বন্যায় স্বাস্থ্য সতর্কতায় ছয় পরামর্শ

এখন দেশজুড়ে বন্যা। নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে পানির নিচে। বন্যাকবলিত এলাকায় পানীয়জল ও বর্জ্য পদার্থ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি ভেঙে চলাচল করছে। বন্যার দীর্ঘ স্থায়িত্বের কারণে এই পানিতে বংশবিস্তার করছে হাজার হাজার রোগজীবাণু। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ যখন এই দূষিত পানি পান করছে কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করছে, তখন তারা আক্রান্ত হয়ে পড়ছে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে। ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন আন্ত্রিক রোগ। বৃষ্টি ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে মশার উপদ্রবও বেড়ে যায়। যেসব স্থানে এডিস মশার উপদ্রব বেশি, সেসব স্থানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবও বেশি ঘটে। গ্রামাঞ্চলে ঘটে সাপে কাটার ঘটনা।
বন্যার প্রথম বিবরণ আমরা পাই গ্রিক মিথলজিতে। দেবরাজ জিয়ুসের ভাই পসাইডনকে বলা হতো সমুদ্রদেবতা। সুবিশাল সমুদ্রে এক সুরম্য স্বর্ণপ্রাসাদে পসাইডন বাস করতেন। তিনি যে রথে বিচরণ করতেন, সেই রথ বহন করত জলপরী ও সমুদ্রদানবরা। কথিত আছে, পসাইডন কোনো কারণে রেগে গেলে সমুদ্রে বিপুল তুফান শুরু হতো। পানি ফুলে-ফেঁপে প্রায় আকাশের কাছাকাছি চলে যেত। সেখান থেকে হতো বন্যা, দুর্ভিক্ষ আর মহামারী। তাই পসাইডন যাতে রেগে গিয়ে বন্যার সৃষ্টি করতে না পারেন, সে জন্য তাকে সন্তুষ্ট রাখতে তার উদ্দেশে বিভিন্ন প্রসাদ দান করা হতো। হজরত নূহ (আ.)-এর সময় বন্যা এসেছিল পৃথিবীর বুক থেকে অবিশ্বাসী এবং পাপীদের বিনাশ করতে। হজরত নূহ (আ.) কিস্তিতে চড়ে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন নিজেকে, তাঁর সঙ্গে যাঁরা আসতে চেয়েছিলেন, সবাইকে ও গবাদিপশুদের।
বন্যা নিয়ে অনেক উপগাথা রচিত হলেও বন্যা প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক এক বিপর্যয়। বন্যার দূষিত পানি মানুষের জীবনযাত্রা বিপন্ন করে তোলে। বন্যায় সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার বেড়ে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় শিশুরা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে দেখা দেয় নানা সমস্যা। ডায়রিয়া, কলেরা, রক্ত আমাশয়, টাইফয়েড, প্যারাটাইফয়েড, ভাইরাল হেপাটাইটিস, পেটের পীড়া, কৃমির সংক্রমণ, চর্মরোগ, চোখের অসুখ প্রভৃতি মহামারী আকার ধারণ করে ছড়িয়ে পড়ে। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
১. বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করতে হবে
বন্যার সময় পানির উৎস সংক্রমিত হয়ে যায়। এ কারণে পানি থেকে বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে যে পানি ওঠে তার প্রধান উৎস বিভিন্ন স্যুয়ারেজ লাইন। নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হওয়ায় স্যুয়ারেজ লাইনে পানিনিষ্কাশনও সম্ভব হয় না। রাজধানী এবং বন্যাকবলিত এলাকায় শুধু বিশুদ্ধ পানির অভাবে বিস্তার লাভ করে পানিবাহিত রোগগুলো। ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, কৃমির সংক্রমণ দেখা দেয় মহামারী হিসেবে। ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যু ঘটে অনেকের। পানির অপর নাম জীবন, কিন্তু দূষিত পানির অপর নাম এখন মৃত্যু-মহামারী। সুতরাং বন্যায় প্রথমেই পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। পানিকে বিশুদ্ধ করে খাওয়া ও দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করতে পারলে এসব রোগের হাত থেকে বাঁচা সম্ভব হবে।
বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য পানি ভালোমতো ফুটিয়ে নিতে হবে। পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে তার পর পান করতে হবে এবং সব কাজে ব্যবহার করতে হবে।
