আছে, এর পর দেখি পানিশূন্যতার আর কোনো লক্ষণ নেই।
এই বিষয়গুলো বোঝার কিছু লক্ষণ আছে। শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষণ হলে চোখ বসে যাবে। একজন মা কিন্তু তার জিহ্বা শুকনা না ভেজা বুঝতে পারে। যে জিহ্বাটা ভেজা ভেজা ছিল, সেটা শুকনো হয়ে গেছে। বাচ্চার আচরণে কিছু পরিবর্তন হবে। যখন শরীরে পানিশূন্যতার লক্ষণ হয়, বাচ্চা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাবে। মেজাজি হয়ে যাবে। অথবা তার পিপাসা বেড়ে যেতে পারে। সে মুখের সামনে গ্লাস নিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি আগ্রহ দেখাবে। যখন মারাত্মক পানিশূন্যতা হবে, তখন পানি খেতেই চাইবে না। মনে হবে ঘুমিয়ে রয়েছে। ক্লান্ত হয়ে যাবে। দিনে যতবার প্রস্রাব করত, সেই প্রস্রাবের পরিমাণটা কমে যাবে। তার শরীরের চামড়াগুলো ঢিলা হয়ে যাবে। এগুলো তো চিকিৎসকরা এসে দেখবেন। মায়েরাও বুঝতে পারবেন। এই যে কতগুলো লক্ষণ তার সামনে আসবে, ডায়রিয়ার পরপর এই লক্ষণগুলো এলে দ্রুত তাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিতে হবে বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে বাড়িতে কিছু করার আছে কি?
উত্তর : অবশ্যই। বাড়িতেই অধিকাংশ কাজটা করতে হবে। এর কারণ আমি যদি পুরোটুকু দেখি, ১০০ বাচ্চার ডায়রিয়া হলে ৮৫ থেকে ৯০ জনই থাকে পানিশূন্যহীন। অর্থাৎ এই অসুখের মারাত্মক বা তীব্রতা পাঁচ ভাগের ক্ষেত্রে হয়। শতকরা পাঁচ ভাগের হয়তো অতিরিক্ত পায়খানার কারণে পানিশূন্যতা হতে পারে। আর পাঁচজনের কিছু কিছু পানিশূন্যতা হতে পারে। ৮৫ থেকে ৯০ জনেরই পানিশূন্যতা হবে না। এ ক্ষেত্রে ডায়রিয়া নিজে হয়েই নিজে ভালো হয়ে যায়। এই যে ভালো হয়ে সেরে যায়, এখানে দুই দিনও লাগতে পারে, পাঁচ দিনও লাগতে পারে। এই সময়ে যাতে তার শরীরে পানিশূন্য না হয়, এ জন্য গুরুত্ব দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে কী করতে হবে? আমি ধরেই নিচ্ছি, আমার ১০০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে ৭৫ ভাগ রোগীর মারাত্মক পানিশূন্যতা হবে না। একটা পদ্ধতি আছে, যাতে পানিশূন্যতা না হতে পারে।
এখানে করণীয় কী? তিনটি জিনিস করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। এটা স্বাভাবিক বিষয়। আর একটি হলো তার খাবারটা দিতে হবে।
আমি যদি ছোট বাচ্চার কথা বলি, বিশেষ করে এক বছর, দুই বছর তাদের মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। কোনোভাবেই দুধ বন্ধ করা যাবে না।
আমাদের সমাজের একটি ধারণা হলো ডায়রিয়া পেটের অসুখ, পেট খারাপ হলে কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। কিন্তু ডায়রিয়া হলে খাবার তো দিতেই হবে, পারলে একটু বেশি দিতে হবে। ইচ্ছা করে বন্ধ করা যাবে না। সুতরাং স্তনপান নিয়মিত করাতে হবে। বাচ্চা যদি একটু বড় হয়, ছয় মাস থেকে এক বছর বা তার ব্ড়, সে আনুষঙ্গিক যে খাবারগুলো খাচ্ছিল, সেগুলো দিতে হবে। এরপর আমরা বলি যে একটু বেশি তরল খাওয়াতে হবে। স্বাভাবিক তরল হতে পারে। পানি হতে পারে। ডাবের পানি হতে পারে। চিড়াপানি হতে পারে। আর মাকে পরামর্শ দেওয়া যে এটা বাড়িতে তো চলল, তরলের মধ্যে ওরস্যালাইন খাবে। মাকে পরামর্শ দিতে হবে কখন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমি বলি যে তার চোখ যদি খুব বসে যায়, জিহ্বাটা যদি একদম শুকিয়ে যায়। এর পর বাচ্চা খিটমিটে হয়ে যাচ্ছে। খেতে চাইছে না। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। এসব বিষয়ে তাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
কারণ, যে বাচ্চা মারাত্মক পানিশূন্যতার মধ্যে পড়ে যায়, তাকেও যদি আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুসারে ঠিক করে দিই, যে বাচ্চা প্রায় মৃত অবস্থায় এসছিল, সে কিন্তু হেঁটে বাড়ি যাবে। এই চিকিৎসাটা এক ধরনের জাদুকরি চিকিৎসা।
প্রশ্ন : রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন সম্পর্কে একটু বলুন?
উত্তর : রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন তো অবশ্যই আছে। এটা ভালো। তবে বেশ দামি। তবুও সামর্থ্যবান যারা, তারা দিয়ে নিতে পারে। তবে সরকারি পর্যায়ে এখনো সেটা দেওয়া শুরু হয়নি। তবে কারো সামর্থ্য থাকলে সে এটি করতে পারে।