গর্ভধারণের আগে চেকআপ কেন জরুরি?
একটি সুন্দর শিশু এবং সুস্থ মায়ের জন্য গর্ভকালীন পরিচর্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আজ ১৬ নভেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২০৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি এবং ধাত্রী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. উৎপলা মজুমদার।
প্রশ্ন : গর্ভকালীন পরিচর্যা বা এন্টিনেটাল কেয়ারের মধ্যে আসলে কোন কোন বিষয়গুলো পড়ে?
উত্তর : একজন মা যখন সন্তান ধারণ করেন, তখন সেই মা ও তাঁর পুরো পরিবারের স্বপ্ন থাকে একটি সুস্থ ও সুন্দর শিশু। তাই এই সুস্থ এবং সুন্দর শিশু জন্ম দিতে গেলে গর্ভকালীন পরিচর্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয় শুধু গর্ভকালীন নয়, গর্ভধারণের আগেও চেকআপ করা জরুরি। একজন মা যখন সিদ্ধান্ত নেবেন যে তিনি সন্তান নেবেন, সেই ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্ন : গর্ভধারণের আগে চেকআপ কেন দরকার? এর প্রয়োজনীয়তা কী?
উত্তর : কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা হয়তো দেখি মা কোনো ওষুধ খাচ্ছেন, যেটি গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতির হতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আমরা মাকে অবশ্যই সেই ওষুধটি পরিবর্তন করে কোনো নিরাপদ ওষুধ খাওয়ার জন্য চিকিৎসাপত্রে পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ ছাড়া মা হয়তো কোনো রোগে ভুগছেন, যেখানে সন্তান ধারণ করলে অবস্থা আরো খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। এটি মায়ের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মায়ের যদি কোনো রোগ থাকে অবশ্যই তিনি সেটি সারিয়ে নেবেন। এসব কারণে গর্ভধারণের আগে চেকআপ জরুরি।
প্রশ্ন : এটি ছাড়া গর্ভকালীন পরিচর্যার ভেতরে আর কোন কোন বিষয় পড়ে?
উত্তর : গর্ভকালীন পরিচর্যায় প্রথমে মায়ের খাবারের বিষয়টি পড়ে। প্রথম তিন মাস মায়ের প্রচণ্ড বমিভাব থাকে। বমি বমি ভাব থাকার কারণে মা হয়তো খেতে পারেন না। ওই সময় আমরা মাকে বলব যেটা খেলে ভালো লাগে সেটাই যেন তিনি খান।urgentPhoto
প্রশ্ন : পুরো গর্ভাবস্থাজুড়ে যাঁদের বমি ভাব থাকে, তাঁদের জন্য পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : সাধারণত প্রথম তিন মাস হরমোনাল কারণে বমিভাব বেশি থাকে। পরবর্তীকালে হয়তো অতটা থাকে না। এই ক্ষেত্রে আমরা মাকে বুঝিয়ে বললেই হয়তো তিনি বোঝেন এটা তাঁর স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তাই প্রথম তিন মাস আমরা হয়তো তাঁকে কিছু নিরাপদ বমির ওষুধ দিয়ে থাকি। সে ক্ষেত্রে কিছুটা হয়তো আমরা কমাতে পারি। পরবর্তীকালে বমিটা কমে আসে। সেটা তখন বেশি হয় না। মাঝে মাঝে হয়তো এসিডিটির জন্য হয়। সেটা কিছু ওষুধ খেলে হয়তো ঠিক হয়ে যায়।
প্রশ্ন : অনেক সময় শিশু যেন ছোট হয় এ জন্য মাকে বয়োবৃদ্ধরা হয়তো খেতে কম দেন। এই ধারণার যুক্তি কতটুকু?