* টিউবওয়েলের নিরাপদ পানি পান করা ও সব কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে টিউবওয়েলের পানি এক ঘণ্টা চেপে ফেলানোর পর তা সংগ্রহ করতে হবে। অবশ্য টিউবওয়েলের পানিও ফুটিয়ে নেওয়াটা নিরাপদ।
* বন্যার পানিতে টিউবওয়েল ডুবে গিয়ে থাকলে সেই টিউবওয়েলের পানি খাওয়া নিরাপদ নয়। এ ক্ষেত্রে টিউবওয়েলের ওপরের অংশ বাকেটসহ খুলে নিয়ে, পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বাকেট ধুয়ে পুনঃস্থাপন করতে হবে। এক কলস পানিতে তিন-চার চা চামচ ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে টিউবওয়েলের ভেতর এই পানি ঢেলে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এরপর একটানা আধা ঘণ্টা চেপে টিউবওয়েলের পানি বের করে ফেলে দিলে টিউবওয়েলের পানি খাওয়ার উপযোগী হবে। ব্লিচিং পাউডার পাওয়া না গেলে একটানা এক ঘণ্টা চেপে টিউবওয়েলের পানি বের করে ফেলতে হবে। এক ঘণ্টা পর টিউবওয়েলের পানি খাওয়ার উপযোগী হবে। তবে এ সময় নিরাপত্তার জন্য টিউবওয়েলের পানিও ভালোমতো ফুটিয়ে নেওয়া উচিত। পানি ছেঁকে ১০ মিনিট টগবগিয়ে ফুটিয়ে তার পর ঠান্ডা করতে হবে।
* পানি ফুটানোর ব্যবস্থা না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে। প্রতি দেড় লিটার খাবার পানিতে ৭ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম হ্যালোজেন ট্যাবলেট (হ্যালো ট্যাব), তিন লিটার পানিতে ১৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট এবং ১০ লিটার পানিতে ৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা রেখে দিলে পানি বিশুদ্ধ হয়।
তবে এতে অন্যান্য জীবাণু মরলেও ভাইরাসজাতীয় জীবাণু মরে না। একমাত্র টগবগিয়ে পানি ফুটানোর ফলে ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হয়। অনেকে ফিটকিরি ব্যবহার করতে আগ্রহী, কিন্তু ফিটকিরিতে পানি জীবাণুমুক্ত হয় না। যদি অন্য কোনো ব্যবস্থার সুযোগ না থাকে, তাহলে ফিটকিরি ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২৫ লিটার পানিতে দুই চা চামচ গুঁড়া ফিটকিরি ভালোভাবে মিশিয়ে এক ঘণ্টা পর পান করা যেতে পারে।
* পানি বিশুদ্ধ করার জন্য বাসার পানির ট্যাংকিতে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতি এক হাজার লিটার পানিতে ২৫০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার এক ঘণ্টা রাখলে পানি বিশুদ্ধ হবে। তবে এ ক্ষেত্রেও ভাইরাস জীবাণু ধ্বংস হবে না।
২. বন্যার পানি থেকে দূরে থাকতে হবে
বন্যার পানিতে হাঁটা কিংবা পানি শরীরে লাগানো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বন্যার পানিতে গোসল করা, কাপড়চোপড় ধোয়া কিংবা থালাবাসন পরিষ্কার করা কোনোটাই চলবে না। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের বন্যার পানির সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। রাস্তাঘাটে যেখানে বন্যার পানি ঢুকে গেছে, সে স্থানে খেলাধুলা করা যাবে না। কেননা, বন্যার দূষিত পানি শরীরে লেগে চর্মরোগ কিংবা চক্ষুরোগ হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব বন্যার পানি এড়িয়ে চলতে হবে। বন্যার পানি দিয়ে কখনো কেউ যেন হাত-মুখ না ধোয় এবং কুলি না করে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। একজনের গামছা বা তোয়ালে আরেকজন ব্যবহার করা যাবে না।
৩. ডায়রিয়া প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে
