শিশুর হৃদরোগ হতে পারে জন্ম থেকেই
শিশুদের দুইভাবে হৃদরোগ হতে পারে। জন্মগতভাবে এবং জন্মের পরে। ১১ সেপ্টেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৪৮ তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ল্যাব এইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের পরামর্শক ডা. আমিরুল ইসলাম ভূঁইয়া।
প্রশ্ন : হৃদরোগ যেকোনো বয়সে হতে পারে আমরা জানি। এরমধ্যে কনজিনিটাল এবং একুয়ার্ড। অর্থাৎ জন্মগতভাবেই একটি শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্ম নিতে পারে। আবার জন্মের পরও তার সমস্যা হতে পারে। আপনি একটু বলুন কী কী হৃদরোগ সাধারণত শিশুদের বেলায় হয়? এবং এর মধ্যে কোনগুলো জন্মগতভাবে এবং কোনগুলো জন্মের পর হয়?
উত্তর : মানুষ তার জীবনচক্রের অনেকগুলো পর্যায় অতিক্রম করে। প্রত্যেকটা পর্যায়ই সে যখন অতিক্রম করে তখন একটা না একটা রোগ এমনিতেই হয়ে থাকে। সে যখন শিশু অবস্থায় থাকে তার এক রোগ, কৈশোর অবস্থায় আরেক রোগ, মধ্যবয়সি বা বৃদ্ধ বয়সে আরেক রোগ- এক-একটা পর্যায় যখন সে পার করবে সে বয়সের রোগই তাকে আক্রান্ত করবে।
শিশুদের হৃদরোগ কথাটি শুনলে নির্মম লাগলেও শিশুদের এই সমস্যা হয়।
আমরা জানি, হার্টের চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে। চারটি প্রোকোষ্ঠের মধ্যে উপরে থাকে দুটি নিচে দুটি। ডান দিকে দুটি, বাম দিকে দুটি। এ দুটির মাঝখানে একটি পর্দা থাকে। ডানদিকে একরকম রক্তবহন করে। বাম দিকে আরেক রকম রক্ত বহন করে। কোনোটার সাথে ডান এবং বাম কখনোই মিশ্রণ হবে না। আমাদের শিশুদের যে হৃদরোগ হয়, তাতে রক্তের গতি পথের পরিবর্তন হয়ে যায়। সেটা আংশিক হতে পারে। অথবা পুরোপুরি গতি পথ পরিবর্তন হতে পারে। ডানের রক্ত বামে যায়, বামের রক্ত ডানে যায়। দুটির মিশ্রণ হয়ে যায়। একদিকে ছিল অক্সিজেন যুক্ত রক্ত, আরেকদিকে ছিল ডি-অক্সিজেনেট রক্ত। দুটো মিশ্রণ হয়ে তার সমস্যা হয়।
সমস্যাটা দুই ধরনের হতে পারে। সাধারণ সমস্যাও হতে পারে। গুরুতর সমস্যাও হতে পারে। সাধারণ সমস্যায় দেখা যায় শিশুটা আস্তে আস্তে বড় হয় এবং কোনো কিছু প্রকাশ পায় না। তার যখন মধ্যবয়স বা বৃদ্ধ বয়স হলো তখন সমস্যাটা প্রকাশ পেতে পারে। আসলে ত্রুটি ছিল জন্মগত। তবে জীবনের যেকোনো বয়সে প্রকাশ হতে পারে। এটা সাধারণ ছিল তাই টের পাওয়া যায় নাই। দেখা গেল মধ্য বয়সে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, অথবা বুক ধরফর করছে, তখন হৃদরোগ চিকিৎসকের কাছে গেলে বলল আপনার তো জন্মগত ত্রুটি রয়েছে।
প্রশ্ন : সাধারণত কী ধরনের সমস্যা দেখলে বোঝা যাবে শিশুটির জন্মগত ত্রুটি রয়েছে?
উত্তর : এখানে একটি সমস্যা রয়েছে। আমরা তো আগেই বলেছি অক্সিজেন মিশ্রিত এবং ডি অক্সিজেনেট রক্ত মিশে যায়। এর জন্য ডি অক্সিজেনেট বা নীল রক্তটি শরীরে বেশি চলে আসে। তখন দেখা যায় শিশু নীল হয়ে যাচ্ছে। দেখা যায় শিশু যখন পরিশ্রম করছে, কান্নাকাটি করছে, বুকের দুধ খাচ্ছে, সে নীল হয়ে যাচ্ছে। তার অক্সিজেন পূর্ণ হচ্ছে না শরীরে।
আবার যখন ডান থেকে বামে বা বাম থেকে ডানে রক্ত যায় তখন একটা প্রকোষ্ঠের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে যায়। রক্ত বেশি এসে যায়। তখন হার্টটা আর চাপ বহন করতে পারে না। যার জন্য তার শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এসব সমস্যা দেখলে আমরা বুঝি বাচ্চাটার একটা হার্টের সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : শিশুদের হার্ট ফুটো হওয়ার সমস্যা থাকতে পারে। আপনার কী ধরনের অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেন সার্জারি করতে হবে, না কি করতে হবে না?
