জ্বর গুরুতর, কীভাবে বুঝবেন?
শীত শেষের এই সময়টায় অনেকেই সাধারণ সর্দি, কাশি কিংবা জ্বরে আক্রান্ত হয়। এমন হলে কী করণীয় এবং জ্বর কখন গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়- এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. এম এ সাত্তার সরকার। বর্তমানে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
আজ ৭ জানুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২২৯০তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : সাধারণ সর্দি, কাশি, জ্বর কমবেশি সবারই হয়ে থাকে। শুরুতে একটু বলেন, সাধারণ কথাটা কখন আমরা বলব? আর কখন একে জটিল মনে করব?
উত্তর : শীতকাল এবং তার পরপরই খুব সাধারণ রোগ হচ্ছে ঠান্ডা, কাশি, সর্দি, জ্বর। কারো কারো এই সময় শ্বাসকষ্ট এবং জ্বর থাকে। অনেকেই এ বিষয়ে অল্পতেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আসলে সব ঠান্ডা কাশি ও জ্বরে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই্। কিছু কিছু রোগী খুবই সাধারণ লক্ষণ নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। যেমন : নাক দিয়ে একটু পানি পড়া, সর্দি লাগা ইত্যাদি। একটু মাথাব্যথা করে; জ্বর থাকে মাঝেমধ্যে। একে আমরা সাধারণ ফ্লু হিসেবে বলি। এতে খুব উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। খুব সাধারণ চিকিৎসা দিলে তারা অল্পতে সেরে ওঠেন। প্যারাসিটামল, অ্যান্টি হিস্টামিন এ জাতীয় ওষুধ দিলেই হয়। পাশাপাশি একটু সেবাযত্ন করলে ভালো হয়ে ওঠেন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে একটু কুসুমগরম পানি, একটু গরম দুধ খাওয়ালে এরা সহজে সেরে ওঠে।
প্রশ্ন : তবে জ্বরটি জটিল কি না এটি বোঝার উপায় কী?
উত্তর : কিছু কিছু রোগী রয়েছে, যারা খারাপ লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। কোনো রোগীর যদি এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে শ্বাসকষ্ট, কাশি, ঠান্ডা, জ্বর থাকে তখন আমরা চিন্তা করব তাকে চিকিৎসকের কাছে অথবা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
কাশির সঙ্গে যদি পাকা কফ বের হয়, কারো কারো রক্ত যেতে পারে এবং কারো শ্বাসকষ্ট হতে পারে- এই রোগীগুলোর ক্ষেত্রে আমরা মনে করি অগ্রবর্তী চিকিৎসা দরকার। তাদের বেলায় ক্ষেত্র বুঝে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। এ ছাড়া বেশি শ্বাসকষ্ট হলে তাদের শ্বাসকষ্ট কমানোরও ওষুধ দিতে হতে পারে।
এদের মধ্যে একটি দলের হাঁপানি অথবা অ্যাজমার সমস্যা থাকে। অনেকের ধূমপানের ইতিহাস থাকে। সিওপিডি নামক একটি অসুখ রয়েছে। এতে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রবর্তী চিকিৎসা দিই।
অ্যান্টিবায়োটিকসহ ব্রঙ্কোডাইলেটর বলে কিছু ওষুধ রয়েছে, সেগুলো দিই। আবার কারো কারো হাসপাতালে যেতে হতে পারে। আরো খারাপ হলে কারো কারো ক্ষেত্রে ইনহেলার, নেবুলাইজেশন ব্যবহার করতে হতে পারে।
প্রশ্ন : অনেকে জ্বর দেখলে নিজে থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে নেন। আবার অনেকে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জোর করেন অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার জন্য। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
উত্তর : অনেকেই এমন করেন। আসলে ঠান্ডা, কাশি জ্বর হলে একটা সময় পর্যন্ত আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিতে চাই না। অ্যান্টিবায়োটিকের যত্রতত্র ব্যবহার রোগের প্রাকৃতিক ইতিহাসকে পরিবর্তন করে দেয়। সেই ক্ষেত্রে যাঁরা রোগী আছেন এবং রোগীর লোকজন আছেন, তাঁদের বলব, জ্বর ঠান্ডা কাশি হলেই অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। কিছুদিন প্যারাসিটামল, অ্যান্টিহিসটামিন ট্যাবলেট দিয়ে অপেক্ষা করেন। চার-পাঁচদিন দেখেন। তারপর যদি না যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন।
অথবা খুব শ্বাসকষ্ট, কাশি হচ্ছে, কফ যাচ্ছে, কারো কারো রক্ত যাচ্ছে- তাদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
খুব সাধারণ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই আমরা বুঝতে পারি, রোগীকে কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই একেক রোগীর ক্ষেত্রে একেক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। আসলে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা রোগীর জন্য ক্ষতিকর।
প্রশ্ন : এতে কী ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর : অ্যান্টিবায়োটিক যদি যত্রতত্র ব্যবহার করা হয়, পরে এই রোগী জটিল রোগের ক্ষেত্রে, যেমন, টাইফয়েডের ক্ষেত্রে বা অন্যান্য জটিল জ্বরের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক নির্বাচন করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। এই জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেসিসটেন্স হয়ে যায়। এটি এখন একটি জাতীয় সমস্যা। অনেক অ্যান্টিবায়োটিক এখন কাজ করছে না। ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন : শিশু এবং বয়স্ক লোকের বেলায় কোন অবস্থায় কাশি, ঠান্ডা হলে উচিত হবে হাসপাতালে নেওয়া?
