সন্তানের প্রতি পিতামাতার আচরণ কেমন হওয়া উচিত

সন্তানের প্রতি পিতামাতার আচরণ শিশুর সঠিক জীবন গড়ে তোলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৪৬২ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা.মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন: পজিটিভ প্যারেনটিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সন্তানের প্রতি বাবা-মা কী আচরণ করবেন? শিশুর মানসিকতার সাথে তিনি কতটা খাপ খাইয়ে নেবেন, কখন শাসন করবেন, কখন একমত হবেন, এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা প্রায়ই শুনতে পাই সন্তান অবাধ্য হচ্ছে, সে সঠিক পথে থাকছে না। শুরুতে একটু বলবেন পজিটিভ প্যারেনটিং মানে কী?
উত্তর: পজিটিভ প্যারেনটিংয়ের (ইতিবাচকভাবে শিশুদের বেড়ে তোলা)ধারণাটা এ রকম যে শিশু লালন পালনের বিষয়টিকে একটি ইতিবাচক দৃষ্টি থেকে দেখা। আমরা সাধারণত অভিভাবকরা বিশেষ করে কম বেশি সবাই এটি বিশ্বাস করি, আমরা খুঁজে খুঁজে নেতিবাচক দিকগুলো দিকে আলোকপাত করি। এটা খারাপ হলো, সেটা খারাপ হলো। তবে ইতিবাচক দিকও কিন্তু আছে। যেমন একটি দুষ্টু বাচ্চার কথাই ধরুন। সে কিছু সময়ের জন্য কিন্তু ভালো আচরণও করে। প্রত্যেকটি মানুষের, সে চোর ডাকাত যাই হোক না কেন, তার ভালো দিকও কিন্তু রয়েছে। আমরা যদি নেতিবাচক দিকের প্রতি দৃষ্টি দিই, তাহলে কেবল সেটিই দেখব। সেটিই চোখে পড়বে। ইতিবাচক দিকে দৃষ্টি দিলে সেটা দেখতে পাব এবং বাচ্চাকে সেভাবে দেখব।
এটা অনেকটা এ রকম আপনি যদি গুগুলে সার্চ দেন বারাক ওবামার ভালো গুণ। তখন আপনি ভালো জিনিস দেখবেন। আর নেতিবাচক জিনিস যদি খুঁজেন তাহলে কিন্তু সেটিই সার্চ ইঞ্জিন সামনে নিয়ে আসবে। বাবা-মা যদি নেতিবাচক মানসিকতার হোন তাহলে আশঙ্কা রয়েছে শুধু খারাপ দিকটিই দেখার।
খুব প্রচলিতভাবে মা-বাবা যেটা করেন, ও তো দুষ্টু হয়ে গেছে। ও তো খারাপ হয়ে গেছে। ওর আর ভালো হওয়ার আশা নেই। এই লেভেলিং যখন নেতিবাচক হয়ে যায়, এই শিশুটির ইতিবাচক পথে আসার পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে যায়। অনেকটা এ রকম যে একটি চোর সে গোপনে চুরি করে, কেউ জানে না সে চোর। সে কিন্তু সাবধানে থাকে, কিছু কিছু সময় সে চুরি করে না। কারণ যদি ধরা পড়ে যায়। আর যদি ব্র্যান্ড হয়ে যায়, সে চোর। সবাইতো জানে সে চোর। তাহলে চুরি করতে লজ্জা কোথায়?
