বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে চাই স্বাস্থ্যসম্মত জীবন
প্রথম যখন কারো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, সীমাহীন অসহায়ত্ব গ্রাস করে তাকে । মনে হয় জীবনটাই অর্থহীন । আবার অনেকে আছেন যাঁরা ভয়ে রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষাই করান না। পাছে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে যায় ! অথচ যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে জটিলতা ততই কমবে। সুতরাং এ রোগ নিয়ে বলার, শোনার বা আলোচনা করার প্রয়োজন আছে। সেই প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি করে স্মরণ করিয়ে দিতে আজ ১৪ নভেম্বর পালিত হচ্ছে 'বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস'। ২০১৪ হতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ও ডায়াবেটিস’।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৯০ লাখ। আর বিশ্বে প্রায় ৩৮ কোটি। এটি ২০৩৫ সাল নাগদ দ্বিগুণ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিম্ন আয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এ রোগের প্রকোপ বেশি। উন্নয়নশীল দেশে এখন কম বয়সে এ রোগ হওয়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে, এর ফলে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষ হবেন সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এতে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষটি পরিবার, দেশ ও জাতির জন্য অর্থনৈতিকভাবে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ, যাকে সারানো যায় না। তবে সঠিক জীবনযাপন ও আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ডায়াবেটিস কী
ডায়াবেটিস হলো হরমোনজনিত রোগ। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ইনসুলিন। ইনসুলিন তৈরি হয় অগ্ন্যাশয় থেকে। ইনসুলিন তৈরি কম হলে বা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমে গিয়ে ঠিকভাবে কাজ করতে না পারলে শরীরে গ্লুকোজ বা চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়। একে অবশ্যই সহনীয় মাত্রায় রাখে ইনসুলিন। তবে কার্যস্থলে ইনসুলিনের ঘাটতি ঘটলে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। ফলে মস্তিষ্ক, কিডনি, চোখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ডায়াবেটিসের কারণ
ডায়াবেটিস বংশগত রোগ। এটি আমরা সবাই জানি। তবে সেটাই আসল কথা নয়। অনেকের বাপ-দাদার ডায়াবেটিস না থাকলেও তাদের ডায়াবেটিস হয়। জীবনযাত্রার বদলে ডায়াবেটিসও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ডায়াবেটিস তাই যেকোনো লোকের যেকোনো বয়সে যেকোনো সময়ে হতে পারে। তবে বংশে থাকলে আশঙ্কা বেশি। জন্মের সময় ওজন কম থাকলে, বয়ঃসন্ধিকালে মোটা থাকলে এবং ডায়াবেটিস আছে এমন গর্ভবতী মায়ের বাচ্চাদের ডায়াবেটিস বেশি হয়।
রক্তের গ্লুকোজ নির্ণয়
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কত হলে তাকে ডায়াবেটিস বলে তা জানা দরকার । আবার স্বাভাবিক গ্লুকোজের মাত্রা এবং প্রি-ডায়াবেটিক অবস্থা নির্ণয় করাটাও জরুরি । নিচে এসব অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা উল্লেখ করা হলো।
স্বাভাবিক
নাশতার আগে ৬ মিমোল/লি. বা তার কম;
খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ মিমোল/লি. বা তার কম।
প্রি-ডায়াবেটিস
নাশতার আগে ৬.১ মিমোল/লি. থেকে ৬.৯ মিমোল/লি.।
খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৭.৮ থেকে ১১.১ মিমোল/লি.।
ডায়াবেটিস
নাশতার আগে ৭ মিমোল/লি. ও ৭ এর বেশি;
খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ১১.১ মিমোল/লি. ও তার বেশি
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে :
১. ঘন ঘন প্রস্রাব,
২. পিপাসা পাওয়া,
৩. ক্ষুধা লাগা,
৪. দুর্বলতা,
৫. ওজন কমে যাওয়া,
৬. অমনোযোগিতা ইত্যাদি।
এসব দেখা দিলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করা উচিত। তবে কোনো লক্ষণ না থাকলেও যাদের বয়স চল্লিশের বেশি, যাদের পরিবারে কারো ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন বেশি, যারা হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো উচিত। ধরন অনুযায়ী মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিন ইনজেকশনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে এটি হলো ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনার মাত্র একটি উপাদান। আসল হলো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণ। শুধু চিনি খেলেই যে রক্তে গুকোজে বাড়বে তা নয়। আমাদের দৈনন্দিন যে খাবার অর্থাৎ ভাত, রুটি এসবই শরীরে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। এসব বেশি খেলেও ডায়াবেটিস খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে। তাই পরিমাণ মতো ডায়াবেটিস খাবার গ্রহণ করা উচিত। এজন্য চিকিৎসকের পাশাপাশি পুষ্টিবিদদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের খাদ্য তালিকায় কার্বোহাইড্রেট বা শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ব্যায়াম মানে খুব দামি ইনস্ট্রুমেন্ট কিনে, আয়োজন করে কসরত করা নয়। জিমে বা দূরের পার্কে যেতে হবে, তাও নয়। যারা ইনসুলিন নেন তারা অবশ্যই চিনি বা মিষ্টি জাতীয় জিনিস সঙ্গে রাখুন। নয়তো রক্তে গ্লুকোজ খুব কমে গিয়ে মারাত্মক সমস্যা হতে পারে। শিশুরাও আজকাল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। সুতরাং তাদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। আধুনিক বিশ্বে শিশুর ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ হলো তাদের অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত ফাস্টফুড, আইসক্রিম, চকোলেট, পেস্ট্রি ইত্যাদি খাওয়া। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন এবং পর্যাপ্ত খেলার ব্যবস্থা করাটা জরুরি। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে সারাজীবন সুস্থভাবে কাটিয়ে দিচ্ছেন, এমন হাজারও দৃষ্টান্ত রয়েছে। অথচ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের মাধ্যমে এসব জটিলতা অনেকটাই প্রতিরোধ সম্ভব।
লেখক : রেজিস্ট্রার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।