হাতের কব্জির ব্যথায় কী করবেন?

কব্জির ব্যথা খুব সাধারণ একটি সমস্যা। হঠাৎ ইনজুরির কারণে কব্জিতে বিভিন্ন ধরনের ব্যথা হয়ে থাকে। মচকে গেলে কিংবা হাড় ভাঙলে কব্জিতে বেশ ব্যথা হয়। তবে অনেক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার জন্য কব্জিতে ব্যথা হতে পারে, যেমন—বারবার কব্জিতে চাপ, বাত ও কারপাল টানেল সিনড্রোম।
যেহেতু অনেক কারণে কব্জিতে ব্যথা হতে পারে, তাই কখনো কখনো দীর্ঘমেয়াদি কব্জির ব্যথার সঠিক কারণ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। সঠিক রোগ নির্ণয় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তার ওপর নির্ভর করে আপনার কব্জির ব্যথার সঠিক চিকিৎসা।
কব্জির ব্যথার উপসর্গ কেমন হয়?
কব্জির ব্যথার উপসর্গ বিভিন্ন ধরনের হয়। এটি নির্ভর করে ঠিক কী কারণে ব্যথা হচ্ছে, তার ওপর। যেমন—অস্টিওআর্থ্রাইটিসের ব্যথা ঠিক ভোঁতা ধরনের দাঁতব্যথার মতো, অথচ টেনডনের প্রদাহ বা টেনডিনাইটিসের ব্যথা সাধারণত তীক্ষ্ণ ও ধারালো ধরনের।
আপনার কব্জির ব্যথার স্থানটি নির্ভুলভাবে দেখাতে পারলে ব্যথার কারণ খুঁজে বের করা সহজ হবে।
কব্জির ব্যথার কারণগুলো কী?
আপনার কব্জি বা রিস্টজয়েন্ট হলো একটি জটিল সন্ধি, যা তৈরি হয়েছে কয়েকটি হাড়ের সমন্বয়ে, যেমন—রেডিয়াস ও আলনা হাড়ের নিম্নাংশ এবং আটটি ছোট ছোট কারপাল হাড়। এই কারপাল হাড়গুলো দুই সারিতে সাজানো। লিগামেন্টের শক্ত ব্যান্ড আপনার কব্জির হাড়গুলোকে একে অন্যের সঙ্গে, আপনার রেডিয়াম ও আলনা হাড়ের নিম্নাংশ এবং আপনার হাতের হাড়গুলোকে সংযুক্ত করে। টেনডনগুলো হাড়ের সঙ্গে মাংসপেশিকে সংযুক্ত করে। আপনার কব্জির যেকোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্যথা হতে পারে এবং আপনার হাত ও কব্জির ব্যবহারের সক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
কব্জির ব্যথার সাধারণ কারণগুলো নিচে বর্ণিত হলো :
১. ইনজুরি
হঠাৎ সংঘর্ষ
হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনের দিকে পড়ে গেলে আপনার কব্জিতে খুব বেশি ইনজুরির ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রে কব্জি মচকে যায়, কব্জিতে টান পড়ে এবং কব্জির হাড় ভেঙেও যায়। কব্জির বুড়ো আঙুলের দিকে হাড়টির নাম স্কাফয়েড। এটি অনেক সময় ভেঙে যায়। এ ধরনের হাড় ভাঙলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা এক্স-রেতে নাও দেখা যেতে পারে। ব্যথা অনেক দিন থাকে, কব্জি নাড়াচাড়া করলে ব্যথা বাড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে হাত দিয়ে কাজ করা যায় না। প্লাস্টার করেও ব্যথার উপশম হয় না। অপারেশন করতে হয়। অনেক সময় স্কাফয়েড হাড় ভাঙলে হাড়ের মধ্যে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় এবং হাড়ের জোড়া লাগতে সমস্যা হয়। যার ফলে ব্যথা হয় এবং কব্জি নাড়তে অসুবিধা হয়। তখন অপারেশনের প্রয়োজন হয়।
হাতের ওপর ভর দিয়ে পড়ে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কলিস ফ্রাকচার হয়। এ ক্ষেত্রে রেডিয়াসের নিচের অংশ ভেঙে যায়। কব্জি ফুলে যায়।বারবার চাপ
কব্জি বারবার নাড়াতে হয় এমন যেকোনো কাজে টেনিস বল খেলা থেকে শুরু করে কিংবা বেহালা বহন করতে করতে কব্জির সন্ধির চারপাশের টিস্যুতে প্রদাহ হতে পারে কিংবা হাড় ভেঙে যেতে পারে। বিশেষ করে কোনো বিরতি ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কব্জির কাজ করলে। বারবার চাপের ফলে হাতের কব্জির ব্যথার আরেকটি কারণ হলো ডি কোয়ার ভেইন’স ডিজিজ। এ ক্ষেত্রে কব্জির বাইরের দিকে, অর্থাৎ রেডিয়াসের ওপর দিয়ে যে দুটো টেনডন বিন্যস্ত রয়েছে, তাদের আবরণীতে প্রদাহ হয়। ব্যথা বুড়ো আঙুলের মূলে অনুভূত হয়।
ডি কোয়ার ভেইন’স ডিজিজে কব্জি নাড়াতে খুব ব্যথা হয়, কাজ করতে অসুবিধা হয় এবং অনেক সময় কাজের পর ব্যথা বেশ বেড়ে যায়। বুড়ো আঙুলে চাপ দিলে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
২. আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা
অস্টিওআর্থ্রাইটিস