উত্তর : গর্ভের শিশুর বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই বাড়তি খাবার দরকার। শিশুর বৃদ্ধির জন্য সহজে হজম হয় এমন খাবার মাকে দিতে হবে। আমরা সচরাচর বলি তিনি যা খেতেন তার থেকে একমুঠো চাল পরিমাণ ভাত তিনি বেশি খাবেন। এই সময়ে প্রোটিনের একটি চাহিদা বেড়ে যায়। মাছ, মাংস খাবেন। ডাল খাবেন এক বাটি করে। এরপর প্রতিদিন আধা লিটার করে দুধ খাওয়ার কথা আমরা বলি। আরেকটি বিষয় হলো এই সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্য অনেক বেড়ে যায়। তাই প্রচুর পরিমাণে সবজি আমরা খেতে বলি। বমির কারণে যেন পানিশূন্যতা না হয়ে যায় মায়ের, সে জন্য প্রচুর পানি খেতে বলি, বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে। এটা মা অবশ্যই পালন করবেন।
প্রশ্ন : অনেক সময় জ্বর, ব্যথা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে মায়ের ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মা কীভাবে সেই ওষুধ খাবে- এ ক্ষেত্রে আপনারা কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : প্রথম তিন মাস আমরা একটু ওষুধের বিষয়ে সতর্ক করে দিই। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া তিনি যেন ওষুধ না খান। তিন মাসের পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যেকোনো নিরাপদ ওষুধ উনি খেতে পারেন।
প্রশ্ন : অ্যান্টি নেটাল চেকআপ বলে একটি শব্দ রয়েছে। সেটি আসলে কী? এবং কখন এটির প্রয়োজন পড়ে?
উত্তর : গর্ভকালীন পরিচর্যা বা অ্যান্টিনেটাল চেকআপের যেই পরামর্শ আমরা রোগীকে দিই, অন্তত চারবার তিনি আমাদের কাছে আসবেন। এ ছাড়া স্বাভাবিক যাঁরা আসতে পারছেন, তাঁরা প্রথম তিন মাসের মধ্যে একবার আসবেন। এরপর ২৮ সপ্তাহ পর তিনি আসবেন প্রতি মাসে একবার করে। এরপর ৩২ সপ্তাহ পর্যন্ত উনি মাসে দুবার করে এবং প্রসবের আগ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে চিকিৎসকের কাছে আসবেন।
প্রশ্ন : সব মায়েদের শরীর তো সমান নয়। এই ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের আওতার মধ্যে কারা কারা পড়ে?
উত্তর : দেখা যায় যাদের একটু বয়স বেশি, তারা ঝুঁকিপূর্ণ একটি দল। এ ছাড়া যাদের মারাত্মক রক্তশূন্যতা রয়েছে, কারো ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস বা হার্টের অসুখ থাকে অথবা হরমোনাল কোনো সমস্যা যদি থাকে। যেমন : থাইরয়েড হরমোনের যদি ঘাটতি বা আধিক্য থাকে এই গর্ভধারণগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া যদি জমজ বাচ্চা হয় সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। এরপর রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ মায়েদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভধারণ হয়। এরপর যাদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের সময় রক্তপাতের ইতিহাস থাকে- এগুলো আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা।
প্রশ্ন : অ্যান্টিনেটাল চেকআপে আপনারা কী দেখেন?
