বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস
সিগারেট ক্ষতি করে শরীরের সব অংশের

আজ ৩১ মে। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২৪০৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী। বর্তমানে তিনি বারডেম হাসপাতালের ডেন্টাল সার্জারি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন: আজ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এই তামাকমুক্ত দিবসে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে আপনাকে সব সময় আমরা দেখেছি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত অবস্থায়। প্রথমে একটু জানতে চাইব এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় কী?
উত্তর : প্রতিপাদ্য হলো, সিগারেটের প্যাকেটজাতকরণে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়া চলবে না। অর্থাৎ সেখানে শুধু সিগারেটের ক্ষতিকারক যে বিষয়টা সেটা লিখে দিতে হবে, যে এই তামাকের কারণে ফুসফুসে ক্যানসার হয়। এভাবে বিভিন্ন প্যাকেটে বিভিন্ন ছবি যেমন হৃদরোগের ছবি দিয়ে বলতে হবে তামাকের কারণে হৃদরোগ হয়। মস্তিষ্কের ছবি দিয়ে বলতে হবে এই কারণে মস্তিষ্কের স্ট্রোক হয়। যিনি ধূমপান করেন তিনি যেন সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন, যে তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারে এই মস্তিষ্কের রোগ। গর্ভবতী নারীরা যেন দেখতে পারেন ধূমপানের কারণে অকালে গর্ভপাত হয়ে যায় বা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেয়।
মানুষকে এতদিন তো লেখা দিয়ে বোঝানো যায়নি। লেখা দেখে তারা বন্ধও করেনি। তাদের জন্য এটা খুব ভালো সংকেত হবে যে লেখাটা পড়েনি বা পড়তে জানে না। তাদের জন্য ছবিটা একটা বাস্তব প্রতিক্রিয়া হবে। মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া হবে যে এই ফুসফুসের ক্যানসার তো আমারও হতে পারে। সুতরাং সে কিন্তু একটু থামবে। এটিই কিন্তু উন্নত বিশ্বে করা হয়। এমনকি কানাডাতেও যেখানে অধিকাংশ শিক্ষিত, সেখানেও কিন্তু সিগারেটের প্যাকেটে ছবির সংকেতগুলো আছে। সিঙ্গাপুরে আছে, অস্ট্রেলিয়াতে আছে।
গবেষকরা দেখেছেন, যখনই ছবির সংকেতগুলো সিগারেটের প্যাকেটে দেওয়া হয়, তার পর থেকে কিন্তু ধূমপায়ীর সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যেটা এফটিটিসি, যেটা জেনেভায় সম্মেলন হলো, সেখানে প্রায় ২০০টি দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তামাকটা এতটাই ক্ষতিকর শরীরের জন্য যে এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে প্রতিটি দেশেই, আইনের মাধ্যমে। সে জন্য বাংলাদেশে ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হলো। বর্তমান সরকারের সময় ২০১৩ সালে সেই আইনের যে দোষত্রুটিগুলো ছিল সেগুলোকে শুধরানো হলো।
যেমন ২০০৫ সালে তামাক হিসেবে কেবল সিগারেটকে বোঝানো হতো। কিন্তু জর্দা, গুল, খৈনি, দোক্তা এগুলোও যে সাদা পাতা, এগুলোও যে ক্ষতিকর এবং সামানভাবে ক্ষতি করে এটা বলা হয়নি। ২০১৩ সালের আইনে বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে এটা এনেছেন। জর্দার কৌটাতেও কিন্তু সকর্তবাণী থাকবে। আগে তো জর্দার কৌটাতে কিছুই লেখা ছিল না। গত মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশে কিন্তু এই ছবির সতর্কতাগুলো বলবৎ হয়েছে। দেখবেন আপনি প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটি কিন্তু ছবির সতর্কতা থাকবে। স্বচিত্র সতর্কবাণীগুলো আছে। যাতে করে মানুষ এটা দেখে আস্তে আস্তে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেয় বা তামাক গ্রহণ বন্ধ করে দেয়।