সাধারণত কব্জিতে অস্টিওআর্থ্রাইটিস খুব কম হয়। কোনো লোকের কব্জিতে আগে ইনজুরি হয়ে থাকলে পরে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়। এ ক্ষেত্রে কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি ছিঁড়ে যায় বা ক্ষয় হয়। বুড়ো আঙুলের মূলে ব্যথা হয়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তার নিজস্ব টিস্যুগুলোকে আক্রমণ করে। কব্জিতে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস খুব বেশি পরিলক্ষিত হয়। যদি একটি কব্জি আক্রান্ত হয়, তাহলে সাধারণত অন্য কব্জিতেও এটি ঘটে।
৩. অন্যান্য রোগ ও অবস্থা
কারপাল টানেল সিনড্রোম
আপনার কব্জির তালুর দিকের অংশে একটি পথ রয়েছে, যার নাম কারপাল টানেল; এর মধ্য দিয়ে মিডিয়ান নার্ভ অতিক্রম করে। মিডিয়ান নার্ভে চাপ পড়লে কব্জি ও হাতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এ অবস্থার নাম কারপাল টানেল সিনড্রোম।
গ্যাংলিয়ন সিস্ট
কব্জির ব্যথার অন্যতম কারণ হলো এক ধরনের টিউমার জাতীয় ফোলা বস্তু থাকে, যাকে গ্যাংলিয়ন বলে। এটি ওঠে টেনডনের আবরণী থেকে কব্জির পেছনে অথবা সামনের দিকে। স্থানটি ফুলে ওঠে। কব্জি নাড়ালে ব্যথা হয়। বড় গ্যাংলিয়ন সিস্টের চেয়ে ছোটগুলো বেশি ব্যথা সৃষ্টি করে।
কিয়েনবক’স ডিজিজ
এটি সাধারণত তরুণদের হয়। এ ক্ষেত্রে কব্জির লুনেট নামের ছোট হাড়টিতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়ে হাড়টি কোলাপস করে। লুনেট হাড়ের ওপরে চাপ দিলে ব্যথা লাগে এবং রোগী হাত মুঠো করে ধরতে পারে না।
কব্জি ব্যথার ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো কী?
যে কারো হাতের কব্জিতে ব্যথা হতে পারে, তা আপনি অল্প কাজ করুন কিংবা বেশি কাজ করুন না কেন। কিন্তু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের কারণে এ ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। যেমন—
খেলাধুলা করা
বিভিন্ন খেলাধুলায় কব্জিতে ইনজুরি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে বোলিং, গলফ, জিমন্যাস্টিক, টেনিস প্রভৃতি।
বারবার কাজ করা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাত ও কব্জির যেকোনো কাজ বারবার করলে কব্জির ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। যেসব মহিলা হাঁড়ি-পাতিল ধোয়াধুয়ি করেন বা বুননের কাজ করেন (যেমন সোয়েটার বোনা), তাঁদের কব্জির ব্যথা বেশি হয়। যাঁরা চুল কাটার কাজ করেন, তাঁদেরও কব্জির ব্যথা বেশি হয়।
যাঁরা কম্পিউটার কিবোর্ডে টাইপ করেন, কম্পিউটার মাউস ব্যবহার করেন, হ্যান্ডবল খেলেন, সেলাই করেন, আঁকাআঁকি করেন, লেখালেখি করেন বা ভাইব্রেটিং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন, তাঁদের কব্জির ব্যথা বেড়ে যায়।
রোগ
যদি আপনার ডায়াবেটিস, লিউকেমিয়া, স্কে-রোডার্মা, লুপাস থাকে কিংবা থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিকমতো কাজ না করে, তা হলে আপনার কব্জির ব্যথা বেড়ে যেতে পারে।
কোন ধরনের ডাক্তার দেখাবেন
প্রাথমিকভাবে আপনার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের সঙ্গে আলাপ করুন। তিনি আপনাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, যেমন—রিউমাটোলজিস্ট, স্পোর্টস মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কিংবা অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে রেফার করতে পারেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে আপনি আপনার উপসর্গের বিস্তারিত বর্ণনা দেবেন, আপনার কোনো রোগ আছে কি না জানাবেন, আপনার বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের অন্য রোগ আছে কি না জানাবেন, আপনি কোনো ধরনের ওষুধ খেতে থাকলে তা বলবেন, কী ধরনের খাবার গ্রহণ করেন তা জানাবেন এবং চিকিৎসক যা যা জানতে চাইবেন তার সঠিক উত্তর দেবেন।
কী কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাবেন
