ল্যাসিক কী, কখন করা যায়?

ল্যাসিক আধুনিক একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। সাধারণত চোখের পাওয়ারের সমস্যা সমাধানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
এ বিষয়ে এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ৩১১৪তম পর্বে কথা বলেছেন অধ্যাপক এ কে এম মোস্তফা হোসেন। বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হসপিটালের বক্ষব্যাধি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : ল্যাসিক কী?
উত্তর : ল্যাসিক একটি সার্জারি। সার্জারির কথা শুনলেও মানুষ ভয় পায়, লেজার শুনলেও মানুষ ভয় পায়। আসলে লেসিক হলো লেজার দিয়ে চোখের এক ধরনের অস্ত্রোপচার। ছুরি না লাগিয়ে আমরা লেজারের সাহায্যে এই অস্ত্রোপচার করি। উদ্দেশ্য হলো চোখের চশমা থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়া। সাধারণত বয়োঃসন্ধিতে বা শিশু বয়সে বোঝা যায় একজন শিশুর চশমা লাগছে কি না। এই সময় আমরা তাকে পর্যবেক্ষণ করি যে চশমা পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটা কতদিন স্থায়ী হয়। সাধারণত ১৮/ ২০ বছর বয়সের মধ্যে অধিকাংশ মানুষের চশমার পরিবর্তনে স্থিতি আসে। অনেকেই ভাবেন,লেসিকে কিছু লাগাতে হবে। লেসিকে চোখের সামনে স্বচ্ছ যে অংশ কর্নিয়া, কর্নিয়ার সারফেজকে আমরা একটু রিমডেলিং করে নিই। এখানে কিছু নতুন করে লাগানো হয় না। চোখের অভ্যন্তরেও ঢুকতে হয় না। একে রিমডেলিং করে দিলে, দীর্ঘমেয়াদী এই রিমডেলিংটা কাজে লাগে। সেক্ষেত্রে তার সারা জীবনই আর দূরে দেখার জন্য চশমা লাগবে না। এই জন্য চল্লিশ পার হলে চালশে যখন হয়, তখন আবার কাছের জন্য চশমা লাগে, ওই চশমাটা লাগবে।
প্রশ্ন : এর মানে চালশে হওয়ার আগ পর্যন্ত তার কোনোটাই লাগবে না?
উত্তর : ধরুন,একজন মানুষের মাইনাস সেভেন পাওয়ারের চশমা লাগে। তাহলে তার যতক্ষণ চোখে ছানি না পড়ছে, বার্ধক্য ছাড়া, সম্পূর্ণ কর্মক্ষম ওই জীবনে, মাইনাস সেভেনটা তার সারা জীবনই লাগছে। তার সঙ্গে যখন চালশে যোগ হবে, তখন এর সঙ্গে চালশের পাওয়ারটাও যোগ হবে। আমরা যদি মাইনাস সেভেনটাকে দূর করে দিই, তাহলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গেল। তখন যদি পড়ার জন্য চশমা লাগে একটু পরল। এটাতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, কাছে দেখার জন্য চশমা লাগবে না সেরকম লেসিকও রয়েছে। তবে এটা এখনও পর্যন্ত খুব জনপ্রিয় হতে পারেনি। কারণ, চল্লিশের পর থেকে ব্যক্তি যখন পুরোপুরি কাজে থাকে, চল্লিশের পর থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত পাওয়ার পরিবর্তন হতে থাকে। তাহলে যখনই তার সমস্যা হলো, লেসিক করলাম, দুই বছর পর আবার সমস্যা, আবার সমস্যা। পঞ্চাশের পরে গেলে আবার স্থিতিপূর্ণ হয়ে যায়। তখন আবার কাছের জন্য লেসিক করা হয়। তবে সেটাও জনপ্রিয় হয়নি।এ কারণে এই সময়তো বার্ধক্যের কারণে আবার ছানি পড়তে শুরু করে। তখন ছানি অস্ত্রোপচার করে সমস্যাটির সমাধান করা যায়। তাই আমরা দামী লেসিকে যাই না। এই হচ্ছে লেসিকের মোটামুটি সুবিধা। তবে মাইনাস পাওয়ারের রোগীরা বেশি সুবিধা পায়। প্লাস পাওয়ারের ক্ষেত্রে প্লাস তিন/ চার/ পাঁচ পর্যন্ত করা যায়। এর বেশি আর করা যায় না। মাইনাস সাত, আট, নয় পর্যন্ত খুব ভালোভাবে করা যায়।
প্রশ্ন : লেসিক করার বিষয়টি কেমন?