প্রশ্ন : আজকের কর্মসূচি সম্বন্ধে কিছু বলুন।
উত্তর : আজকের কর্মসূচির মধ্য তো সকালবেলা বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালিত হলো বিরাটভাবে। সেমিনার হবে। আলোচনা সভা হবে এবং যাঁরা এবার পুরস্কার পাচ্ছেন তামাকবিরোধী আন্দোলনের জন্য, তাঁদের পুরস্কার দেওয়া হবে। আর ৩টার সময় আমাদের যে সংগঠন সেখান থেকে আমরা একটি অনুষ্ঠান করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায়। এরই মধ্যে কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী বিভাগগুলোকে তামাকমুক্ত করেছেন। আমরা চাচ্ছি পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধূমপানমুক্ত করতে। এই উদ্যোগটা আমরা নিয়েছি। আমরা কয়েকটি বিভাগ নিয়ে আজকের এই আলোচনা সভা করছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার হলে আমরা সভা করব।
প্রশ্ন : তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর বিষয়ে একটু বলুন।
উত্তর : খুব সুন্দরভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত বছরের আগের বছর একটা পোস্টার ছাপিয়েছে। সেই পোস্টারটি আমি প্রায়ই রোগীদের দেখাই, সেমিনারেও দেখাই। এত চমৎকার পোস্টার। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ, একটা লোকের সম্পূর্ণ দেহ। সেখানে এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যেখানে তামাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। এরপর চোখের ছানি পড়া। মুখের ভেতর মুখের ক্যানসার। গলায় গলার ক্যানসার। কানের শ্রবণশক্তি হ্রাস। এরপর বুকের একদিকে হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, এরপর হলো ফুসফুসে ক্যানসার। তারপর পুরুষের যৌনশক্তি হ্রাস। মেয়েদের অকালে গর্ভপাত। এরপর চর্মরোগ। সবশেষে পায়ের নখে পচনশীল রোগ গ্যাংরিন। এর জন্য পা কেটে ফেলতে হয়।
আমাদের বারডেম হাসপাতালে অসংখ্য ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী, যাঁরা ধূমপায়ী, তাঁরা আসেন পায়ের বিভিন্ন ধরনের ঘা নিয়ে। পরীক্ষা করে দেখা যায় তাদের গ্যাংরিন হয়েছে। আপনারা তো জানেন এটি একটি পচনশীল রোগ। সুস্থ পা পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয় যাতে পচনশীলতাটা না বাড়তে পারে। এ জন্য পা কেটে ফেলতে হয়। পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য পঙ্গু রোগী আমাদের হাসপাতালে আছে। এগুলো প্রতিটি রোগই তামাক এবং ধূমপানের কারণে হয়। এরপরও মানুষ ধূমপান করছে। এরপরও মানুষ তামাক গ্রহণ করছে। শরীরে প্রতিটি অঙ্গকে আক্রান্ত করে এই পদার্থ। এরপরও মানুষ করছে। একমাত্র তামাক, যার মধ্যে সাত হাজার রাসায়নিক পদার্থ আছে। এগুলো সবই বিষাক্ত।
আপনি মনে করেন রাস্তায় যে গাড়ির ধোঁয়া, কার্বন মনো-অক্সাইড সেটাও সিগারেটে আছে। আমরা যে মশা-মাছি মারি অ্যারোসল দিয়ে, সেটাও তামাকের মধ্যে আছে। আমরা পানি খাই না আর্সেনিকের ভয়ে। সেটাও তামাকের মধ্যে আছে। সবচেয়ে মারাত্মক যেটা সেটা হলো নিকোটিন। নিকোটিন হলো কঠিন নেশার মতো। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিকোটিন হেরোইন ও কোকেনের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এ জন্য যারা সিগারেট একবার ধরে তারা ছাড়তে পারে না। নেশায় আসক্ত করার শক্তিটা তার অনেক বেশি।
একটি গল্প আছে। একজন বলছে, ‘সিগারেট ছাড়া অনেক সহজ’। অন্যজন বলছে, ‘কেন’? উনি বলছেন, ‘আমি অনেকবার ছেড়েছি’। মানে একবার ধরলে সহজে ছাড়া যায় না। বারবার ধরতে হয়।
প্রশ্ন : প্যাসিভ স্মোকিং (পরোক্ষ ধূমপান) কতটা ক্ষতিকর?