বন্যায় প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা হলো ডায়রিয়া। ডায়রিয়া প্রতিরোধের জন্য খাবার আগে সাবান দিয়ে নিরাপদ পানির সাহায্যে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। পায়খানা করার পর হাত একইভাবে পরিষ্কার করতে হবে। স্যানিটারি পায়খানা বা জলাবদ্ধ পায়খানা ব্যবহার করতে হবে। ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা শুরু হলে পরিমাণমতো খাবার স্যালাইন খেতে হবে। দুই বছরের কম শিশুকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর ১০-১২ চা চামচ খাবার স্যালাইন দিতে হবে। ২ থেকে ১০ বছরের শিশুকে দিতে হবে ২০ থেকে ৪০ চা চামচ। ১০ বছরের বেশি বয়সী শিশুকে দিতে হবে যতটা বেশি দেওয়া যায়। খাবার স্যালাইন বা ওআরএস না থাকলে বিকল্প হিসেবে বাড়িতে প্রস্তুতকৃত লবণ-গুড়ের শরবত খাওয়াতে হবে। এর সঙ্গে ভাতের মাড়, চিড়ার পানি, ডাবের পানি, কিছু পাওয়া না গেলে শুধু নিরাপদ পানি খাওয়ানো যেতে পারে। এ সময় যাতে শিশুর পুষ্টিহীনতা না হয়, সে জন্য খিচুড়ি খাওয়ানো প্রয়োজন। প্রতি শিশুকে এ সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানো যেতে পারে। যদি পাতলা পায়খানা ও বমির মাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কারণ, এ ক্ষেত্রে রোগীর শিরাপথে স্যালাইন ও অন্যান্য ওষুধের প্রয়োজন পড়ে।
৪. খাবার গ্রহণে সতর্ক হতে হবে
বন্যায় পচা-বাসি খাবার খেতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। এর ফলে ছড়িয়ে পড়ে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য আন্ত্রিক রোগ। কিন্তু এ সময়ে খাবার গ্রহণে সতর্ক হতে হবে। বাসি-পচা খাবার খাওয়া যাবে না। রাস্তার পাশ থেকে ফুসকা বা চটপটি খাওয়া একেবারেই বন্ধ করতে হবে। এ সময় খিচুড়ি খাওয়া স্বাস্থ্যোপযোগী। খাওয়ার আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। খাবার প্লেটও সাবান ও নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এ কথা সত্যি, বন্যায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেওয়ায় প্লেট বা থালাবাসন বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ঠিকমতো ধোয়া হয় না। পানি বেশি খরচ হয় বলে অনেকে প্রথমে একবার স্বাভাবিক পানিতে থালাবাসন ধুয়ে তার পর ফুটানো পানিতে ধুয়ে থাকে। কিন্তু এটা ঠিক নয়। কারণ, এতে থালাবাসনে অনেক ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো পরে পরিষ্কার পানিতে ধুলেও জীবাণু দূর হতে চায় না। তাই খাবার গ্রহণের আগে থালাবাসন পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
৫. মলত্যাগে সতর্ক হতে হবে
বন্যার সময় মলত্যাগে সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি। যেখানে সেখানে মলত্যাগ করা চলবে না। যেখানে সেখানে মলত্যাগ করার ফলে পেটের পীড়া তো রয়েছেই, উপরন্তু কৃমির সংক্রমণ বেড়ে যায়। একটি নির্দিষ্ট স্থানে মলত্যাগ করতে হবে এবং মলত্যাগের পরে সাবান বা ছাই দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। মলত্যাগের সময় কখনো খালি পায়ে থাকা চলবে না, কেননা বক্রকৃমির জীবাণু খালি পায়ের পাতার ভেতর দিয়ে শরীরে সংক্রমিত হয়। এ সময় বাসার সবাইকে কৃমির ওষুধ খেতে হবে। দুই বছর বয়সের নিচের শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৬. আকস্মিক দুর্ঘটনা থেকে সাবধান থাকতে হবে
বন্যার কারণে যেমন রোগের বিস্তার বৃদ্ধি পায়, তেমনি দেখা দেয় আকস্মিক দুর্ঘটনা। কেবল প্রাথমিক চিকিৎসা ও সতর্কতার মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। বন্যায় সাধারণত বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে যাওয়া, সাপ ও পোকামাকড়ের কামড়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটে। বন্যায় পানির নিচে বহু টাওয়ার, খুঁটি, ট্রান্সফরমার লাইনের তার ডুবে যায়। তাই বৈদ্যুতিক লাইনের নিচ দিয়ে নৌকা বা ভেলা চালানো যাবে না অথবা বিদ্যুতের টাওয়ার, খুঁটি, তার বা ট্রান্সফরমার স্পর্শ করা যাবে না। বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেলে বা পড়ে থাকতে দেখলে তা স্পর্শ না করে বিদ্যুৎকর্মীদের জরুরিভাবে খবর দিতে হবে। বৈদ্যুতিক লাইনের তার কোথাও পানির কাছাকাছি দেখামাত্র সেখান থেকে দূরে সরে যেতে হবে এবং দ্রুত নিকটস্থ বিদ্যুৎ অফিসে খবর দিতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।