নবজাতকের হলুদ বমিতে সতর্ক হোন
নবজাতকের বমি নিয়ে বাবা-মা এবং পরিবারের লোকজন বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকেন। সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা না নিলে শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আজ ১৫ জুলাই, এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৯৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সামিদুর রহমান।
প্রশ্ন : নবজাতকের বমি অত্যন্ত ভীতিকর একটি অবস্থা। নবজাতকের বমি হওয়ার প্রধান কারণগুলো কী?
উত্তর : প্রথমেই আমি দর্শককে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাতে চাই, সেটি হলো সব বমি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। যদি বমির রং হলুদ হয়, তবে সেটা আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। যদি বমির সঙ্গে রক্ত যায়, গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিদিন বমি হচ্ছে এবং বমির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে—এমন হলে গুরুত্ব দিতে হবে। বমি চলছে, পাশাপাশি বাচ্চার ওজন বাড়ছে না, সে ক্ষেত্রে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
তবে যে বমি গড়িয়ে পড়ে, একে আমরা এত গুরুত্ব দিই না। যে বমি নাক ও মুখ দিয়ে দূরে ছিটকে পড়বে, একে গুরুত্ব দিতে হবে। সাধারণত নবজাতকের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে বমি হয়, সেটা ম্যাল ফিডিংয়ের জন্য। মায়েদের প্রথম বাচ্চা হলে স্তনে দুধ আসতে একটু সময় লাগে। সেই সময়টা বাচ্চারা কান্নাকাটি করলে মাসহ পরিবারের লোকজন অস্থির হয়ে পড়ে। তখন বাইরের দুধ নিয়ে আসে। এই যে ম্যাল ফিডিং শুরু হলো, দুধকে সে শরীরের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে না। অথবা মিছরির পানি বা চিনির গোলার পানি, গ্লুকোজের পানি বা পরিষ্কার পানি দেয়। এই খাবারগুলো শিশু সহ্য করতে পারে না। এই বমিগুলো সাধারণত গড়িয়ে পড়ে। আরেকটি কারণে সমস্যা হয়, বাচ্চাদের পাকস্থলীর ধারণক্ষমতা খুবই কম, ৩০ এমএলের মতো। তবে মায়েরা খাবার অনেক সময় বেশি খাইয়ে ফেলে। বেশি খাওয়ালে কী হয়, কোনো কারণে পেটে একটু চাপ লাগলে বা খাবারটা সংকোচন প্রসারণ শুরু হয়। তখন কিছু খাবার বমি হয়ে বেরিয়ে যায়।urgentPhoto
এ রকম বমিকে গুরুত্ব দেব কি না, বাচ্চা যদি ওজন বাড়তে থাকে, যদি স্বাস্থ্যবান থাকে, নড়াচড়া (অ্যাকটিভ) যদি ভালো থাকে, তাহলে এই বমি নিয়ে চিন্তার দরকার নেই।
বরং মায়েদের বলি, যা আপনার বাচ্চাকে খাওয়ান তার থেকে একটু কম করে খাওয়াবেন; শুইয়ে খাওয়াবেন না, বসিয়ে খাওয়াবেন। খাওয়ার পর কাঁধে নিয়ে শিশুর পিঠে হালকা চাপ দিয়ে গ্যাসটাকে বের করে দিতে বলি। তাতে এই বমির প্রবণতা কমে যায়।
প্রশ্ন : যে বমিগুলো গুরুত্ব দেওয়ার মতো, সে বমিগুলো কী কী কারণে হচ্ছে এর বোঝার উপায় কী?
উত্তর : মুখ থেকে শুরু করে পায়খানার রাস্তা পর্যন্ত পেটের নাড়ির একটা ধারাবাহিকতা থাকার কথা। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জন্মগতভাবে কিছু অংশ কাজ করে না। অথবা নালিটি ঠিকমতো তৈরি হয়নি। অথবা একটি আরেকটির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। অথবা খাদ্যথলি থেকে খাবারটা ক্ষুদ্রান্তে যাওয়ার সময় একটা সমস্যা হতে পারে।
এসব বমি দূরে পড়বে। বমি হওয়ার পর বাচ্চা আবার খেতে চাইবে। কারণ, তাদের ক্ষুধা তো থেকেই যায়। আর স্বাভাবিক বমি করার পর সে হয়তো হাসছে। তেমন কোনো প্রভাব তার ওপর পড়ছে না এর। কিন্তু যাদের নাড়ির সমস্যার কারণে বমি হবে, এই বাচ্চা বারবার কাঁদবে, খেতে চাইবে। বাচ্চা দিন দিন শুকিয়ে যাবে। আর যদি দেখা যায় পেট ফুলে যায়, খাওয়ার পর বমি হচ্ছে, পায়খানা হচ্ছে না—এটা তখন খেয়াল করতে হবে, বিশেষ করে নবজাতকের ক্ষেত্রে। আর যদি পেট ফুলে যায়, খাওয়ার পর দেখা যায় হলুদ বমি হচ্ছে, পায়খানা হচ্ছে না—এটা তখন নজরে নিতে হবে, বিশেষ করে নবজাতকের ক্ষেত্রে। অনেক সময় বাচ্চাদের পায়খানার রাস্তা তৈরি হয় না। যদি তারা পায়খানার রাস্তার জায়গাটা খেয়াল করে দেখে, তবে সমস্যাটি বোঝা যাবে। তবে হাসপাতালে যেতে হবে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জায়গায় রেফার করবে।
প্রশ্ন : এ ধরনের সমস্যা নিয়ে আসলে চিকিৎসা কী দেন এবং মা-বাবাদের কীভাবে আশ্বস্ত করেন?