উত্তর : সাধারণত হার্টের বাম এবং ডান দিকে মাঝে যে পর্দা দেওয়া আছে, যেখানে অক্সিজেন এবং ডি-অক্সিজেন রক্ত মিশতে পারে না। সেই পর্দার মধ্যে লিক বা ফুটো থাকতে পারে। আবার উপরের প্রোকোষ্ঠের পর্দা এবং নিচের প্রোকোষ্ঠের পর্দার সমস্যা থাকতে পারে।
আরেকটি ত্রুটি হচ্ছে বাচ্চা যখন ভূমিষ্ঠ হয় তখন চিৎকার করে জানিয়ে দেয় তার জন্ম হয়েছে। তখন তার ভেতরেও একটা পরিবর্তন হয়। যখন সে মায়ের পেটে ছিল মায়ের পুষ্টি নিয়ে সে চলত। সে যখন জন্মের পর কাঁন্না করল তার ফুসফুসটা তখনই ফুলে গেল। তার নিজের পদ্ধতি চালু হয়ে গেল। মায়ের যে ছিদ্রগুলো ছিল সেগুলো বন্ধ হয়ে গেল। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায় সেগুলো বন্ধ হতে দেরি হতে পারে। যেহেতু বাচ্চার নিজস্ব পদ্ধতি চালু হয়নি, তাই বাচ্চার সমস্যা রয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা ধীরে ধীরে এমনিতেই সেরে যায়।
আর কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় সারছে না। তখন কার্ডিওলজিস্ট বা সার্জনরা অবস্থা বুঝে চিকিৎসা দেন।
কী কী সমস্যা হয়? এখানে একটি শিশুর বৃদ্ধির সমস্যা হয়। হার্ট অকার্যকর থাকলে বারবার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়।
প্রশ্ন : শিশুদের বেলায় কী জন্মের পরও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : হ্যাঁ, হতে পারে। জন্মের পর শিশুদের অনেক সমস্যা হতে পারে। ভাল্ভভিউলার সমস্যা হতে পারে। রিউমেটিক ফিভার থেকে ভাল্ভে সমস্যা হতে পারে।
হার্টের ভাল্ভ হলো গোলাপফুলের পাপড়ির মতো। কখনো দুটো পাপড়ি থাকে, কখনো তিনটি পাপড়ি থাকে। যখন উপরের প্রোকোষ্ঠ থেকে নিচে রক্ত যায় তখন পাপড়িগুলো খুলে যায়। এই ভাল্ভগুলো সাধারণত রক্তের একমুখি চলা নিয়ন্ত্রণ করে। যাতে উল্টো দিকে যেতে না পারে। যখনই উল্টোদিকে যাবে তখনই সমস্যা হবে।
প্রশ্ন : শিশুদের জন্মের পর হৃদরোগ প্রতিরোধের উপায় কী?
উত্তর : আমাদের দেশে দেখা যায়, যেসব পরিবারে অনেক বেশি সদস্য থাকে, একটা স্যাতঁস্যাঁতে পরিবেশে থাকে তাদের কাশি বার বার হয়। জীবাণু বার বার আক্রমণ করে। তাহলে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে থাকা যাবে না। একত্রে সবাই মিলে গাদাগাদি অবস্থায় থাকা যাবে না। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পূর্ণ এলাকায় থাকতে হবে। যতবারই আক্রান্ত হবে বাজে ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের বিষ তৈরি করবে সেটা রক্তের কোথাও না গিয়ে হার্টের ভাল্ভে গিয়ে বিক্রিয়া করবে। বিক্রিয়া করলে ভাল্ভের যে পাপড়িগুলো সেগুলো শক্ত হয়ে যায়, মোটা হয়ে যায় এবং একটার সঙ্গে একটা লেগে যায়। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় এত চিকন হলো যে আর খুলছে না। কিছু ক্ষেত্রে মোটেই ভাল্ভটা বন্ধ হচ্ছে না। তখন একমুখি চলাচল আর থাকে না।
তখন হার্টের বেশি কাজ করতে হয়। তখন হার্টকে জোড়ে পাম্প করতে হয়। এ সময় হার্ট অকার্যকর হতে পারে। তাই প্রথম কথা হচ্ছে প্রতিরোধ করা।