নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কখন দরকার?
নির্দিষ্ট সময়ের আগে সেসব শিশু জন্ম নেয় তাদের এনআইসিইউ বা নিউনেটাল আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়। আজ ২১ নভেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২১২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক অ্যান্ড নিউনেটাল আইসিইউ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাসিম জাহান।
urgentPhoto
প্রশ্ন : এনআইসিইউ বা নিউনেটাল আইসিইউ বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : এনআইসিইউ বলতে বোঝায় নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র। যেসব শিশু সময়ের আগে জন্ম নেয় অথবা খুব অসুস্থ শিশু তাদের বিশেষ যত্ন দেওয়ার জন্য হাসপাতালের যে এলাকাটা সেটার নাম হচ্ছে নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র। এখানে সাধারণত প্রিমেচিউর (অপরিপক্ব শিশু) শিশুদের রাখা হয়। আগে বলে নেই অপরিপক্ক শিশু কী? সাধারণত মায়ের গর্ভে থাকাকালীন ৪০ সপ্তাহে একটি শিশুর জন্ম হবে। তারা যদি ৩৭ সপ্তাহের আগে চলে আসে একে আমরা অপরিপক্ব শিশু বলি। সাধারণ জন্মের ওজন হচ্ছে আড়াই থেকে চার কেজি পর্যন্ত। আড়াই কেজির নিচে যেসব শিশুর জন্ম হয়, তাদের আমরা লো বার্থ ওয়েট বেবি ( কম ওজনের শিশু বলি)। এরা খুব উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ শিশু। এদের বিশেষ যত্ন লাগে। এদের আমরা নিউনেটাল আইসিইউতে চিকিৎসা দিই।
প্রশ্ন : নবজাতকের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। এই বিশেষ যত্নের আওতায় কী কী পড়ে?
উত্তর : টার্ম বেবি এবং প্রিটার্ম বেবি; দুই ধরনের শিশু একেকজন একেক ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে। মায়ের গর্ভে শিশুরা দেখা যায় একটি সুরক্ষিত পরিবেশে আছে। তাদের তখন খাবার নেওয়া বলেন বা শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া বলেন, বা প্রস্রাব-পায়খানা করার বিষয়টি সম্পূর্ণ মায়ের ওপর নির্ভরশীল। তারা যখন এই সুরক্ষিত পরিবেশ থেকে পৃথিবীতে চলে আসে, তখন নিজের ওপর তাদের নির্ভরশীল ভূমিকা পালন করতে হয়। তখন একটি ট্রানজিশন হয়। এই সময় শিশু প্রথম কাঁদবে। কান্না করে শ্বাস নেবে। শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের অক্সিজেন যাবে। সম্পূর্ণ শরীরে সে অক্সিজেন ছড়িয়ে যাবে এবং সে ভালো থাকবে। সেটা হচ্ছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় কোনো শিশুর এই পদ্ধতির মধ্যে কোনো সমস্যা তৈরি হয়, সাধারণত টার্ম শিশু বা প্রিটার্ম শিশুদের এই সমস্যা হতে পারে। সমস্যা হলে দেখা যেতে পারে, প্রথমে সে হয়তো কাঁদবে না। এরপর তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে। তখন তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থানান্তর করে চিকিৎসা দিতে হবে। অনেক সময় তাদের লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া আরো কিছু শিশু রয়েছে, যেমন অপরিপক্ব শিশু যারা, বিশেষ করে ৩৪ সপ্তাহের নিচে, তাদের খাবার মুখে নিয়ে যে পেটে পাঠাবে সেই বিষয়টি ভালো থাকে না। তখন দেখা যায় খেতে গিয়ে খাবার ফুসফুসে চলে যায়। তাই ৩৪ সপ্তাহের নিচে যেকোনো শিশুকে আমরা এনআইসিইউতে বদলি করি। এ ছাড়া ওজনের দিক থেকে এক কেজি ৮০০ গ্রামের নিচের শিশুদের এনআইসিউতে পাঠাতে হবে। এ ছাড়া যেকোনো অসুস্থ শিশু যেমন হয়তো শ্বাসকষ্ট নিয়ে এলো, তারপর কোনো কোনো সময় দেখা যায় মিকোনিয়াম যে মায়ের শরীরে থাকতে পাস করবে না। প্রসব হওয়ার পরই করবে। কোনো কোনো জটিল প্রসবে দেখা যায় মিকোনিয়াম পাস করে দিচ্ছে। সেটা সে খেয়ে ফেলছে এবং সেটা ফুসফুসে চলে যাচ্ছে। এই অবস্থাটি খুবই জটিল। এদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রেখে অনেক সময় লাইফ সাপোর্টে রাখতে হয়। কারণ ফুসফুস পুরো স্পঞ্জের মতো একটি জিনিস। শিশুদের সারফেকটেন্স বিষয়টি তৈরি হয় ৩৪ সপ্তাহ পরে। তাহলে ৩৪ সপ্তাহের আগে সেসব শিশু হয়ে যাবে, সেসব শিশুর এই জটিলতা হতে পারে। এই ধরনের অবস্থার নাম আরডিএস। তাদেরও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখতে হবে।
প্রশ্ন : কিছু কিছু শিশুর দেখা যায় মিকোনিয়াম কাজ করে না। তাদেরও কি আপনার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখেন?
