শতরঞ্জির সম্ভাবনা এখনো জীবন্ত

একসময় বিত্তবানদের আভিজাত্যের অন্যতম প্রতীক ছিল শতরঞ্জি যা সাধারণ আসন, শয্যা, বিছানা, সভা বা মজলিশ বা জলসায় বসার জন্য ব্যবহৃত হতো। তা ছাড়া দেয়াল মাদুর হিসেবেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল এই শতরঞ্জি। ইদানীং ব্যাগ, ছোট কয়েন পার্স, টেবিল ম্যাট এবং উপহার সামগ্রীসহ কিছু কিছু সৃজনশীল পণ্যে শতরঞ্জির ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
শতরঞ্জি শব্দটার অর্থ কী?
শতরঞ্জি নামের অনেকগুলো ব্যাখ্যা আছে। একটা হচ্ছে যে ওই সময় আকবরের দরবারে শতরঞ্জি বা পাশা খেলা হতো । শতরঞ্জি খেলার সময় যে কাপড় বিছিয়ে খেলা হতো সেটাকে বলা হতো শতরঞ্জি । এ রকম কথা প্রচলিত আছে যে এখান থেকেই শতরঞ্জি নামটা এসেছে । আর এ বাদেও বলা হয় শতরঞ্জি মানে শত রঙের বাহার। তবে এ শতরঞ্জি শব্দটার উৎপত্তি ঠিক কোথায় তা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন ধরনের মতবাদ রয়েছে।
শতরঞ্জি মানে শত রঙের বাহার, অবশ্য নামের সঙ্গে মিল রেখে শত রং ব্যবহার হয় না, কয়েকটি রং দিয়েই তৈরি করা হয় শতরঞ্জি।
শতরঞ্জি তৈরির প্রধান উপকরণ
শতরঞ্জির প্রধান উপকরণ সুতলি। স্থানীয় বাজার থেকে কটন সুতা, পাট, শ্যানালসহ (উল-জাতীয়) বিভিন্ন ধরনের ফাইবার কিনে প্রয়োজনমতো রং করে শুকিয়ে নেয় তাঁতিরা। সুতা টানা দেওয়া হয় বাঁশের ফ্রেমে। টানার দৈর্ঘ্য সাধারণত ১০ থেকে ৩৫ ফুট হয়ে থাকে। সুতার বান্ডিল তৈরি করে শতরঞ্জি তাঁতে বা মেঝেতে বিছিয়ে ডিজাইন অনুযায়ী হাতে বোনা হয়। হাতের কৌশলই শতরঞ্জি নির্মাণের ভিত্তি তবে সুতার গাঁথুনি শক্ত করার জন্য পাঞ্জা (চিরুনির মতো দেখতে বিশেষ যন্ত্র) ব্যবহার করা হয়। এভাবে শতরঞ্জি তৈরিতে নিয়োজিত একজন শ্রমিকের এক বর্গফুট শতরঞ্জি নির্মাণে সময় লাগে এক থেকে তিন ঘণ্টা।
শিল্পীর নিপুণতায় শতরঞ্জির নকশা হিসেবে আঁকা হয় নারীর মুখ, পশুপাখি, রাখাল বালক, কলসি নিয়ে রমণী, নৌকা, রাজা-রানি, দেবদেবী, পৌরাণিক চরিত্র, প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রভৃতি। এ ছাড়া ক্রেতার চাহিদা অনুসারেও ডিজাইন করা হয়। এসব ডিজাইনে লাল, কালো বা নীল রঙের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত আয়তকার হয়ে থাকে, তবে বর্গাকার, ডিম্বাকারসহ যে কোনো আকৃতির হতে পারে শতরঞ্জি। সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যে ৩০ ইঞ্চি, প্রস্থে ২০ ইঞ্চি এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও প্রস্থ ২০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকলেও যে কোনো পরিমাপেই বোনা যায়। আকৃতির বিষয় নির্ভর করে ক্রেতার চাহিদার ওপর। বর্তমানে কারিগররা নিজেরাই ডিজাইন করেন বা ক্রেতাই ডিজাইন সরবরাহ করে থাকে ।
শতরঞ্জির ব্যবহার
যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠান সেটা বিয়েই হোক, অথবা জন্মদিন, কোনো অফিসের প্রোগ্রাম বা কলেজের প্রোগ্রাম এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ যেটাই হোক না কেন, অতিথিদের উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রেও রংপুরের ঐতিহ্যবাহী এই শতরঞ্জি খুবই জনপ্রিয়।
নানা ধরনের শতরঞ্জি