উত্তর : আসলে এই সময় এরা বেশি আক্রান্ত হয়। এদের ক্ষেত্রে আমরা বেশি গুরুত্ব দেব। যদি একটি শিশুর ঠান্ডা কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হয়, তার যদি বুকের নিচের অংশটি দেবে যায়, খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হয়, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে আমরা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে নেব। এবং আমরা সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাব। আর যাঁরা বয়স্ক রোগী, তাঁদের ক্ষেত্রেও শ্বাসকষ্ট-জ্বর হলে এবং খুব বেশি অসুস্থ হয়ে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাব। কারণ, এই দুই দলের মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। এ জন্য আমরা তাদের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করব।
প্রশ্ন : একজন মানুষের যদি শ্বাসকষ্ট হয় অনেকেরই মনের মধ্যে একটি বিষয় কাজ করে যে আমি অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়েছি কি না। শ্বাসকষ্ট মানেই অ্যাজমা কি না। কী ধরনের শ্বাসকষ্ট হলে বোঝা যাবে এটি অ্যাজমা বা সিওপিডি? নাকি সাধারণ সর্দি কাশির কারণে হচ্ছে?
উত্তর : এখন অনেক রোগীরই সাধারণত সর্দিকাশির কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সাময়িক চিকিৎসা দিলে এটি ভালো হয়ে যাবে।
কিন্তু অ্যাজমা কাকে বলব? যদি কারো ছোটবেলা থেকে শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকে, যদি কারো অতীত ইতিহাস থাকে, পারিবারিক ইতিহাস থাকে, শীতকালে সমস্যা বেশি হয়, কিছুদিন ভালো থাকে আবার কিছুদিন শ্বাসকষ্ট হয়-তাদের অ্যাজমায় আক্রান্ত বলা যায়।
অন্যদিকে যাঁরা চল্লিশের ওপর, যাঁদের ধূমপানের ইতিহাস থাকে, কিছু পেশা সম্পর্কিত ইতিহাস থাকে। যেমন : কেউ যদি ধুলায় কাজ করে, এদের ক্ষেত্রে যে শ্বাসকষ্ট হয়; একে আমরা সিওপিডির দলে রাখতে পারি।
অ্যাজমা এবং সিওপিডি এই দুই দলেই মূলত আমাদের কাছে শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে। এবং শীতে এদের প্রকোপ এবং জটিলতা বেড়ে যায়। এই দুই দলের রোগীদের ক্ষেত্রে যদিও চিকিৎসা কাছাকাছি। তবে চিকিৎসকরাই ঠিক করবেন কাদের ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসা করবেন।
এখানে একটি জিনিস বলি, ইনহেলার কিন্তু এই রোগীদের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। অনেক রোগীরই যদিও এই বিষয়ে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।
প্রশ্ন : কী ধরনের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে?
উত্তর : আমাদের এখানে অনেকে ভাবেন ইনহেলার হলো অসুখের শেষ ওষুধ। একবার নিলে আর ছাড়া যাবে না। ইনহেলারের প্রতি নির্ভরতা তৈরি হয়ে যাবে। আসলে এটি একটি ভুল এবং ভ্রান্ত ধারণা।
রোগীরা এই বিষয়ে ভুল করছে। হাঁপানি এবং সিওপিডির ক্ষেত্রে যেই ওষুধটি রোগীকে সব সময় ভালো রাখবে, সেটি হলো ইনহেলার। এই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অন্যান্য মুখে খাওয়ার ওষুধের চেয়ে কম।
তবে আমাদের রোগীরা একে ভুল বুঝে সামাজিকভাবে অনেকটা বয়কটের মতো করে রেখেছেন। ইনহেলার হলো নিরাপদ এবং সবচেয়ে ভালো ওষুধ।
প্রশ্ন : আপনি বলবেন কি ইনহেলার নেওয়ার সঠিক পদ্ধতি কী?
উত্তর : খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এটি। সঠিকভাবে না দেওয়া হলে ইনহেলার দিলেও কাজ করবে না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসককে অবশ্যই ব্যবহারের বিষয়টি বুঝিয়ে দিতে হবে। রোগীরও উচিত হবে ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে বিষয়টি বুঝে নেওয়া। এবং সেভাবেই সব সময় নেওয়া।