মুখমণ্ডলের হাড় ভাঙলে প্রাথমিক চিকিৎসা কী

অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় বা বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মুখমণ্ডলের হাড় ভেঙে যায়। সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
আজ ৩ জানুয়ারি এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৮৬তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ডা. মতিউর রহমান মোল্লা। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরাল অ্যান্ড মেক্সিলোফেশিয়াল সার্জারি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ডেন্টাল ফেকাল্টির ডিন ছিলেন। বর্তমানে তিনি আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজের ওরাল অ্যান্ড মেক্সিলোফেশিয়াল সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : সাধারণত কী কী কারণে মুখমণ্ডলের হাড় ভাঙে?
উত্তর : এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আপনি দেখবেন যে এই দেশে ট্রাফিক পদ্ধতি বাজে হয়ে গেছে। লোক সংখ্যা বাড়ছে, গাড়ি বাড়ছে। সেই হিসাবে ট্রাফিক সিস্টেম ভালো নেই বলে প্রায়ই মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। ফেসিয়াল বোন (মুখের হাড়) যেহেতু সামনে থাকে, দুর্ঘটনা ঘটলে সহজেই ফেসিয়াল ইনজুরি হয় বা মুখে আঘাত লাগে। অর্থাৎ চোখ থেকে শুরু করে কপাল নাক, নিচের চোয়াল, ওপরের চোয়ালের হাড় ভেঙে যায়। আর যেহেতু মাথা কাছে আছে। একই সঙ্গে মাথায় আঘাত পাচ্ছে। মাথায় আঘাতের কারণে রোগী হয়তো অজ্ঞান হয়ে যায়। পেরালাইসিস হয়ে গেছে। অথবা তার জীবন সাহায্যকারী পদ্ধতিগুলো কাজ করছে না। তার হয়তো শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। হার্ট চলছে না। অথবা একই সাথে তার হাত পায়ের হাড়গুলো ভেঙে গেছে। অথবা একই সময়ে দেখা যায়, বুকে আঘাত লেগে আহত হয়ে গেছে। বুকে বাতাস ঢুকে গেছে। অথবা পেটে আহত হয়েছে। যার কারণে পেটে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। বিভিন্ন ধরনের জটিল অবস্থা হতে পারে। এই সময়ে প্রথম চিকিৎসা হলো ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট (জরুরি ব্যবস্থাপনা)।
প্রশ্ন : যখন হাড়ভাঙা নিয়ে আসছে এই ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট আপনারা কীভাবে দেন?
উত্তর : প্রথমে আমরা রোগীর অবস্থা দেখি। তার রক্তপাত কেমন হচ্ছে? রক্তপাত বেশি হয়ে কি শকে চলে যাচ্ছে ? শ্বাস-প্রশ্বাসটি ঠিক আছে কি না? তার অন্যান্য অঙ্গপ্রতঙ্গের কার্যক্রম- হার্ট, ফুসফুস ভালোমতো চলছে কি না? এগুলো হলো খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। যদি মুখের মধ্যে একটি ফরেন বডি (বাইরের জিনিস) গলায় আটকে থাকে, সে যদি অচেতন থাকে, তখন যদি সেটি তাড়াতাড়ি করে পরীক্ষার করা না হয় এবং জিহ্বাকে সামনে না ধরা হয়, রোগী কিন্তু মরে যেতে পারে।
অন্যদিকে মাথায় আঘাতে আহত হওয়ার কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হলে রোগী নিউরোসার্জনদের কাছে ভর্তি হয়। তারা সিটি স্ক্যান, এমআরআই করে দেখতে চায় কোন জায়গায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যদি বেশি সমস্যা থাকে আমরা আইসিওতে নিয়ে গিয়ে প্রথমে ভ্যান্টিলেশন সাপোর্ট দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখি। মোটামুটি স্থিতিশীল হলে আমরা মুখের দিকটা খেয়াল করি।
নাক ভেঙে গেলে দেখা যায় সামনে দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে নাকের রক্তপাত বন্ধের চিকিৎসা করা হয়।urgentPhoto
অন্যদিকে আরেকটি বিষয় হলো মুখের ওপরের এলাকায় ফ্যাকচার হলে মস্তিস্কের যেই লিকুইড (তরল) থাকে, সেটিও কিন্তু নাক দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। এটা যদি খেয়াল না করা হয় রোগীর সংক্রমণ হয়ে বিশেষ সমস্যা হতে পারে। এমনকি মরেও যেতে পারে।
প্রশ্ন : রাস্তায় এ জাতীয় দুর্ঘটনা হওয়ার পর মুখের হাড় ভেঙে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা কী হবে?