উত্তর : শিশুর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পায়খানা হতে হবে। যদি না করে তাহলে মনে করতে হবে সার্জিক্যাল কোনো সমস্যা আছে। তার পায়খানার রাস্তাটি হয়তো ঠিকভাবে তৈরি হয়নি। অথবা তার খাদ্যনালিতে কোনো সমস্যা আছে, যার কারণে মলটা বের হয়ে আসতে পারছে না। এদের অবশ্যই এনআইসিইউতে ভর্তি করা লাগবে।
প্রশ্ন : টার্ম বেবি বা প্রি টার্ম বেবি এদের ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : টার্ম বেবিদের সমস্যার মধ্যে শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসতে পারে। এরপর প্রসবের পর জীবাণুর সংক্রমণ নিয়ে আসতে পারে। অথবা কয়েকদিন পরেও চলে আসতে পারে। যেকোনো শিশুর শ্বাসকষ্ট হলেও আমাদের ভর্তি করা লাগবে। এ ছাড়া মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে বা ক্রনিক কোনো রোগ থাকে, যেমন হার্টের রোগ থাকে, মায়ের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে অথবা মায়ের রক্তপাত হচ্ছে, সেই শিশুগুলোর উচ্চ ঝুঁকি থাকে। এদেরও দেখা যায় এনআইসিইউতে ভর্তি করা লাগে।
প্রশ্ন : নবজাতককে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার বিষয়টি কিসের ওপর নির্ভর করে?
উত্তর : এখন টেকনোলজির অগ্রগতির কারণে অনেক প্রি মেচিওর শিশু টিকে যায়। আগে যেমন ৩৭ সপ্তাহের নিচেই বলা হতো এবোরশন হয়ে যাচ্ছে। তবে এখন ২৪ সপ্তাহের শিশুরাও টিকে যাচ্ছে। আমি যে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে কাজ করি সেখানে ২৪ সপ্তাহের শিশুরা আসে। অনেক মায়েরা অস্থির হয়ে যায় যে তাদের কখন ছাড়ব। আমি আগেই বলেছি ৩৪ সপ্তাহ হওয়ার আগে শিশুর চুষে খাওয়া বিষয়টি ভালোভাবে তৈরি হয় না। ২৪ সপ্তাহের শিশুগুলোকে আমাদের যে কোনোভাবে ওই পর্যন্ত রাখতেই হবে। এটা এ রকম বিষয় নয় যে ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত চিকিৎসা দিলাম, শিশুটি বাসায় চলে যাবে। তাহলে হবে না। তাহলে এতদিন যে কষ্টটা করলাম সেটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যাবে। সে জন্য সময় পূর্ণ করে তাকে থাকতে হবে। কারণ বৃদ্ধির ব্যাপারগুলো, পরিপক্ব হওয়ার বিষয়গুলো তো আগে মায়ের পেটে হওয়ার কথা সেটা বাইরে পেতে হচ্ছে। সে জন্য যতক্ষণ না পর্যন্ত এটি পাওয়া যাবে সেটি করতে হবে।
আবার যারা টার্ম বেবি তাদেরও সাত থেকে ১০ দিনের একটি সময় লাগবে। কিছুক্ষণ যে কাঁদেনি এ জন্য তার গাঁটে অক্সিজেন পায়নি। খাদ্যনালিতে এসিড জমে যায়। বাইরে যেমন এসিড লাগলে পুড়ে যায়, সেখানেও এ রকম একটি বিষয় ঘটে। তাদের খাবার দিতে একটু দেরি হয়।
অনেকে বলেন, বাচ্চাকে তো মায়ের দুধ দিচ্ছেন না তাহলে কীভাবে সে ভালো থাকবে। সেই মায়েদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, যদি শিশুদের খাবার দিয়ে তার ক্ষতি হয়, সেটা আমি করব না। যদি আমি খাবার দিই তার পেট তো ফুলে যাবে। তার পেটে পচন জাতীয় অসুস্থতা হতে পারে।
প্রশ্ন : এনআইসিওতে এক ধরনের সংক্রমণ তৈরি হতে পারে। সেটি কাদের ক্ষেত্রে এবং এটি কেন হয়?