উত্তর : এই উত্তর দেওয়ার আগে আমি একটু বলতে চাই, এসব ক্ষেত্রে মায়েদের ভূমিকা কী এবং প্রথম যে চিকিৎসক দেখেন, তাঁর ভূমিকা কী হবে।
যদি এ রকম কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে প্রথম মায়েদের যে দায়িত্ব সেটা হলো শিশুটির খাবার বন্ধ করে দেওয়া। কারণ, খাবার দেওয়া মানে তার জন্য আরো ক্ষতি হবে। যত বমি হবে, তত লবণের ঘাটতি বেশি হবে। অথবা এটা শ্বাসনালিতে ঢুকে যাবে। এই শিশু হঠাৎ করেই শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে। এমনকি মারাও যেতে পারে। তাই উচিত হবে, এই বাচ্চাকে আর না খাওয়ানো।
এ ছাড়া মায়ের বুকে দুধ আসার জন্য একটু অপেক্ষা করা যেতে পারে। এতে ম্যাল ফিডিংয়ের জন্য যেই বমি, সেটি দূর হবে।
আর যদি বমির সঙ্গে পেট ফুলে যায় এবং হলুদ বমি হয়, তাহলে দ্রুত পারিবারিক চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
আর সেই চিকিৎসকের দায়িত্ব হলো মাকে বুঝিয়ে বলা, আপনার বাচ্চার মধ্যে এ রকম একটি বিষয় হচ্ছে এর ধারণা দেওয়া। যদি আপনি এখন খাওয়ান, তাহলে বেশি সমস্যা হবে। সে ক্ষেত্রে খাওয়া বন্ধ করবে, নাকে একটা নল দিয়ে দেবে। একটা স্যালাইন লাগিয়ে দেবে। একটা অ্যান্টিবায়োটিক দেবে। আর বাচ্চাকে তুলা দিয়ে পেঁচিয়ে দিয়ে যেকোনো হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক বা মেডিকেল সার্জনের কাছে পাঠাতে হবে।
আমরা এ ধরনের রোগীকে পাওয়ার পর একটি ইতিহাস নিই। পরিপূর্ণভাবে জেনে কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা লাগলে সেগুলো করা হয়। পাশাপাশি খাওয়া বন্ধ করেছে কি না, নাকে একটা নল দেওয়া হয়েছে কি না, স্যালাইন দেওয়া হয়েছে কি না, অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে কি না—এগুলো ঠিকমতো হয়েছে কি না সেটা দেখি। এরপর সাধারণত এসব বাচ্চার ক্ষেত্রে সার্জারি করা হয়। এতে ভয়ের কিছু নেই।
প্রশ্ন : আপনি কিছু জন্মগত ত্রুটির কথা বলছিলেন। অস্ত্রোপচার করে কি সেটা দূর করা সম্ভব?
উত্তর : আপনাকে যেসব কারণ বললাম, এগুলো যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা করা যায় তবে সারা জীবনের জন্য ভালো থাকা যাবে। সুতরাং এটা সচেতনতার ব্যাপার, সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় যেতে হবে। সঠিক জায়গায় গেলে এসব বাচ্চার জীবন বাঁচানো সম্ভব।
আপনাকে একটা তথ্য জানাতে চাই, বর্তমানে নবজাতকের মৃত্যু হার অনেক কমেছে। কেবল পেডিয়াট্রিকদের চিকিৎসার কারণেই নয়, শিশু সার্জনদেরও ভূমিকা এখানে রয়েছে।
প্রশ্ন : কোথায় গেলে মূলত এই চিকিৎসা পাওয়া যাবে?
উত্তর : যারা গ্রামে বসবাস করে, তারা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে যেতে পারে। আর যারা শহরে থাকে, তাদের তো মেডিকেল কলেজ আছে, বিশেষ হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোতে যেতে পারে।
বাসায় রেখে খাওয়াতে থাকলে অবস্থা আরো জটিল হয়। রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে গেলে অবস্থা জটিল হয়। সুতরাং নিকটস্থ হাসপাতাল এবং একজন পারিবারিক চিকিৎসকের কাছে নিলে একটা পরামর্শ অন্তত পেয়ে যাব। আর প্রায় সব মেডিকেল কলেজে এ বিষয়ে ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।