কিডনির ক্ষতি করতে পারে ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস বেশি মাত্রায় বেড়ে গেলে সেটি কিডনিতে প্রভাব ফেলে। যেটি কিডনি ক্ষতির একটি বড় কারণ হতে পারে। ১০ ডিসেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২৩১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ।
urgentPhoto
প্রশ্ন : ডায়াবেটিস থেকে কিডনির কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : আমাদের যে কিডনির রোগ, আজকাল দেখা যাচ্ছে ডায়াবেটিস এপিডিমিক ফর্মে আমাদের মধ্যে দেখা যায়। শুধু আমাদের কেন, বিশ্বের সব দেশেই দেখা যাচ্ছে। যখন ক্রনিক কিডনির রোগ আমরা বলি, কিডনি অকেজো হয়ে যায়, সেটার প্রথম কারণ এখন আমরা ধরে নিচ্ছি ডায়াবেটিস। এখন এই ডায়াবেটিস যে শুধু কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সেটি নয়। কিডনিতে যখন প্রভাব ফেলবে তখন চোখেও করবে, হার্টেও করবে, বিভিন্ন অঙ্গেও প্রভাব ফেলবে। আমরা এই ডায়াবেটিসকে অনেকাংশে প্রতিরোধ করতে পারি। এবং এটির একটি স্বাভাবিক ইতিহাস রয়েছে। একে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়। এই প্রথম স্তরে যদি আমরা ধরতে পারি। তাহলে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম স্তর যাকে এসডিএস রেনাল ফেইলিউর বলি, সেই স্তর থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি অথবা এটাকে আমরা দেরি করিয়ে দিতে পারি। অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ বছরে যে কিডনিটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটি হয়তো ৩০ থেকে ৪০ বছর পর হবে। এর মানে পুরো প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দিতে পারি। সে জন্য ডায়াবেটিসজনিত কারণে কিডনি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না, সেটা আমার জানতে হবে। প্রথমে যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে ওষুধ খাই, তবে ডায়াবেটিসের একটি স্বাভাবিক ইতিহাস যেটি দেখা যায়, ডায়াবেটিসজনিত সমস্যা চার পাঁচ বছর থাকবে এরপর এটি কিডনিকে আক্রান্ত করবে।
প্রশ্ন : যখন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত একজন রোগীর কিডনিতে প্রভাব পড়ছে তখন কি কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়?
উত্তর : লক্ষণ না-ও থাকতে পারে। এমনকি কিডনি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো লক্ষণ না-ও থাকতে পারে। তবে আপনি যদি জানেন আপনার ডায়াবেটিস রয়েছে, তাহলে আপনি দু-তিনটি পরীক্ষা করাতে পারেন। এ সময় আপনি রক্তে শর্করা পরীক্ষা করতে পারেন। আর দেখতে পারেন প্রস্রাবে প্রোটিন বেরিয়ে যাচ্ছে কি না। প্রোটিনের একটি ভাগ হলো অ্যালবুমিন। এই মাইক্রো-অ্যালবুমিন যখন যাবে, তখনই ধরতে হবে ডায়াবেটিসের তৃতীয় পর্যায়। সেটা কীভাবে করা যায়? একটি বিশেষ পরীক্ষা রয়েছে, সেটি করলে বোঝা যাবে। এই পর্যায়ে যাওয়া মানে কিডনিটি ঝুঁকিপূর্ণ। এই কিডনিটি ক্রনিক রেনাল ফেইলিউরের দিকে যাচ্ছে। কীভাবে বুঝব? অ্যালবুমিন যাবে এবং রক্তের চাপ বেড়ে যাবে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ডায়াবেটিস যাদের থাকে, তাদের ফিল্টেশন বেড়ে যায়। কারণ ডায়াবেটিসে কিডনি বড় হয়ে যায়। যখন তৃতীয় পর্যায়ে থাকবে তখন কিডনি ফাংশন আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। এই পর্যায়ে রক্তের শর্করা সঠিকভাবে রাখতে হবে। পাশাপাশি উচ্চরক্তচাপ থাকলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আরেকটি হচ্ছে প্রোটিন লিকটা বন্ধ করতে হবে। এই তিনটি জিনিস করলে এটা দেরিতে হবে।