খারাপ বাচ্চার তো এ রকম করাই স্বাভাবিক। আমি খারাপ বাচ্চা। আর আমি যদি ভালো বাচ্চা হই, তাহলে ভালো করব। অনেক সময় বাবা মায়েরা বলত সে পড়ালেখায় ভালো। তখন ভাবতাম আমি ভালো। আমি ভালো হয়ে একটি খারাপ কাজ কীভাবে করি। ভূমিকাটা ইতিবাচক।
পজিটিভ প্যারেনটিং ওই জায়গাটা নিয়ে কাজ করে। বাবা-মাকে ওই জায়গায় নিয়ে আসে।
প্রশ্ন: বাচ্চারা অনেক সময় যেটা সঠিক সেটি করতে চায় না। মা-বাবা তখন তাকে নিবৃত করতে গিয়ে, শাসনের পথ বেছে নেয়। বা একটু গাল মন্দও করে। কোনো কোনো বাবা-মা শাসন করতে গিয়ে গায়ে হাতও তোলে, যেটি উচিত নয়। সেক্ষেত্রে ওই বাবা মায়ের প্রতি পরামর্শ কী? বাচ্চাকে কীভাবে ডিল করবে?
উত্তর: আমরা সবসময় বলি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। আপনি সমস্যা শুরু হয়ে যাওয়ার পরের কথা বলছেন। আপনি যদি একটু দেখেন সমস্যা শুরু হলো কীভাবে? প্রত্যেকটি বাচ্চা,মানুষের একটি নিজস্ব চাহিদা আছে। নিজস্ব প্রবণতা আছে। বাবা-মা যখন বাচ্চাদের সাথে কথা বলে তখন বড় মানুষের জায়গাটা দেখতে পায়,বাচ্চাদের জায়গাটা দেখতে পায় না। আমাদের কাছে যখন বাবা-মায়েরা আসেন তাদের বাচ্চাদের সমস্যা নিয়ে, আমাদের প্রথম কাজ হলো আমরা তাদের বুঝতে বলি এই বয়সে একটি বাচ্চার প্রয়োজন কী? আপনি একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন। আপনি সেখানে কী চাইতেন? আপনার মা-বাবা আপনার মধ্যে কী কী চাইতেন? আপনার মধ্যে কী কী চাহিদা ছিল? কী ভালো লাগত? কী খারাপ লাগত? তখন তারা অনুধাবন করে যে আমার বাচ্চারাও তো এই জিনিসগুলো আছে। বাবা-মায়েরা যেটা করেন, তারা তাদের জায়গা থেকে দেখে বলেন, সমস্যা করেন। এর শুরুটা কিন্তু এখানে নয়, শুরুটা আরো গোড়াতে। আমি একটি ছোট্ট উদাহরণ দিই আপনাকে। আপনি হয়তো পরিশ্রম করে একটা কিছু কাজ করছেন যেটা খুব জরুরি। আপনাকে সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। ধরুন আজ রাতের মধ্যে এটি শেষ করে জমা দিতে হবে কোথাও। এখন হয়তো আপনার বাচ্চা দুপুর বেলা খাওয়ার পর এসে বলল,বাবা চলো খেলি। একটি বাচ্চার বয়স হয়তো ছয় বছর। একটি বাচ্চার বয়স হয়তো চার বছর। আপনি কী বলবেন? বাবা ব্যস্ত আছি। এখন খেলতে পারছি না। আগামীকাল তোমাদের সাথে খেলব। এখন বাচ্চা দুটো হয়তো খেলতে গেল। বড় বাচ্চাটি ছোটো বাচ্চাটিকে ধরে থাপ্পড় বা চিমটি দিল। এবং ছোটো বাচ্চাটি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করে দিল। তখন আপনি কী করবেন? স্বাভাবিকভাবে উঠে যাবেন এবং বোঝার চেষ্টা করবেন ঘটনাটা কী। বড় বাচ্চাটিকে ধরে একটু বকাঝকা করলেন। ছোটো বাচ্চাটিকে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বললেন