ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন
শিশু অপুষ্টি রোধে ভিটামিন-এ
ভিটামিন শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এক উপাদান। এটি শরীরে কোনো শক্তি জোগান দেয় না ঠিকই, তবে এটি ছাড়া শরীরের বৃদ্ধি ও বিকাশ হয় না। জৈবিক বিভিন্ন বিক্রিয়ায় এটি জরুরি ভূমিকা পালন করে। যদিও ভিটামিন খুব অল্প পরিমাণে দরকার হয়, তবে বেশির ভাগ ভিটামিন শরীরে তৈরি হতে পারে না বলে খাবারের মাধ্যমে চাহিদা পূরণের প্রয়োজন পড়ে। তবে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ অসচেতন, তা ছাড়া দারিদ্র্যের জন্য সুষম খাবারের প্রাপ্যতাও দেশের জনগণের জন্য চ্যালেঞ্জ বটে। তাই ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়। শিশুরাই এর শিকার হয় বেশি। শিশুদের কথা চিন্তা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর দু-বার ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ শনিবার দেশব্যাপী এ ক্যাম্পেইন চলছে।
ছয় মাস থেকে ৫৯ মাস বয়সী সকল শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। ৬ -১১ মাস বয়সী শিশুদের এক লাখ ইউনিটের একটি নীল ক্যাপসুল ও ১২-৫৯ মাস বয়সীদের দুই লাখ ইউনিটের একটি লাল ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান এর আয়োজন করছে।
ভিটামিন-এ শিশুদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর অভাবে শিশুর রাতকানা রোগ হয়। যদি রাতকানা রোগ পর্যন্ত থেমে থাকত তাহলে দুচিন্তার কারণ ছিল না। এক সময় রাতকানা শিশুর অন্ধত্বে রূপ নেয়। আমাদের দেশের শিশুমৃত্যু ও অপুষ্টির অন্যতম কারণ ডায়রিয়া ও এর জটিলতা। ভিটামিন এ-র অভাবে ডায়রিয়া জটিল আকার ধারণ করে ও অপুষ্টিজনিত শিশুমৃত্যুর হার বাড়ায়। শিশুদের এমনিতেই রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। এ ভিটামিনের অভাবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা আরো কমে গিয়ে প্রাণহারী সংক্রমণে আক্রান্ত করে শিশুমৃত্যু ঘটায়। এ ভিটামিন শুধু শিশুদের জন্য জরুরি নয়, এটি বড়দের জন্যও প্রয়োজন। এর অভাবে ত্বক খসখসে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুস, ত্বকের ক্যানসার কমায় ভিটামিন-এ। বড়দের ছানি পড়া রোধ করে এ ভিটামিন। এ ছাড়া এটি রক্তনালিতে চর্বি জমাট বাধা প্রতিরোধ করে হৃৎপিণ্ডের রোগবালাই কমায়। বন্ধ্যত্ব প্রতিরোধেও কাজ করে।
ভিটামিন-এ সবচেয়ে বেশি থাকে যকৃত বা কলিজায়। এ ছাড়া সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, দুধ, মাংস, সব ধরনের সবুজ শাকসবজি (যেমন লালশাক, কলমি শাক, কচুশাক, সজিনা পাতা, হেলেঞ্চা শাক, পুঁইশাক, পালং শাক, পাটশাক, গাজর, শালগম, মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু,), হলুদ ফলমুল (পাকা আম, কাঁঠাল, পাকা পেঁপে) ইত্যাদিতে ভিটামিন-এ বেশি পরিমাণে থাকে। তাই শিশুর ভিটামিন এ-র অভাব দূর করতে এগুলো বেশি পরিমাণে খাওয়ান।
ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইন সরকারের একটি সফল কার্যক্রম। এ পর্যন্ত ৯০ শতাংশ শিশুকে এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়েছে। ভিটামিন-এ ক্যাপসুল সম্পূর্ণ নিরাপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন। এটি সেবনে শিশুদের সাধারণত কোনো সমস্যাই হয় না। তবে গত চার মাসের মধ্যে কোনো শিশু ভিটামিন-এ ক্যাপসুল সেবন করলে তাকে তার এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে ক্যাপসুল সেবন করালে শিশুর শরীরে ভিটামিন বেশি পরিমাণে জমে গিয়ে বমি বমি ভাব, ঝিমুনি ভাব হতে পারে। কারো কথায় প্ররোচিত না হয়ে শিশুকে ক্যাপসুল সেবন থেকে বিরত হবেন না। কোনো গুজব বা অপপ্রচারে কান না দিয়ে আপনার শিশুকে ক্যাপসুল সেবন থেকে বিরত রেখে শিশুর ক্ষতি করবেন না। ভিটামিন-এ ক্যাপসুল ভরা পেটে সেবন করলে বেশি পরিমাণে শোষিত হয়। তাই ক্যাপসুল সেবনের আগে শিশুকে খাবার দিন। অসুস্থ শিশুকে ক্যাপসুল খাওয়ানোর আগে মাঠকর্মী বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কান্নারত শিশু কান্না থামালে ক্যাপসুল খাওয়ান। পুরো ক্যাপসুল না খাইয়ে শুধু ভেতরের তরল অংশ খাওয়ান।
ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের এ ক্যাপসুল সেবনের প্রয়োজন নেই। তাদের এ ভিটামিন চাহিদা মায়ের মাধ্যমে পূরণ হয়। মায়ের বুকের দুধে বিশেষ করে শালদুধে ভিটামিন-এ বেশি পরিমাণে থাকে। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় এখনো শালদুধকে ক্ষতিকর মনে করে ফেলে দেওয়া হয়। এটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভব না হলে এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খেতে দিন। জন্মের পরপর শিশুর মুখে পানি, শরবত, মধু বা অন্য কিছু দেবেন না। এতে শিশুর ক্ষতি হয়। শিশুর ভিটামিন এ-র চাহিদা পূরণে প্রসবের পরপরই মাকে দুই লাখ ইউনিটের একটি লাল ক্যাপসুল সেবন করতে দিন। গর্ভাবস্থায়ও প্রসবের পর প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খেতে দিন। পরিবারে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ ভোজ্য তেল খান।
ভিটামিন-এ ক্যাপসুল সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খাওয়ানো হবে। গ্রাম এলাকায় প্রতি ওয়ার্ডে আটটি অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রে ও শহর এলাকায় প্রয়োজন অনুসারে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করে এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। এ ছাড়া যারা এদিন ভ্রমণ করবেন তাদের জন্য বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, বিমানবন্দর, নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বাজার এলাকাতেও থাকবে টিকাদান টিম। এ ছাড়া ক্যাম্পেইনের পরবর্তী চারদিন স্বাস্থ্যকর্মী বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যাপসুল সেবন করেনি এমন শিশুদের ক্যাপসুল সেবন করাবেন। সরকার এ ক্যাম্পেইন সফল করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ক্যাম্পেইন পুরোপুরি সফল করার জন্য এখন দায়িত্ব আপনার-আমার। পরিবারে, আত্মীয়-স্বজনের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু থাকলে ভিটামিন-এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর জন্য জানান ও খোঁজ নিন।