উত্তর : মা আমাদের কাছে যখন আসেন, আমরা প্রথমেই তাঁকে জিজ্ঞেস করি, তিনি কেমন আছেন বা তাঁর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। এরপর নিয়মিত মায়ের ওজন ঠিকমতো করছে কি না। রক্তশূন্যতা হচ্ছে কি না, তার রক্তচাপ ঠিক আছে কি না, বাচ্চার বৃদ্ধিটা কেমন হচ্ছে, যে পানির ভেতরে সে থাকে সেটি ঠিক আছে কি না। তার হার্ট রেট ঠিক আছে কি না। আর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমরা করি। করে দেখি মা এবং বাচ্চা কোনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে আছে কি না। যেমন ব্লাড গ্রুপ করি, রক্তে শর্করা দেখি। রক্তশূন্যতা আছে কি না। হরমোনাল কোনো সমস্যা আছে কি না এগুলো চেকআপ করে নিয়মিত দেখা হয়।
প্রশ্ন : একধরনের ডায়াবেটিস আছে যা গর্ভাবস্থায় হয়। এর জন্য আপনাদের পরামর্শ কী থাকে? আর এই রকম আরো কোনো রোগ কেবল গর্ভাবস্থায় হতে পারে কি না? হলে আপনাদের পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস খুবই প্রচলিত। কিছু ডায়াবেটিস আছে যাকে আমরা জেসটেশনাল ডায়াবেটিস বলি। এটা শুধুমাত্র গর্ভাবস্থায় আসে। সেই ক্ষেত্রে মা যদি নিয়মিত চিকিৎসকের চেকআপে থাকেন, তাহলে এই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে বাচ্চা ও মায়ের ঝুঁকি এড়াতে পারি। সে রকম প্রেসার হয়তো স্বাভাবিক ছিল তবে গর্ভাবস্থায় সেটি বেড়ে গিয়ে প্রি একলামসিয়া বা পরে খিঁচুনি হয়ে একলামসিয়া হলো। রোগী যদি চেকআপে থাকে, তবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই জন্য আসলে গর্ভকালীন পরিচর্যা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : প্রি একলামসিয়া বা একলামসিয়া সম্বন্ধে কি রোগীকে বুঝিয়ে বলেন? কী থাকে সেটি?
উত্তর : অবশ্যই বুঝিয়ে বলি। যার হয়তো আগের গর্ভাবস্থায় প্রি একলামসিয়া ছিল, প্রেসার বেশি ছিল তাদের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই আমরা কিছু ওষুধ যোগ করি। যেমন : ক্যালসিয়াম একটু বেশি ডোজে দিই। রক্ত যেন জমাট না বাঁধে সে জন্য কিছু ওষুধ দিই। এতে রোগী প্রি একলামসিয়ার দিকে যায় না। পরবর্তীকালে আমরা হয়তো প্রেসার দেখে এর ওষুধগুলো বাড়িয়ে দিই। এই বিষয়টি সম্ভব শুধুমাত্র রোগী যদি অ্যান্টিনেটাল চেকআপে আসে। এখান থেকেই প্রো-একলামসিয়া, একলামসিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রশ্ন : যদি মানসিক চাপে থাকে সে ক্ষেত্রেও অনেক ঝুঁকি রয়েছে। তাই আশপাশে যাঁরা থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে আপনার কী পরামর্শ থাকে যাতে করে তাঁর মানসিক দিকটাও ভালো থাকে?
উত্তর : গর্ভকালীন চেকআপে যখন একজন মা আমাদের কাছে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে স্বামী বা শাশুড়ি যাঁরা থাকেন, তাঁদের সব সময় আসতে বলি। বিশেষ করে স্বামী যদি সঙ্গে থাকেন তাহলে তাঁকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাগুলো বা কীভাবে একটি সুস্থ বাচ্চা প্রসব করাতে পারি, সেটার জন্য আমরা অবশ্যই স্বামীকে চাই। যেমন ভারী কাজগুলো করতে মানা করি। সংসারের অন্যান্য লোকজন তখন মাকে সাহায্য করবেন। তবে বাড়ির স্বাভাবিক টুকটাক কাজ তিনি করতে পারবেন। এ ছাড়া বিশ্রামের বিষয়ে বলি। রাতে যেন মায়ের আট ঘণ্টা ঘুম এবং দুপুরে যেন তিনি দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে পারেন। এই বিষয়গুলো আমরা আলোচনা করি। এ ছাড়া আমরা মাকে আয়রন, ক্যালসিয়াম-জাতীয় ওষুধগুলো খেতে দিই। এগুলো তিনি ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না সংসারের অন্য সদস্যরা এগুলো খেয়াল করবেন।