বাবা কাঁদে না। কতক্ষণ আদর করবেন ভাবুন তো? যতোক্ষণ তার কান্না না থামছে। এটা খুব সহজভাবে আমরা করি। এর মানেটা কী বাচ্চার কাছে? খেয়াল করেন বাচ্চা দুটো শিখবে এক নম্বর, যে বাবা বলেছিল সময় নেই। উঠতে পারবে না যে এতই ব্যস্ত। এখন তো ঠিকই উঠলো। তার মানে বাবার কথা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। দুই নম্বর হলো সোজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না। এখন কিন্তু একটা ঘটনা ঘটল আর বাবা বাধ্য হয়ে উঠে আসলো। ছোট বাচ্চাটা কী শিখবে? আরে আমি কান্না থামালেই বাবা চলে যাচ্ছে। যদি একটু বেশিক্ষণ কাঁদি বাবা বেশিক্ষণ থাকবে। আমার কান্না যতো দীর্ঘায়িত হবে বাবা বা মা আমার সাথে ততক্ষণ থাকবে। এই প্রক্রিয়াতে আসলে বাবা-মায়ের কিছু করার নেই। কারণ বাচ্চার কান্না থামাতে হলে তার তো উঠে যেতেই হবে। এই বিষয়টি হতোই না যদি মা-বাবা বাচ্চার প্রয়োজনের প্রতি সচেতন থাকত।
যেমন ধরুন কোয়ালিটি টাইম। এটিতে যাওয়ার আগে আরেকটি বিষয় বলে রাখি, কর্মজীবী মায়েরা এবং গৃহিণী মায়েরা এদের মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। ধারণা রয়েছে কর্মজীবী মায়েরা ভালো মা নয়। গৃহিণী মায়েরা ভালো মা, কারণ ২৪ ঘণ্টা বাচ্চার সাথে থাকছে। এটা একদমই ঠিক নয়। একটি বাচ্চা বা যেকোনো মানুষের জন্য প্রয়োজন হলো কোয়ালিটি টাইম, কোয়ান্টিটি নয়। কোয়ালিটিটাই বিষয়। আপনার স্ত্রী যদি আপনার সামনে ২৪ ঘণ্টা বসে ঘ্যান ঘ্যান,প্যান প্যান করে আপনি কী ভালো অনুভব করবেন? অবশ্যই নয়। তবে আপনার সাথে যদি পাঁচ মিনিট সময় থাকে, কিন্তু খুব সুখী সময় আপনারা কাটান, তাহলে সারা জীবন আপনি মনে রাখবেন যে ওই সময়টি আমরা উপভোগ করেছি। বাচ্চার বিষয়টিও সেই রকম। একটি বাচ্চা চায়, বাবা-মা আমার সাথে থাকল, কথা বলল। বাবা-মা ভাবে আমি তো তার সাথে আছি। সেটা আসলে থাকা নয়।
আমরা যেটা করি সাধারণত অফিস থেকে আসার পর পত্রিকা পড়ি। টিভি দেখি। বাচ্চা হয় তো কিছু একটা করছে। আমি বললাম হ্যাঁ ভালো হয়েছে। তবে আমি টিভি দেখছি। বাচ্চাকে কী শেখে? বাচ্চার শেখে ওনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টিভি, পত্রিকা। আমি সেকেন্ডারি। এই জায়গাটা পরিবর্তন করতে হয়। বাচ্চাকে বুঝতে দিতে হবে বাবা-মার তার প্রতি যথাযথ মনোযোগ আছে। বাচ্চার প্রয়োজন যেন পূর্ণ হয়। বাচ্চাকে এই রকম অসুবিধা করে যেন মনোযোগ করতে না হয়। আরেকটি খুব প্রচলিত সমস্যা ইদানিং হয় বাবা-মার মধ্যে। বাবা হয়তো এক রকম বলছে, মা আরেকরকম বলছে। বাচ্চারা কিন্তু দ্বিধান্বিত হয়। আমার সুবিধার জন্য কার কাছে বললে লাভ হবে? এখানে