উত্তর : মারাত্মক ক্ষতিকর। বাংলাদেশের ৩০ ভাগ নারী পাবলিক প্লেস (লোক স্থানে), আর ২০ ভাগ লোক ওয়ার্কিং প্লেস (কর্মপরিবেশে) ক্ষতিগ্রস্ত হন। শিশুরাও সমভাবে আক্রান্ত। অথচ এই শিশুরা কিন্তু ধূমপান করছে না। এই নারীরা ধূমপান করছেন না। কেবল ক্ষতিগ্রস্তই নয়, তাদেরও সমানভাবে ২০-২৫টা রোগ হয়। যেমন ফুসফুসের ক্যানসার তাদের হয়।
ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নামকরা মেডিকেল জার্নাল লেনসেটে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে নারীদের যে স্তন ক্যানসার হয়, তার মূল কারণ পুরুষের ধূমপান। অর্থাৎ যেসব ঘরে পুরুষ ধূমপায়ী আছে, সেসব ঘরে নারীরা কিন্তু শিকার হতে পারেন। শিশুরাও ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, হুপিং কফে আক্রান্ত হচ্ছে। এগুলো সবই প্যাসিভ স্মোকিংয়ে আক্রান্ত। রোগী এবং তারা সবই কিন্তু এই ২৫টি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে যে বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা কতটুকু হচ্ছে?
উত্তর : আইনের প্রয়োগটা কিছুদিন আগেও ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রে এখন কিন্তু টোবাকো কন্ট্রোল টাস্কফোর্স করা হয়েছে, ভেজালবিরোধী অভিযানের মতো। তারা কিন্তু শহরে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে। বিশেষ করে মফস্বলে। আমাদের কাছে প্রতিবেদন আসে প্রতিনিয়ত। আমি টোবাকো কন্ট্রোল টাস্কফোর্সের সদস্য। এরা বিভিন্ন মফস্বল শহরে ডিসির অধীনে বিভিন্ন জায়গাগুলোতে যাচ্ছে। যারা পাবলিক প্লেসে (লোকস্থানে) ধূমপান করে, অর্থাৎ শপিং মল, বাসস্টেশন, রেলস্টেশন, স্কুল, কলেজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেস্টুরেন্ট, আদালত ভবন-সব জায়গায় যারা ধূমপান করছে তাদের কিন্তু শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আগে ছিল ৫০ টাকা, এখন ৩০০ টাকা জরিমানা।
আর তামাক কোম্পানি যদি কোনো বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, কোনো প্যাকেটে যদি বিজ্ঞাপন দেয় তাদেরও তিন হাজার টাকা জরিমানা। এইগুলো এখন কিন্তু বলবৎ হয়েছে। এখন আপনি তো কোনো ইলেকট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়ায় তামাকের বিজ্ঞাপন দেখছেন না। এটি আমাদের একটি বিশাল সাফল্য যে আমরা আন্দোলনের কারণে করতে পেরেছি। তামাকের এখন কোনো বিজ্ঞাপন কিন্তু আপনি দেখবেন না। এখন কোনো স্পনসরও করা যায় না। তামাক কোম্পানির কোনো ধরনের খেলা বা ব্যান্ড শো বা কনসার্ট এখন স্পনসর করতে পারবে না। এটা আইনত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এগুলো সবই কিন্তু আমাদের সাফল্য।
প্রশ্ন : সবচেতন করার বিষয়গুলো কি আপনাদের কর্মসূচিতে আছে কি না যে তামাক জর্দাও সমানভাবে ক্ষতিকর?
উত্তর : অবশ্যই। পাঠ্যসূচিতে, বইতে কিন্তু তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে একটি বিভাগ বা একটা ক্ষতিকর বিষয় আছে। সেখানেও কিন্তু ছেলেমেয়েরা বই থেকে জানতে পারবে।