বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ
চল্লিশ পেরুলেই চোখের পরীক্ষা
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে গেল বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ। আট থেকে ১৪ মার্চ এ সপ্তাহ পালনের মধ্যে একটি বিশেষ দিন আবার গ্লুকোমা দিবস হিসেবেও পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশেও ছিল বিভিন্ন রকমের আয়োজন। তাই এ উপলক্ষে আমাদের বিশেষ আয়োজন গ্লুকোমা। আজ ২২ মার্চ এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৮২তম পর্বে এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন দুজন গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশ গ্লুকোমা সোসাইটির প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. এম নজরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ গ্লুকোমা সোসাইটির এক্সিকিউটিভ কমিটির সিনিয়র মেম্বার ডা. হাসান শহীদ।
প্রশ্ন : এবার গ্লুকোমা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য কী ছিল? এবং বাংলাদেশে আপনারা কী করলেন?
প্রফেসর ডা. এম নজরুল ইসলাম : বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে গেল বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহ। এবার বিশ্ব গ্লুকোমা সোসাইটির আহ্বানে এই সপ্তাহটি পালিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল বিট ইনভিজেবল গ্লুকোমা। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, অদৃশ্য গ্লুকোমাকে প্রতিহত করুন বা উপসর্গহীন গ্লুকোমাকে প্রতিহত করুন।
প্রশ্ন :বাংলাদেশে আপনারা কী করলেন?
ডা. নজরুল : বাংলাদেশে আমরা সপ্তাহজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গ্লুকোমা স্ক্রিনিং ক্যাম্প করেছি। ঢাকা শহরে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই স্ক্রিনিং হয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, যোশর, বগুড়া- এসব জায়গায় ক্যাম্প হয়েছে। গ্লুকোমা স্ক্রিনিং ক্যাম্পগুলোতে জনসাধারণ এসে চোখে গ্লুকোমা আছে কি না পরীক্ষা করেছেন।এ ছাড়া এই উপলক্ষে শোভা যাত্রা হয়েছে। মানুষকে জানানো হয়েছে এটি একটি চোখের রোগ; যেখানে সচেতন হওয়া খুব জরুরি। আলোচনা সভা হয়েছে। অনেক জায়গায় প্রেস কনফারেন্স হয়েছে।
বাংলাদেশ গ্লুকোমা সোসাইটি কয়েকদিন আগে ঢাকাতে প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করে। যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়া থেকে সাংবাদিকরা এসেছিলেন এবং জনসাধারণ এসেছিলেন। সেখানে আমরা শোভাযাত্রা করেছি। মানুষকে জানানোর জন্য আমরা আলোচনা সভা করেছি। এর উদ্দেশ্য একটাই ছিল, আমাদের দেশের মানুষকে রোগটি সম্বন্ধে সচেতন করা।
প্রশ্ন : গ্লুকোমা রোগটি কী? এবং সারা পৃথিবীতে এটাকে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করার কারণ কী?
ডা. হাসান শহীদ : চোখের চাপ বেড়ে গেলে চোখের পেছনের (স্নায়ু) নার্ভটা শুকিয়ে যায়; এই রোগ স্নায়ুকে নষ্ট করে ফেলে। নষ্ট করে ফেললে আমরা আর দেখতে পাই না। এটা ধীরে ধীরে হয়। গ্লুকোমা রোগের সমস্যা হচ্ছে একবার অন্ধ হয়ে গেলে আর ভালো করা যায় না। যেই নার্ভটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। কিন্তু আগে নির্ণয় করা গেলে আমরা স্নায়ুটাকে রক্ষা করতে পারি। যে জিনিস দেখা যায় না, অথচ ক্ষতি করে আমরা তাকে নির্ণয় করব এবং ক্ষতি করতে দেব না। এটাই ছিল মূল গ্লুকোমা সপ্তাহের এবারের মূল প্রতিপাদ্য।
প্রশ্ন : গ্লুকোমা রোগের জন্য ঝুঁকি প্রবণ দল কারা? কাদের বেশি হয়?