যাদের এই প্রোটিন লিক হচ্ছে, উচ্চ রক্তচাপ হচ্ছে তাদের আরো একটি জিনিস হয়, তাদের রক্তের চর্বি বেড়ে যাবে। তখন সেই প্রোটিনকে কমিয়ে রাখতে হবে। প্রোটিনটা অনেক সময় আমরা বুঝি না। একটি হলো লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, একটি হাই ডেনসিটি, একটি ট্রাইগ্লিসারাইড, একটি টোলাল কোলেস্টেরল। এর ভেতরে ট্রাইগ্লিসারাইড যেটা, সেটা অনেক বেশি হয় এবং এটি অনেকটা আমাদের ভাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা যারা ভাত বেশি খাই, তাদের টিজি বেশি থাকে। আর সবচেয়ে খারাপ হলো লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল। সেটা খারাপ কেন? সেটা হার্টের ভেতর জমা হয়ে করনারি হার্টের রোগ তৈরি করে। তাই এই জিনিসগুলো আমাদের জানতে হবে। কেন জানতে হবে? ওই জিনিসটি আমাদের সহনীয় মাত্রায় বা যেই মাত্রায় থাকা উচিত, সেই মাত্রায় আমাদের থাকতে হবে। তাহলে ডায়াবেটিস শুরু হয়ে গেলে, শুরু হয়ে গেল উচ্চ রক্তচাপ, শুরু হয়ে গেল প্রোটিন লিক, তারপর হলো কোলেস্টেরল, এরপর হার্টে এবং চোখে সমস্যা। এই যে কোলেস্টেরলের অস্বাভাবিকতা থাকে, প্রোটিন যদি বেশি মাত্রায় লিক হয়, দেখবেন শরীরে পানি এসে যায়। পানি কেন আসে? কারণ প্রোটিন লিক হচ্ছে এবং রক্তে অ্যালবুমিন কমে যাচ্ছে। অ্যালবুমিন কমে গেলে রক্তের ভেতর পানি ধরে রাখতে পারে না। সেই পানি শিরা উপশিরাতে ছড়িয়ে গিয়ে টিস্যুর ভেতর ছড়িয়ে যায়। রোগীর শরীর তখন ফুলে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ডায়াবেটিস নেফ্রোপ্যাথি আমরা বলি অথবা রেনাল ফেইলিউর তাদের পানিটা কমানো খুব জটিল। সে জন্য আমি বলি ডায়াবেটিস যদি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করতে পারেন এবং তিনটি পর্যায় আমি বললাম, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ, আর যদি প্রোটিন লিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এগুলো ঠিক রাখলে কোলেস্টেরল কমে যাবে। কারণ প্রোটিন যখন কমে যায়, তখন লিভারে চর্বিগুলো কমতে থাকে। একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কিত।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে যখন এই জাতীয় জটিলতা নিয়ে আসে তখন আপনারা কীভাবে ব্যবস্থা নেন?
উত্তর : দেখেন ওই একই কথা আবার বলতে চাই প্রথমে তিনটি বিষয় ঠিক রাখতে হবে। আপনার রক্তের শর্করা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করেন। সেটি করবেন ওষুধের মাধ্যমে। কিডনির যদি সমস্যা থাকে, মুখের যেই ওষুধ যেমন আমি বলি, যদি শুধু ডায়াবেটিস থাকে মেটফরমিন খুব ভালো ওষুধ। তবে যদি কিডনি কাজ কম করে, তখন মেটফরমিন দেওয়া উচিত নয়। সেই ক্ষেত্রে অন্য যে ওষুধগুলো আছে সেগুলো দিয়ে দেখতে পারি। এখন একটি নতুন ওষুধ এসেছে, কিডনির যেকোনো অবস্থায় দেওয়া যেতে পারে। একে বলে ডিপিপিফো ইলিমিটার। এটি বাজারে অনেক নামে আছে। এটি অনেক ভালো কাজ করে। তার সঙ্গে যদি না নিয়ন্ত্রণ হয় ইনসুলিন এবং এটা দেওয়া হয়। তাহলে ওষুধগুলো সঠিক মাত্রায় দিতে হবে। যদি কিডনির সমস্যা থাকে, কিছু ওষুধের মাত্রা কমিয়ে দিতে হবে। এবং ইনসুলিন এখানে ব্যবহার করতে পারেন।
প্রশ্ন : আরেকটি অভিযোগ রোগীদের থাকে বছরের পর বছর ইনসুলিন নিচ্ছি তবুও কেন রোগটি নিয়ন্ত্রণে থাকছে না?
উত্তর : ইনসুলিন যদি শরীরে কাজ না করে, শরীরের ভেতর যদি ব্লাডসুগার না ঢুকতে পারে, তাহলে ইনসুলিন কাজ করে না। সে জন্য যেটি বলে ডায়াবেটিস রোগীর প্রথম বিষয় হলো হাঁটা। না হাঁটলে ডায়াবেটিস হলে মোটা হয়ে যাচ্ছে, শরীরে পানি চলে আসছে, বয়স বেড়ে যাচ্ছে, গিরায় ব্যথা হচ্ছে এবং রোগীরা ঘরে বসে থাকছে। তখন আরো বেশি হাঁটতে পারছে না। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, ওষুধ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি হাঁটেন, তাহলে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এবং তারা ফিট থাকেন। না হাঁটলে ইনসুলিনের রেজিসটেন্স বৃদ্ধি পাচ্ছে, ওষুধেও কাজ করছে না, রক্তের শর্করা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। শরীরের সব জায়গায় অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।