ডায়াবেটিস রোগ থেকে মুখে সমস্যা হলে
ডায়াবেটিস রোগটি সম্পর্কে আমাদের কম বেশি ধারণা আছে। আমাদের দেশে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক। তবে এ রোগ কি আধুনিক সভ্যতার দান? বিয়য়টি ঠিক এমন নয়। এ রোগ প্রাচীন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে ভারতবর্ষের চিকিৎসকরা এ রোগের নাম দিয়েছিলেন ‘মধুমেহ’। ক্যাপাডেসিয়ার এরোটিউস গ্রিক শব্দে এ রোগের নাম দেন ডায়াবেটিস।
মুসলমান চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবিসিনা ১০০০ সালে বহুমূত্র রোগের বিষয়ে একটি বই লিখেন, সেখানে তিনি চমৎকার ভাবে বর্ণনা দিয়েছেন এই রোগ সম্পর্কে। এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মূত্রের মিষ্ট স্বাদ। এরপর অনেক সময় পার হলেও ১৯২১ সালে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জন ফ্রেডরিক প্রান্ট বেন্টিং,অধ্যাপক কেজেআর মার্কলিওড এবং টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চার্লস হার্বাট বেষ্ট বহুমূত্রের সঙ্গে অগ্নাশয়ের সম্পর্ক অনুসন্ধান শুরু করেন এবং অগ্নাশয় কোষ নিঃসরণ নির্যাস করে হরমোন ইনসুলিন পৃথক করেন।‘ হরমোন ইনসুলিনের অভাবে এ রোগ হয়’ এ তথ্যটি তাঁদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়।
ডায়াবেটিস রোগটির সঙ্গে মুখের রোগসমূহ এখনো গবেষণার বিষয়বস্তু। এরমধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। এ রোগের কারণে মুখের ভেতরে যেসব রোগ হতে পারে তা হলো- ডেন্টাল ক্যারিজ, মাড়ির রোগ, মুখের বিভিন্ন ধরনের সাদা ঘা, দাঁতের ক্ষয়, কোষ প্রদাহ, আঁকাবাঁকা দাঁত ইত্যাদি। এসব রোগ অপুষ্টি বা বিপাকজনিত কারণেও হতে পারে। দেহের অন্যান্য রোগের লক্ষণ অনেক সময় মুখের ভেতর দেখা যায়। মুখ ও দাঁতের রোগগুলোর মধ্যে ডেন্টাল ক্যারিজ ও মাড়ির প্রদাহই পৃথিবীর সব দেশে বেশি দেখা যায়।
দেহে রক্তপ্রবাহের কাজ হচ্ছে কোষে অক্সিজেন ও অন্যান্য উপকরণ বহন করা এবং অবশিষ্ট অংশ বের করে আনা,তবে ডায়াবেটিসের কারণে রক্তপ্রবাহের নালী চিকন বা সরু হতে থাকে। ফলে দেহে রক্তের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয় এবং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। এ সময় মাড়িতে কোনো আঘাত লেগে প্রদাহ হলে সেখান থাকে রক্ত বের হতে দেখা যায়। এ ছাড়া মাড়ির রোগ থাকলে সংক্রমণ আরো বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস রোগীদের মাড়ির প্রদাহ বেশি হয় যেসব কারণে তা হলো-
১. এ রোগ দেখা দিলে দেহে ইনসুলিনের ঘাটতি হয়। এতে আমিষেরও ঘাটতি দেখা দেয়। এজন্য কোষকলার স্বাভাবিক বৃদ্ধি, সংস্কার ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই মুখে ঘা বা প্রদাহ হলে তা শুকাতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়।
২. দেহে রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যায়।
৩. দাঁতের গোড়ায় প্লাক জমে কিছুদিন পর তা শক্ত পাথরে রূপ নেয় এবং সহজেই মাড়ির প্রদাহ রোগ হয়। ডায়াবেটিক রোগীর দাঁত এ ডেন্টাল ক্যারিজ বেশি দেখা যায়। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে
ক. মুখের লালার সাথে থাকা গ্লুকোজ মুখে জীবাণুর সঙ্গে মিশে এসিড তৈরি করে। এই এসিড দাঁতের শক্ত আবরণ এনামেলকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করতে থাকে। একপর্যায়ে দাঁতের ভেতর ক্ষয় তৈরি করে।
খ.এই রোগের প্রভাবে মুখের লালার পরিমাণ কমে যায়। মুখ শুকনো থাকার কারণে আহারের অতিরিক্ত কণাগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার হয় না। মুখে লেগে থাকা অতিরিক্ত খাদ্য কণাগুলো অনেক দিন দাঁতের গোঁড়ায় বা ফাঁকে জমে থাকে। এটি মাড়ি প্রদাহ রোগের অন্যতম প্রধান কারণ।
এর প্রভাবে দাঁত দিয়ে খাদ্যদ্রব্য চিবানোর কর্মক্ষমতা কমে যায়। তাই খাবার চিবিয়ে খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। এর জন্য তাদের মুখে প্লাকের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
কী করবেন
১. সকালে নাশতা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার বা অন্যান্য সময়ে চিনি বা শর্করা জাতীয় খাদ্য যেমন চকোলেট, বিস্কুট, লজেন্স, কেক, টফি, চুইংগাম, আইসক্রিম, মন্ডা মিঠাই না খাওয়া উত্তম।
২. খাবারের পর হালকা গরম পানি ও লবণ দিয়ে কুলি করতে পারেন। এতে মুখের ভিতর লেগে থাকা খাবারের অতিরিক্ত কণা বের হয়ে যাবে।
৩. ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করতে পারেন। এতে দুই দাঁতের মাঝখানে খাবার জমবে না।
৪. দুই বেলা সকাল ও রাতে খাবারের পর দাঁত আঙুলের সাহায্যে অন্তত ২/৩ মিনিট মাড়ি ম্যাসেজ করা যেতে পারে। এতে মাড়ির ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা খাদ্যকণাগুলো বেরিয়ে আসে এবং রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে।
৫. প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
লেখক : দন্ত্য চিকিৎসক।