শতরঞ্জি বিক্রেতা বিপ্লবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাগলা-পাগলি ডিজাইন, চিকনা পাপোস, স্যেন পাপড়ি পাপোস, হাতির পায়ের ছাপ ডিজাইন, মরিচ খোপ ডিজাইন এর মধ্যে অন্যতম। সাধারণত বাংলাদেশের গ্রামবাংলার চিত্র বা বাংলার একেবারে প্রচলিত সহজ-সরল কিন্তু মনোমুগ্ধকর ছবি আঁকা হয় এ শতরঞ্জিতে। এ শতরঞ্জিগুলো অবশ্য বিভিন্ন মাপের হয়ে থাকে, তিন থেকে বারো ইঞ্চি পর্যন্ত। এ শতরঞ্জিগুলো অবশ্য বিভিন্ন মাপের হয়ে থাকে যেমন: ৩’’/৫’’, ৪’’/৬, ৫’’/৭’’ এবং ১০”/১২’’ । তবে সবশেষ মাপের শতরঞ্জির অর্ডারটা তুলণামূলকভাবে একটু কমই আসে।
বড় মাপের শতরঞ্জি সাধারণত খোলা উঠানে তৈরি করা হয়। বৃষ্টি হলেই তুলে নিয়ে আসতে হয়, নাহলে নষ্ট হয়ে যায় শতরঞ্জি। কিন্তু ছোটগুলো সব জায়গায় তৈরি করা যায়।
শতরঞ্জি এবং একজন সফিকুল আলম
আমাদের অন্যতম হস্তশিল্প এই বিলুপ্তপ্রায় শতরঞ্জিকে আবারও পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করেছিলেন কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের পরিচালক সফিকুল আলম। ১৯৯১ সালের দিকে মাত্র ২০ জন কারিগরকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে, উদ্দীপনা দিয়ে শুরু করা হয় শতরঞ্জির বুননের কাজ। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে এ শতরঞ্জির প্রচার ও প্রসার বাড়াতে থাকেন। এরপরে নিসবেতগঞ্জে বিসিকের বন্ধ থাকা ছোট্ট একটি কারখানা ভাড়া নিয়ে মাত্র ৫০ জন নারী ও পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলা হয় ‘শতরঞ্জি পল্লী’। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে শতরঞ্জির চাহিদা। দিক থেকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে শতরঞ্জির সুনাম। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এর আভিজাত্য। এখন কারুপণ্য এ পল্লীর সঙ্গে নেই ঠিকই কিন্তু এ পল্লীর মানুষগুলো নিজেদের মতো নিজেরা করে খেতে পারছে। একেবারে পড়াশোনা না জানা নারী-পুরুষও এ শতরঞ্জি শিল্পে কাজ করে নিজের জীবিকা নির্বাহের পাশপাশি দেশের শিল্প রক্ষায়ও কাজ করে যাচ্ছেন ।
কারুপণ্য লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সফিকুলের হাত ধরে রংপুরের পাঁচটি জায়গায় গড়ে উঠেছে শতরঞ্জির কারখানা- এগুলো হলো রংপুরের লাহিড়ির হাট, পদাগঞ্জ, পীরগাছা, রবার্টসনগঞ্জ ও কুড়িগ্রামের উলিপুর।
দেশ থেকে বিদেশে শতরঞ্জি
প্রায় হারিয়ে যাওয়া শতরঞ্জি এখন ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার ৩৬টি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। তবে বাইরের রপ্তানির শতরঞ্জি একটু আলাদা হয় ।
দরদাম
শতরঞ্জির সর্বনিম্ন দাম ৪২০ টাকা যেটার পরিমাপ দুই ফিট/তিন ফিট এবং সর্বোচ্চ ৭৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে যার পরিমাপ পাঁচ ফিট/ আট ফিট । আবার যদি রপ্তানি পণ্য স্যাগির কথা বলি সেক্ষেত্রে দাম কিছুটা আলাদা হবে। স্যাগির সর্বনিম্ন দাম ২০২৫ টাকা যার পরিমাপ আড়াই ফিট/ আড়াই ফিট এবং সর্বোচ্চ দাম ১২০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে যার পরিমাপ পাঁচ ফিট /সাড়ে সাত ফিট। এবং এ্যামির সর্বনিম্ন দাম ৩৫০ টাকা যার পরিমাপ ২০ ইঞ্চি/ ৩০ ইঞ্চি এবং সর্বোচ্চ দাম ৮৫০ টাকা যার পরিমাপ তিন ফিট/ সাড়ে চার ফিট পর্যন্ত হতে পারে।
শতরঞ্জিকে বাঁচাতে হলে
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অনেকে মনে করেন এ শতরঞ্জিকে টিকিয়ে রাখতে হলে আরো উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। সরকারি উদ্যোগ ও জনগণের স্বকীয় চেষ্টাই আরো এ রকম অনেক বিলুপ্তপ্রায় শিল্পকে আবারও বিশ্বের দরবারে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।