উত্তর : টার্ম, প্রিটার্ম সবার জন্যই ইনফেকশনের বিষয়টি হতে পারে। একটি সংক্রমণ সে জন্মের পর নিয়ে আসতে পারে। আরেকটি সংক্রমণ হাসপাতালে থাকাকালীন নিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে প্রিমেচিওর শিশুরা এই ক্ষেত্রে বেশি অস্থিতিশীল। তাদের শেষের দিকে মায়ের শরীর থেকে সুরক্ষা দেওয়ার অ্যান্টিবডি শরীরে আসে। সেই সুরক্ষা দেওয়ার অ্যান্টিবডি না নিয়ে চলে আসছে। কাজেই সে অস্থিতিশীল। তাই যেকোনো সময় তার রোগজীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে। আমরা যতই সুরক্ষা নেই না কেন। এই সংক্রমণ যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি আমাদের ঝুঁকির হার অনেক কমে যায়।
আমরা যেটা এনআইসিইউতে চেষ্টা করি, গ্লাভস পরা, গাউন পরা, মাস্ক পরা- এগুলো অবশ্যই করতে হয়। সব সময় হাত ধোয়া। একটি সংক্রমিত শিশু যদি পাই, তাকে আলাদা করে দিই। সে যখন ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায় সেই ইনকিবিউটর আমরা পরিষ্কার করি।
প্রশ্ন : নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র থেকে যখন শিশুটিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তখন শিশুটিকে বাবা-মায়ের কী ধরনের যত্ন নিতে হয়। এবং কতদিন নিতে হয়?
উত্তর : ফলোআপে আমরা কিছু কিছু পরামর্শ দিই। যেমন অপরিপক্ব শিশুর ওজন যদি কম হয়, ৩৪ সপ্তাহে ১৪শ থেকে ১৫শ গ্রাম হলে আমরা তাকে বাড়ি পাঠাই। তারপরও সে অপরিপক্ব থেকে যাবে। এরপরও সে যেহেতু খেতে পারবে এবং তাপমাত্রা সামলাতে পারবে তাই মাকে বলি কাপড় দিয়ে তাকে জড়িয়ে রাখতে।
এরপর কতটুকু কাপড়ে তাকে জড়িয়ে রাখব? সে বিষয়ে আমরা বলি যদি গরম আবহাওয়া হয় মা যদি একটি কাপড় পড়ে, মনে করে তার ঠান্ডা লাগছে না, তাহলে ধরে নিতে হবে শিশুরও ঠান্ডা লাগছে না। মা যে কয়টা ধাপে কাপড় পরবে শিশুকেও সেই একই ধাপে কাপড় দিতে হবে।
এরপর আসি সংক্রমণের বিষয়টি নিয়ে। মাকে বলতে হবে হাত ধুতে হবে। এবং শিশুকে তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবে। পাশাপাশি যদি কেউ দেখতে আসে, তার হয়তো ফ্লু রয়েছে, তখন বলতে হবে মাস্ক পরে নেওয়ার জন্য। প্রিমেচিওর শিশুদের চোখের একটি সমস্যা হয়। রেটিনোপ্যাথি প্রিমেচিওর বলি, কোনো শিশু যদি ৩২ সপ্তাহের নিচে এবং ১৫ শ গ্রামের নিচে হয় তখন তার চোখ পরীক্ষা করাতে হবে। এটা হাসপাতালে ভর্তির সময়ও করা যায়। অথবা পরবর্তীকালেও করা যায়। তবে এটি একটু খেয়াল রাখলেই সুবিধা।
প্রশ্ন : কী দেখে বোঝা যাবে চোখে সমস্যা হচ্ছে?
উত্তর : চিকিৎসকের কাছে নিয়ে সব অপরিপক্ব শিশুকেই চোখ পরীক্ষা করাতে হবে।