ডা. শহীদ : গ্লুকোমা অনেক ধরনের আছে। জন্মের পর হয়, কিশোর অবস্থায় হয়, বড় হওয়ার পর হয়। আমরা যেটা নিয়ে কাজ করছি সেটা হলো, ৪০ বছরের পরে যে গ্লুকোমা হয়। যেটাকে বলি প্রাইমারি ওপেন এঙ্গেল গ্লুকোমা। এটা হলো অদৃশ্য গ্লুকোমা। এটা হলো সবচেয়ে ক্ষতিকর। তুষের আগুনের মতো। যে উপরে দেখা যাবে না কিন্তু নিচ দিয়ে সব পুড়িয়ে ফেলবে। নীরব ঘাতক। রোগী অন্ধ হওয়ার আগে বুঝতেই পারবে না সে তার দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। কারণ সে সামনা সামনি দেখতে পাবে। কিন্তু পাশ দিয়ে দৃষ্টি চেপে যাবে।
ডা. নজরুল : যাদের পরিবারের সদস্যদের গ্লুকোমার সমস্যা রয়েছে তারা অদৃশ্য গ্লুকোমার ঝুঁকিতে আছে। আর যারা চোখে মাইনাস পাওয়ার পরে তাদের গ্লুকোমা বেশি হতে দেখা যায়। যাদের রক্তচাপ বেশি রয়েছে, যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে এ ধরনের মানুষেরও গ্লুকোমা রোগ বেশি দেখা যায়। এসব ঝুঁকি হয় অদৃশ্য গ্লুকোমার ক্ষেত্রে।
আবার কিছু গ্লুকোমা আছে যেগুলোর লক্ষণ থাকে। সেগুলোর ক্ষেত্রে ওই একই বিষয় রয়েছে। এখানেও পরিবারের মধ্যে কোনো সদস্যের থাকলে হতে পারে। আবার উপসর্গহীন গ্লুকোমা ৪০ বছর বয়সের রোগীদের বেশি হয়।
ডা. শহীদ : ৪০ বছরের বেশি বয়স যাদের তারা চিকিৎসকের কাছে যাবে এবং জেনে নেবে তার গ্লুকোমা আছে কি না। এটা খুব জরুরি। কেননা পৃথিবীতে মানুষ দুটো কারণে অন্ধ হয়। একটি ছানি অপরটি গ্লুকোমা। ছানিতে অন্ধ হলে আমরা ভয় পাই না। কারণ অস্ত্রপচার করলে পূর্ণ দৃষ্টি ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু গ্লুকোমার জন্য অন্ধ হলে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না।
প্রশ্ন : যদি আগেভাগেই ধরা পড়ে তবে এর চিকিৎসা কী? এবং এর কোনো প্রতিকারমূলক চিকিৎসা রয়েছে কী?
ডা নজরুল : গ্লুকোমাতে স্নায়ুর ক্ষতি হয়। যেকোনো স্নায়ু যদি একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা আর ঠিক হয় না। চোখেরও দৃষ্টিশক্তি আর ফিরে আসে না। এ জন্য আমাদের দেখতে হবে কত আগে থেকেই আমরা রোগটিকে নির্ণয় করতে পারি। তাহলে দৃষ্টি শক্তি কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, আমার কাছে একজন রোগী এসেছিল যার ৮০ শতাংশ স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০ শতাংশ ঠিক আছে। সেই ৮০ শতাংশ ঠিক করার জন্য কোনো চিকিৎসা নেই। যেই ২০ শতাংশ রয়েছে তার জন্য চিকিৎসা করা যাবে। কিন্তু ওই রোগী যদি আগে থেকে আসতেন তাহলে আমার সম্ভব ছিল তাকে অনেকটা ভালো করে তোলার। আগে থেকে গ্লুকোমা নির্ণয় গ্লুকোমার সর্বোচ্চ প্রতিরোধ।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে যদি বলা হয়, এ ক্ষেত্রে ওপেন এঙ্গেল এবং ক্লোজ এঙ্গেলের মধ্যে পার্থক্যটা হলো, এই ওপেন এঙ্গেল গ্লুকোমায় সাধারণত কোনো লক্ষণ থাকে না। একজন চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করবেন। চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে চোখের ড্রপ, লেজার এবং সার্জারি। আমরা যখন একটি রোগী পাই তখন প্রথমে চেষ্টা করি ওষুধের মাধ্যমে তার চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে। যদি তার একটি ওষুধে কাজ না হয় তাহলে তাঁকে কয়েকটি ওষুধ দেওয়া হয়। তাতে কাজ না হলে লেজার করা হয়। তাতে কাজ না করলে সার্জারি করে সারা জীবনের জন্য স্থায়ী একটি চিকিৎসা করা হয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে এই চিকিৎসার প্রতুলতা বা অপ্রতুলতা কতখানি? এবং এখানে লেজারের কোনো সুযোগ আছে কি না?