উত্তর : সার্জন হিসেবে যদি বলি, লেসিক করা খুব সহজ কাজ। আসলে সীদ্ধান্ত নেয়াটাই হলো আসল ব্যাপার।
মাইনাস পাওয়ারের রোগীদের রেটিনায় কিছু সমস্যা থাকেই। যেমন একটি ছোট বেলুনকে যদি আমরা বড় করে ফুলাই, আমরা দেখব, এর গায়ে কিছু পাতলা পাতলা দুর্বল অংশ দেখায়। যেখান থেকে বেলুনটা ফেটে যেতে পারে। মাইনাস পাওয়ারের রোগীদের চোখের ভেতরটা কলসির মতো বড়। সামনে থেকে তো সবার একই। পিছন দিকে বড় থাকে। সেখানেও রেটিনায় কিছু ত্রুটি থাকে। সেটা আমরা রেটিনা সার্জনকে দিয়ে আগে দেখিয়ে নিই। দেখা গেল এর মেরামত করতে হবে। এরও এক ধরনের লেজার রয়েছে। লেজার করে মেরামত করে দিলে নিশ্চিত করে দিলাম লেসিক হয়েছে। আর করা যায় না কেন? যাদের খুব শুষ্ক চোখ, অল্পই চোখ শুকিয়ে যায়। আর শুষ্ক চোখ একটি রোগ। এই রোগ যদি কারো থাকে, তাকে আমরা এড়িয়ে যেতে বলি।
নম্বর তিন হলো, যদি চোখে কেরাটোকোনাস নামে কোনো রোগ থাকে তাহলে করতে সমস্যা হয়। কেরাটোকোনাস কর্নিয়ার একটি রোগ। কর্নিয়ার এ ধরনের রোগ থাকলে তাকে আমরা লেসিক করলে কর্নিয়া আরো দুর্বল হতে পারে, পাতলা হতে পারে। তার জন্য আমরা অন্য চিকিৎসায় চলে যাই, লেসিক তার জন্য আমরা করি না। আর কিছু ক্ষেত্রে লেসিক করা যায় না। মনে করেন যে একজন মাইনাস ১৮ পাওয়ার নিয়ে আসছে। তাকে লেসিক করা যায় না। কর্নিয়ার ওপর সার্জারি করবোতো, কিছু কর্নিয়া ক্ষয় করতে হবে। তো অতটা ক্ষয় করা যায় না। এর জন্য অন্য ব্যবস্থা রয়েছে। এর জন্য চোখের ভেতরে যেমন আমরা বাইরে দিয়ে কনট্যাক্ট লেন্স পড়ি, চোখের ভেতরে বাড়তি একটি কনট্যাক্ট লেন্স লাগিয়ে দিতে পারি। এতে তার প্রাকৃতিক কর্নিয়াও ঠিক থাকলো, প্রাকৃতিক যে লেন্স রয়েছে চোখের ভেতর সেটিও ঠিক থাকল। লেন্সটা চোখের ভেতর দিয়ে দিলে দূরে কাছে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে দিতে পারবে। এবং কোনো ব্যবস্থাপনা লাগবে না। এটি নির্দিষ্টভাবে চোখের ভেতর দিয়ে দিল। এটাও আমরা করছি। এটা আমাদের দেশে আগে ছিল না। আমি প্রথম এই সার্জারিটা করেছি, গত ডিসেম্বরে। রোগী ভালো রয়েছে।
প্রশ্ন : কোথায় গেলে এই সুবিধাটা পাওয়া যাবে?
উত্তর : এটা আসলে খুব প্রচলিত হয়ে উঠেনি বলে, আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেভাবে হয়নি। তবে আমরা আশা করি এটি হয়ে যাবে। তবে সরকারি পর্যায়ে লেসিক হয়, কম হয়।
প্রশ্ন : এই সার্জারির পরবর্তী সময়ে পরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কিছু লাগবে না। একদম স্বাভাবিক জীবন। আজকে হয়তো লেসিক করলো, আগামীকালের দিনটি বিশ্রাম, এরপর চার থেকে পাঁচ দিন আমরা বলি বিশ্রামে থাকার জন্য। এক সপ্তাহের মধ্যে একেবারে কাজে ফিরে যাবে, কোনো সমস্যা নেই। তবে একজন মায়োপিক রোগীর ক্ষেত্রে বলি, তাদের চোখের তো কিছু ত্রুটি থাকেই, স্বাভাবিক আঘাতে একজন রোগীর চোখের কিছু হবে না, তবে অল্প আঘাতে চোখের রেটিনা ছিঁড়ে যাবে। লেসিকের ক্ষেত্রেও তাই। তার ভুলে গেলে চলবে না যে সে মায়োপিক রোগী।
আর্মির জন্য প্রতি বছরই আমি ১২ থেকে ১৫ জনকে লেসিক করে দিচ্ছি তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।
প্রশ্ন : জটিলতা কী কিছু রয়েছে?
উত্তর : জটিলতা হয়, যদি আমাদের প্রাথমিক ক্যালকুলেশনে ভুল হয়। এর মানে হলো আমাদের কর্নিয়া যদি যথেষ্ট পুরো না হয়,তাহলে কর্নিয়া বাঁকা হয়ে যায়।এই জন্য সেফটি মার্জিন প্রথমে লাগবে। এই জন্য প্রথমদিকে লেসিকের যখন খুব ধুম ধাড়াকা চলত, ২০০৪/২০০৫ সালের দিকে, এরপর বোঝা গেছে, কোথায় করা যাবে, আর কোথায় যাবে না। নিরাপত্তার কোনো বিকল্প নেই।