উত্তর : আহত ব্যক্তিকে বেশি নড়াচড়া করনো ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে সারভাইকাল স্পাইনে ফ্র্যাকচার থাকে। এই সময় সঙ্গে সঙ্গে তার জিহ্বাকে ধরে ফেলতে হবে, মুখ থেকে রক্ত বা ফরেন বডি বের করে ফেলতে হবে। মুখে কিছু দিয়ে সাপোর্ট দিয়ে রাখতে হবে। এমনকি খবরের কাগজ দিয়ে সাপোর্ট দিয়ে রাখতে পারলেও আহত কম হবে।
সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন দিতে হবে। চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। বেশি নড়াচড়া করে, উল্টাপাল্টা করে নিলে কিন্তু রোগীর ক্ষতি হতে পারে। এতে সে যতটুকু না ক্ষতিগ্রস্ত ছিল নড়াচড়ার কারণে আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ ছাড়া অভিজ্ঞ কেউ থাকলে হার্টে চাপ দেওয়া বা মুখ থেকে মুখে শ্বাস দেওয়া যেতে পারে। তবে আমাদের এখানে এখনো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তেমন অভিজ্ঞ লোক পাওয়া যায় না। বিদেশে দেখা যায়, সাধারণ মানুষও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়টি জানে।
প্রশ্ন : যখন জরুরি ব্যবস্থাপনা আপনাদের শেষ হয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনাটি আপনারা কখন শুরু করেন এবং সেটি কীভাবে করেন?
উত্তর : এখানে ট্রমাটিম বলে একটি কথা রয়েছে। সেখানে নিউরোসার্জন, ম্যাক্সিলো ফ্যাসিয়াল, ইএনটি, অর্থপ্যাডিক এরা থাকবে। তারা প্রথমত রোগীকে দেখব। তার গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কোনটি সেটি দেখবে। সেটা বোঝার পর প্রয়োজন হলে আইসিইউতে নেওয়া হবে। তবে এ সময় দেরি করলে কিন্তু সমস্যা। আমি যেমন মডার্ন এবং অ্যাপোলোতে কাজ করি। সেখানে আমাদের একটি দল থাকে। একই দিনে একই সিটিংয়ে নিউরোসার্জন রক্তকে বের করছে মস্তিষ্ক থেকে এবং চোয়ালকে ঠিক করা হচ্ছে। অথবা ইএনটি বিশেষজ্ঞ হয়তো নাকে কিছু করছে। এসব জিনিস যদি একই দিনে একসঙ্গে মিলে করে ফেলতে পারি, তখন ঝুঁকি ছাড়া রোগীর অনেক কিছু করা সম্ভব। তবে সাধারণ ক্ষেত্রে উপরের চোয়াল নিচের চোয়াল এগুলোর ক্ষেত্রে স্থিতিশীল হয়ে গেলে তখন সিটি স্ক্যান করব, এমআরআই করব, দেখে নেব, বুঝব; এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী চিকিৎসা করব।
এখন কিন্তু আগেকার দিনের মতো তার দিয়ে দাঁত বেঁধে রাখতে হয় না। অস্ত্রোপচারের পরের দিন মুখ খোলা থাকবে। সে মুখ দিয়ে খেতে পারবে। দুদিন পরই রোগী বাসায় যেতে পারবে। এই পদ্ধতিটি যদি গ্রামেগঞ্জে করতে পারি রোগীদের অনেক সুবিধা হবে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন সাধারণত ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন ছাড়া এটি পারবে না। সেই ক্ষেত্রে যদি দক্ষ না হয় কী কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : একজন সার্জন দাঁত সম্পর্কে না বুঝলে হবে না। কেবল হাড়কে ফুটো করে প্লেট বসালে তো হচ্ছে না। আমাকে উপরের দাঁতের সাথে বিষয়টিকে মিলিয়ে দিতে হবে। নয়তো পরে সে খেতে পারবে না। পরের দিকে জয়েন্টে ব্যথা হবে। বাড়তি চাপ পড়বে। সেজন্য আমি বলব মেক্সিলোফেসিয়ালই সঠিক চিকিৎসক ফেসিয়াল ট্রমার ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন : শিশুদের ক্ষেত্রে মুখমণ্ডলের হাড় ভেঙে গেলে কি আলাদা কোনো সমস্যা হয়?
উত্তর : শিশুদের চোয়াল যদি বেশি আহত হয়, তাহলে বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। এখানে রোগীকে প্লাস্টিকের ডিভাইস বসিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এতে দুই সপ্তাহের মধ্যে সঠিক জায়গায় চলে আসবে।