গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার চেকআপ জরুরি
গর্ভধারণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিত সেবাদান জরুরি।এতে শিশুর জন্মদান সুন্দরভাবে করা যায়। আজ ১৬ সেপ্টেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৫৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন শিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. জিনাত আরা নাসরিন।
প্রশ্ন : এন্টিনেটাল কেয়ার বা প্রসূতি মায়ের যত্ন বলতে আমরা কী বুঝি?
উত্তর : যেকোনো মেয়ে যখন প্রথম গর্ভবতী হলো তখন থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত একটি পরিকল্পিত সেবা দানকে আমরা বলি প্রসূতি মায়ের যত্ন বা এন্টিনেটাল চেকআপ।
প্রশ্ন : এ বিষয়টির আওতায় কোন কোন বিষয়গুলো পড়ে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই সেবাগুলো আসলে কীভাবে আসছে গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে?
উত্তর : একটি মেয়ে যখন গর্ভবতী হলেন তাঁর জীবনে একটি নতুন পরিক্রমা শুরু হলো। এই চলার পথে তার অনেক বাধা বিপত্তি আসতেও পারে। সেই বাধাগুলো অতিক্রম করে সুন্দরভাবে সন্তান জন্ম দেওয়া হচ্ছে তার জীবনের একটা সাফল্য। সুতরাং এই চলার পথে তাকে কিছুটা নির্দেশনা দিতে হয়, উপদেশ দিতে হয়। কিছুটা উন্নত মানের চিকিৎসা দেওয়া দরকার।
ওয়ার্ল্ড হেলথ ওরগানাইজেশন বলেছে, গর্ভাবস্থায় একজন মা অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে যাবে, এন্টিনেটাল চেকআপ নেবে। এখন কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, হাসপাতাল রয়েছে- এসব জায়গায় যাবে। প্রথম ১৬ সপ্তাহে একবার এলো, পরে ২৮ সপ্তাহে এলো, তারপর ৩২ সপ্তাহে এলো, এরপর একেবারে শেষে একবার এলো। অন্তত এই চারবার যদি একজন মা চিকিৎসকের কাছে এসে থাকেন তাহলে তার এই পথটি খুব সুগম হয়। গর্ভকালীন তার কোনো সমস্যা হলে সেগুলো সমাধান করা সম্ভব হয়।
এ ক্ষেত্রে আমরা মূলত তাকে বলি, কী খেতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, কোনো ওষুধের দরকার আছে কি না, যেই সন্তানটি তার আসছে সে ভেতরে সুন্দরভাবে বড় হচ্ছে কি না- এজন্য চেকআপ করতে হবে এবং কিছু পরীক্ষা করতে হয়।
প্রশ্ন : একজন মা যিনি প্রথম গর্ভবতী হলেন তাঁর সুখানুভূতির সাথে সাথে একটা আতঙ্কও কাজ করে। সে ক্ষেত্রে এই মায়েদের আশ্বস্ত করার জন্য আপনারা কী বলে থাকেন তখন?
উত্তর : হ্যাঁ। এই কথাটি নতুন মায়েদের বেলায় বেশি প্রযোজ্য। গর্ভধারণ একটা আশীর্বাদের মতো। এটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম এবং দেখা গেছে প্রাকৃতিকভাবেই ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় কোনো জটিলতা হয় না। তবে যেই জটিলতা আসে সেগুলোও সেই মা এন্টিনেটালকেয়ারে থাকলে অতিক্রম করতে পারে। সুতরাং গর্ভধারণ করলে সেটা উপভোগ করাই ভালো। আর ভয়ে পিছিয়ে না যাওয়াই ভালো। মানসিকভাবে সে যদি ভালো থাকে সেটা শিশুর ওপরও প্রভাব ফেলবে। একজন প্রফুল্ল মা একটা প্রফুল্ল শিশু উপহার দিতে পারবেন।
প্রশ্ন : প্রসূতি মায়ের যত্নে আপনার কী কী দেখেন?
উত্তর : প্রথম সাক্ষাৎটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা মা যখন আমাদের কাছে এলেন শুরুতেই আমরা তাঁর শারীরিক অবস্থা কেমন সেটি দেখে নেই। তিনি কি ফিট? তিনি কি চলতে পারবেন এই পথপরিক্রমায়? সেটা আগে দেখে নিই। তাঁর ওজন দেখি, রক্তচাপ দেখি, এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতা আছে কি না দেখি, কোনো অসুখ-বিসুখ আছে কি না দেখে নিই।
এরপর পেটের শিশুটি কেমন আছে সেটা দেখার চেষ্টা করি। এরপর আমরা সমান্য কিছু পরীক্ষা করি। যেমন মায়ের রক্তে গ্রুপ কী, তার রক্তে শর্করা আছে কি না, তার রক্তশূন্যতা আছে কি না দেখে নিই। আর হেপাটাইটিস বি রয়েছে কি না দেখে নেই।
পাশাপাশি একটি আল্ট্রাসোনোগ্রাম করে নিই। দেখে নিতে চাই শিশুটি কেমন রয়েছে। তার হার্টবিট সুন্দর আছে কি না, তার গঠন প্রকৃতি ঠিক আছে কি না, এ দুটো হলো প্রধান পরীক্ষা। যখন আমরা এগুলো করে নিশ্চিত হই, তখন তাঁকে কিছু উপদেশ দেই।
উপদেশের বেলায় খাবারের কথা বলি। আমাদের একটা ভুল ধারণা মায়েদের দ্বিগুণ খেতে হবে। বেশি বেশি খেতে হবে। আসলে তা নয়। দেখা গেছে প্রকৃতিগতভাবে একজন সুস্থ মা তার বাচ্চার জন্য যথেষ্ঠ তৈরি থাকেন। তাই সাধারণত আমরা বলি, যেটুকু খাচ্ছেন তিনি খাবেন। তার পাশাপাশি আমিষ জাতীয় খাবার, যেমন : একটি ডিম, একটু মাংস, একটু মাছ, একগ্লাস দুধ এগুলো খেলেই তার ক্যালোরির চাহিদাটা পূর্ণ হয়ে যায়।
প্রশ্ন : প্রথম তিন মাসে মায়েদের বমি বমিভাব জটিলতার মধ্য দিয়ে যায়। এই সময় তার খাবারের রুচিও থাকে না। এটি শিশুর জন্য খুব সুখের বা ভালো কিছু না। সেক্ষেত্রে আপনারা তাদের কী পরামর্শ দেন?