বাচ্চাদের দোষ দেব না আমি। এটা মানুষের স্বভাব। আমরা আমাদের সুবিধার জন্য এটা করি সেটা করি। ওরাও কিন্তু মানুষ। ওরাও এটা করে। কিন্তু আপনি যদি শুরুর দিকে এগুলো প্রতিরোধ করেন, তাহলে কিন্তু ঠিক করা সম্ভব। আমরা যেটা বলি বাচ্চার প্রয়োজনের প্রতি যত্নবান হতে হবে। এটা বলে হয় না। এটা আপনাকে কথা না বলে দেখাতে হবে। আমি তোমার সাথে আছি। আমি তোমার জন্যই করছি এবং আমি তোমার জন্যই করছি।
আমাদের বাবা মায়েরা যেটা করে একটা হয়তো ফ্ল্যাট কিনল।তার ভবিষৎ নিশ্চিত করে দেওয়ার জন্য। ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে আমাকে দিনান্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। আমার সারাদিন চিন্তা থাকছে সেটি নিয়ে। আমি ভাবছি সেটি নিয়ে। বাচ্চাটা যখন দুষ্টুমি করে, আমি ওর সাথে সময় দেবো সেটি করি না। তবে আসলে হয়ত আপনার ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া দরকার ছিল না। ওকে যদি ভালো সময় দেন, সে যদি বোঝে মা-বাবা আমার জন্য, সে কিন্তু নিজেই ফ্ল্যাট করে নিতে পারবে।
প্রশ্ন: বাচ্চাদের আমরা লেখাপড়ার জন্য চাপ দিই। বাচ্চা সেটা নিতে পারে না। অনেক সময় আবার দেখা যায় বাচ্চাকে আবার যদি সেটা না দেওয়া হয় সে লেখাপড়াও করে না। ফলাফল খারাপ হচ্ছে। এই বিষয়টির দেখভাল কীভাবে হবে?
উত্তর: এখনকার দিনে তো বিষয়টি বেশ কঠিন। বিশেষ করে শহরে। বাচ্চারা পড়াশুনা করতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। কারণ, পড়াশুনা করে সে পাবে কী? আমরা মূলত জিততে চাই। আপনি কি এমন অফিসে চাকরি করবেন যেখানে বেতন পাচ্ছে না বা কোনো কাজ হচ্ছে না? কেউই করবে না। বাচ্চারা কিন্তু আরো জটিল। বড় যারা হয়ে যাই, তারা দীর্ঘমেয়াদী লাভ দেখতে পাই। এই বিষয়টির পেছনে এক বছর লেগে থাকলে, এটা পাব। রাজি আছি। বাচ্চারা তাৎক্ষণিক লাভ পেতে চায়। আপনি যদি তাকে বলেন এর পেছনে এক বছর লেগে থাকলে তুমি এক লাখ টাকা পাবে। আর পাঁচ মিনিট লেগে থাকলে ২০ টাকা পাবে। সে কিন্তু পাঁচ মিনিট লেগে থাকবে। কারণ, ২০ টাকা সে দ্রুত পাচ্ছে। ওদের কাছে লেখাপড়া করলে দ্রুত কোনো লাভ নেই। তাই বাবা-মা যতোই বলুন পড় পড় পড়, এটি তার জন্য বিরক্তিকর। ওকে যেটা করতে হবে লেখাপড়াকে খেলার মাধ্যমে করতে হবে। এখন অনেক স্কুল আছে, শিক্ষকরা আছে ইতিবাচক। তারা বাচ্চার কাছে লেখাপড়াকে আনন্দদায়ক করে তুলতে চায়। আনন্দদায়ক হয়ে গেলে সেটি সে নিজে নিজে করবে। দেখবেন যেসব বাচ্চারা পড়াশুনা করে না, তারাও কোনো কোনো বিষয় পড়তে পছন্দ করে। কেন? কারণ ওখানে সে আনন্দ পায়। বাবা-মাদের ভাবতে হবে যে কীভাবে পড়াশুনাটা ওদের কাছে আনন্দদায়ক করা যায়।