আপনার কব্জিতে ব্যথা হলেই প্রথমত আপনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। তিনি আপনাকে প্রথমে শারীরিক পরীক্ষা করবেন। আপনি কব্জির কোথায় চাপ দিলে ব্যথা অনুভব করেন, তা পরীক্ষা করে দেখবেন। কোনো ফোলা আছে কি না, তা দেখবেন। চিকিৎসক আপনার কব্জির নাড়াচাড়ার মাত্রাটা দেখবেন। আপনি শক্ত হাতে ধরতে পারেন কি না দেখবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি আপনাকে কব্জির এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, বোন স্ক্যান ও এমআরআই করতে দিতে পারেন। যদি এসব পরীক্ষায় কোনো সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে আপনার চিকিৎসক আপনাকে আর্থ্রাস্কোপি ও নার্ভ টেস্ট করে দেখতে পারেন।
চিকিৎসা
হাতের কব্জির ব্যথার চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ভর করে ইনজুরির ধরন, স্থান ও তীব্রতা সর্বোপরি আপনার বয়স ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। প্রথমত, আক্রান্ত হাতের কব্জিকে বিশ্রামে রাখতে হবে এবং যদি কোনো নির্দিষ্ট রোগের কারণে কব্জিতে ব্যথা হয়ে থাকে, তাহলে তার উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে হবে। ব্যথানাশক ওষুধ, যেমন—আইবুপ্রফেন ও অ্যাসিটামিনোফেন কব্জির ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। প্রয়োজনে শক্তিশালী ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। হাড় ভাঙলে হাড়ের টুকরোগুলো সঠিক বিন্যাসে রাখতে হবে, যাতে ঠিকমতো জোড়া লাগে; এ ক্ষেত্রে কাস্ট বা স্পিন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
কব্জিতে টান লাগলে বা মচকে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত টেনডন বা লিগামেন্ট যাতে সুরক্ষা পায়, সে জন্য স্পিন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। আক্রান্ত হাতের কব্জিকে নড়াচড়া থেকে রক্ষা করার জন্য রিস্টব্যান্ড ব্যবহার করা যেতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হয়। যেমন—মারাত্মকভাবে হাড় ভাঙলে, কারপাল টানেল সিনড্রোমের উপসর্গ তীব্র হলে এবং টেনডন বা লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে।
একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, সব ধরনের কব্জির ব্যথায় কিন্তু মেডিকেল চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কব্জিতে সামান্য আঘাত পেলে আপনি আঘাতের স্থানে বরফ লাগালে উপকার পাবেন এবং আক্রান্ত কব্জিতে ইলাস্টিক ব্যান্ডেজ পরে থাকবেন।
হাতের কব্জির ব্যথা কীভাবে প্রতিরোধ করবেন
হাতের কব্জিতে ব্যথা ঘটায় এমন কোনো কোনো বিষয় প্রতিহত করা বেশ মুশকিল, তবে সুরক্ষার জন্য কিছু টিপস মেনে চললে উপকার পাবেন।
হাড় শক্ত করে গড়ে তুলুন
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম খান। ৫০ বছরের ওপরের মহিলারা প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার ২০০ মিলিগ্রাম অথবা বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিদিন ১০০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম খান। এতে করে হাড়ভাঙা প্রতিহত হতে পারে।
পড়ে যাওয়া ঠেকান
বেশির ভাগ কব্জির ব্যথার প্রধান কারণ হলো হাতের ওপর ভর দিয়ে সামনে পড়ে যাওয়া। পড়ে যাওয়া ঠেকাতে উপযুক্ত জুতা পরুন। ঘরের জঞ্জাল দূর করুন। ঘরদোর আলোকিত রাখুন। প্রয়োজনে বাথরুমে ধরার জন্য গ্রাব বার এবং সিঁড়িতে হ্যান্ডরেইল লাগান।
খেলাধুলা করার জন্য সুরক্ষাকর ব্যবস্থা নিন
যাঁরা উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত, যেমন—ফুটবল, স্কেটিং ইত্যাদি, তাঁরা রিস্টগার্ড পরে নেবেন।
পেশাগত ব্যাপারে সতর্ক হোন
যাঁরা দীর্ঘ সময় কিবোর্ডে কাজ করেন, তাঁরা নিয়মিত বিশ্রাম নেবেন। টাইপ করার সময় আপনার কব্জিকে রিল্যাক্স রাখবেন, নিউট্রাল পজিশনে রাখবেন। আর্গোনমিক কিবোর্ড এবং ফোম বা জেল রিস্ট সাপোর্ট ব্যবহার করুন। বারবার কাপড় মোচড়ানো, হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা কিংবা হাতের কব্জিকে বারবার ঘোরাতে হয় এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকুন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।