উত্তর : এটা নিয়ে আসলেই অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। দেখা গেছে তরুণ মা যাঁরা তাঁদের এই সমস্যা বেশি হয়। কিংবা যাঁরা অনেকদিন বিরতি নিয়ে সন্তান নিচ্ছেন তাঁর বেলাতেও এমন হয়। আসলে বমি, একটু গা গুলানো- এগুলো খুবই স্বাভাবিক। এগুলোকে সুন্দর স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলে ভয়ের কিছু নেই। তবে যেসব ক্ষেত্রে খুব বেশি বমি হচ্ছে, ১০ বার ১৫ বার বমি হয়ে যাচ্ছে সে ক্ষেত্রে আমাদের একটু পদক্ষেপ নিতে হবে।
যদি তিনি পানি শূন্যতায় ভোগেন, শরীরে যদি ইলেকট্রোলাইট কমে যায় সে ক্ষেত্রে আমরা স্যালাইন দিতে পারি। পাশাপাশি আমাদের বমি কমানোর ইনজেকশন এবং ট্যাবলেট রয়েছে। যাঁর বেলায় যেটি প্রযোজ্য সেটা দিয়ে দেব। তবে এসব ক্ষেত্রে যদি অতিরিক্ত বমি হয় আমরা আল্ট্রাসোনোগ্রাম করে দেখে নিই যে এখানে একটির জায়গায় দুটো বাচ্চা রয়েছে কি না। বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না। সেগুলোও আমরা পাশাপাশি পরীক্ষা করে নিই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই বমির ভাবটি আমরা অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি। এর জন্য খুব দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
প্রশ্ন : আপনি যেটি বলছিলেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, ৯৯ শতাংশের ক্ষেত্রে খুব সুন্দর ভাবে ,জটিলতা ছাড়া একজন মা তার শিশুকে জন্ম দিতে পারেন। তবে তারপরও দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত এই মাতৃমৃত্যুর হার বা শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। এটি কেন?
উত্তর : এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শুধু আমাদের দেশেই নয়, যাঁরা অনেক উন্নত দেশ তাদেরও এই সমস্যা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মায়ের মৃত্যুর হার প্রতিরোধ করতে পারি না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই পারি। বলা হয়েছে, তিনটি জিনিস এর মূলে রয়েছে। তিনটি দেরি। এক, সিদ্ধান্ত নিতে আমরা দেরি করছি। দুই, সিদ্ধান্ত নিয়েছি বটে তবে সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। তিন, আবার ওখানে গিয়ে হয়তো সেবা পেতে দেরি হচ্ছে। এই তিনটি বড় দেরি আমাদের বাধা।
তবে আমাদের পুরো বাংলাদেশে এখন বেশ সুন্দর নেটওয়ার্ক হয়েছে। আমাদের সরকার এবং এনজিও সবাই এখানে কাজ করছে। এখন ইমার্জেন্সি অবসটাটিক কেয়ার বিভাগ চালু করা হয়েছে। তাতে সুবিধা এই হয়েছে, আমরা যদি সঠিক এন্টিনেটাল কেয়ারে থাকি, তাহলে ডাক্তার জানবেন সে মায়ের অবস্থা কেমন, ঝুঁকিপূর্ণ না কি স্বাভাবিক। ঝুঁকিপূর্ণ মা হলে তাঁকে আগে থেকে সচেতন করে দেওয়া হয়। বলে দেব, তোমার এই এই সমস্যা রয়েছে এবং তোমার প্রসব ভালো জায়গায় করতে হবে। আর বড় হাসপাতালে এলে তো আর অসুবিধা নেই। সেখানে সম্পূর্ণ ব্যবস্থা থাকে।
আমরা মায়ের মৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে এনেছি। আমরা এতে খুব গর্ববোধ করি। বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের মধ্যে এই মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। আরো কমে যাবে। আর এর অংশ হওয়াতে আমার ভালো লাগছে।
আমরা যদি একটি সঠিক প্রসূতির যত্ন নিতে পারি। আর বাড়ির সবাই যদি সচেতন থাকে যে এখন প্রসব হবে, তাহলে আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি না করে চট করে সদর বা বড় হাসপাতালে চলে গেলে ভালো হবে এবং যাওয়ার জন্য যদি আগে থেকে একটি ভ্যানগাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স বা একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখি তাহলে ওই সময় আর এসব খুঁজতে হবে না। তাকে ফোন দিলেই সে চলে আসবে। আর যেখানে যাব তারাও যদি তৈরি থাকে তাহলে সুবিধা হয়। এই বাধাগুলো অতিক্রম করা যায়।