ডা. শহীদ : চিকিৎসা বিষয়ে যাওয়ার আগে একটি জরুরি কথা বলতে চাই, শিশুদের চোখে এলার্জির সমস্যা হলে বাজার থেকে এমনি এমনি ওষুধ কিনে দেবেন না। কারণ স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া হলে শিশুর চোখ সারাজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো ৪০ বছরের বেশি বয়সের লোক যারা আছে এবং পরিবারে যদি গ্লুকোমা থেকে থাকে তাদের চিকিৎসকের কাছে এসে পরীক্ষা করাতে হবে।
গ্লুকোমা রোগীর সঙ্গে আরেক গ্লুকোমা রোগীর বৈবাহিক সম্পর্ক না থাকাটাই ভালো। তাতে সন্তানদের ঝুঁকি বাড়ে।
আর চিকিৎসার কথা যদি বলি, বাংলাদেশে সব ধরনের চিকিৎসাই রয়েছে। সব ধরনের চিকিৎসাই বাংলাদেশে বেশ ভালোভাবে হয়।
আর যদি রোগী দরিদ্র হয়, যদি চিকিৎসা খরচ বহন করতে না পারে তবে প্রথমেই অস্ত্রপচার করে নিতে হবে।
ডা. নজরুল : যারা দরিদ্র মানুষ আছে তাদের সারাজীবনের জন্য ওষুধের খরচ বহন করা কঠিন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেকটা বিনা পয়সায় অস্ত্রপচার করা যায়। তারা যদি অস্ত্রপচার করে নেয় তাহলে সারা জীবনের জন্য গ্লুকোমার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
প্রশ্ন : আপনারা দুজনেই পরীক্ষা করানোর ওপর জোর দিচ্ছিলেন। কেননা বেশির ভাগ সময় গ্লুকোমায় আগেভাগে লক্ষণ দেখা দেয় না। কত দিন পর পর চোখের পরীক্ষা করা উচিত? আমাদের দেশের মানুষ খুব সমস্যা না হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে চায় না। এই বিষয়ে গ্লুকোমা সোসাইটি থেকে ব্যাপক কোনো পরিকল্পনা বা কর্মসূচি আছে কি না?
ডা. নজরুল : আমরা ৪০ বছরের পরে যারাই আসে না কেন প্রথমে তাদের চোখের চাপটি মাপার চেষ্টা করি। গ্লুকোমা হলে চোখের ভেতর যে অপটিক ডিস্ক ক্ষয় হয়ে যায় সেটা দেখি। যদি সন্দেহ হয় তবে দৃষ্টির পরিসীমা পরীক্ষা করি। ওসিটি পরীক্ষা করি। সুতরাং যখন একজন রোগী আমাদের কাছে আসছে আমরা কিন্তু সামান্য একটু স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে তার গ্লুকোমা আছে কি না নির্ণয় করতে পারি। যদি গ্লুকোমা রোগ ধরা পড়ে তবে প্রতি ছয় মাস পরপর আসতে হবে। আর যদি গ্লুকোমা না হয় তাহলে ৪০ বছরের পরে বছরে একবার পরীক্ষা করাতে হবে।
তবে আমাদের দেশের মানুষ সচেতন না। গ্লুকোমায় আমাদের দেশের চিকিৎসায় সব কিছু রয়েছে। কেবল একটি বিষয়ের অভাব রয়েছে। আর সেটি হলো সচেতনতা। সচেতন হলে চিকিৎসা করা সহজ হয়।
এবার বিশ্ব গ্লুকোমা সপ্তাহে বাংলাদেশ গ্লুকোমা সোসাইটির আহ্বানে বাংলাদেশের ৩০টির বেশি জায়গায় স্ক্রিনিং প্রোগাম করা হয়েছে। সেখানে কয়েক হাজার রোগী স্ক্রিনিংয়ে অংশ গ্রহণ করেছে। সেখান থেকে বেশ কয়েক শ গ্লুকোমা রোগী ধরা পড়েছে। আমরা চাই, আগামী দিনে প্রত্যেকটি চক্ষু বিশেষজ্ঞ তাঁর নিজের চেম্বারে হোক, হাসপাতালে হোক যেন এই স্ক্রিনিং নিজ উদ্যোগে করান।
প্রশ্ন : পরীক্ষা বা স্ক্রিনিংয়ের জন্য মানুষকের উদ্বুদ্ধ করতে আপনাদের পরামর্শ কী?
ডা. শহীদ : প্রথমেই সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এ ক্ষেত্রে মিডিয়া সাহায্য করতে পারে। পোস্টারিং করা যেতে পারে। স্কুলে স্ক্রিনিং টেস্ট করা যেতে পারে। সরকারের স্বাস্থ্য প্রচার বিভাগের মাধ্যমে করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি হাসপাতালে লেজার মেশিন কিনে দিয়ে সরকার সাহায্য করতে পারে।