সাক্ষাৎকার
বাংলাদেশের মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছি : গৌতম ঘোষ
সম্প্রতি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ‘শঙ্খচিল’ ছবির জন্য। তাঁর পরবর্তী ছবির প্রাথমিক কাজ প্রায় শেষের দিকে, এটাও হবে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ছবি। কথা হচ্ছে পরিচালক গৌতম ঘোষকে নিয়ে। নতুন ছবির কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন এখন। এরই ফাঁকে তিনি কথা বলেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের সকল মানুষের পক্ষ থেকে আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। আপনার শেষ ছবিটি তো যৌথ প্রযোজনার ছবি এবং সফল ছবি।
গৌতম ঘোষ : অজস্র ধন্যবাদ শুধু নয়, আমার অনেক অনেক ভালোবাসা ও ধন্যবাদ রইল আপনাদের জন্য। আপনাদের ঐকান্তিক প্রয়াস ও ভালোবাসা না থাকলে এই কাজ সম্ভব হতো না। এত দশক ধরে আমি ছবি পরিচালনার কাজের সঙ্গে যুক্ত, আমি বরাবরই বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে সমানভাবে সাহায্য পেয়ে এসেছি। সেই ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘মনের মানুষ’ কিংবা ‘শঙ্খচিল’ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছি। আমি কৃতজ্ঞ বাংলাদেশের মানুষের কাছে।
প্রশ্ন : আপনার পরের ছবির বিষয়ও তো দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা। বলতে গেলে অনেকটাই ‘শঙ্খচিল’-এর মতো। আজকের দিনে এর প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?
গৌতম ঘোষ : প্রাসঙ্গিকতা তো নিশ্চয়ই আছে। কিছু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটা জাতিকে ১৯৪৭ সালে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। আর সেই দেশভাগের বিভাজনে পড়েছিলেন ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, এত জটিল সীমান্ত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমাদের ধর্ম এক, ভাষা এক, সংস্কৃতি এক। তবুও দেখুন, আমরা কোথায় যেন আলাদা হয়ে আছি। আমাদের মধ্যে একটা সেতু রচনা করা দরকার। শঙ্খচিলের মধ্য দিয়ে আমি সেটাই বোঝাতে চেয়েছি। শঙ্খচিল দুই বাংলার আকাশে সমানভাবে ওড়ে। তার কোনো সীমা নেই। আমার পরের ছবির বিষয়ও সেই রকম।
প্রশ্ন : আপনার মনের মানুষ ছবির বিষয়ও তো সেই রকমের ছিল।
গৌতম ঘোষ : আসলে আমরা তো একই সহিষ্ণু সমাজের ছবি ভাবি। তাই বারবার এই বিষয়টা আমার ছবিতে ফুটে ওঠে। শুধু মনের মানুষ ছবি কেন, পদ্মানদীর মাঝি ছবিটিও একই বিষয় ভাবনা থেকে উঠে এসেছিল।
প্রশ্ন : আজকের বাংলা ছবিতে তো সে রকম বিষয় দেখা যায় না। কারণ কী বলে আপনার মনে হয়।
গৌতম ঘোষ : কারণ আর কিছুই নয়, আমাদের ভোগবাদের প্রতি ভালোবাসা। সবাই বড়লোক হতে চায়। তাই ছবি মানে সেখানে উচ্চবিত্তদের দেখানো হয়। একটা ঘটনার কথা বলি, নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর যখন খুব ছোট ছিলেন তখন তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে বিদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি একটা ভ্রমণ কথা লিখেছিলেন, ‘সাত সাগরের পারে’। ওই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, আগামী বছরগুলোতে কোনো উৎসব অনুষ্ঠান করা যাবে না। তবেই এই দেশের গরিব মানুষদের দুই বেলা খাবার জুটবে। আমাদের সেই অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল।
প্রশ্ন : তাহলে আপনি কি মনে করেন, সিনেমা আজকের দিনে শুধুই বিনোদন?
গৌতম ঘোষ : না, সিনেমা একটি শিল্প। তার অনেক দায়িত্ব রয়েছে। সিনেমার অনেক সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে। আমার প্রতিটি ছবির মধ্যে দিয়ে আমি তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : আপনার পরের ছবির বিষয়টি কী একটু খুলে বলবেন?
গৌতম ঘোষ : আমার পরের ছবির বিষয় হলো পরিবেশ। এই ছবিও ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় তৈরি হচ্ছে। আমাদের নিজেদের কিছু স্বার্থে আমরা আজ পরিবেশ ধবংস করছি। আজ তিস্তার কী অবস্থা। একসময়ের স্রোতস্বিনী নদী আজ নালার মতো হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে গেলে এই তিস্তাকে দেখে আমার কান্না পায়। সেই সব বিষয়ই উঠে আসবে আমার পরের ছবিতে। আমার পরের ছবিতে মৃত্যুর বিষয়টা দেখবেন উঠে এসেছে নানাভাবে। অবশ্য শঙ্খচিল ছবিতেও উঠে এসেছে। এটা বঙ্গ জননীর মৃত্যু। পরিবেশের হাত ধরে, সাম্প্রদায়িকতার হাত ধরে, অর্থনৈতিকভাবে সব দিক দিয়ে মানুষের মনের মৃত্যু ঘটছে। সেই সব নিয়েই থাকবে পরের ছবি।
প্রশ্ন : বহু বছর ধরে আপনার এই সেলুলয়েডের দুনিয়ায় পথচলা। কীভাবে তা আপনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চান? আপনি নিজের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে কীভাবে দেখেন।
গৌতম ঘোষ : মানুষের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যখন আমি পেরিয়ে আসি, তখন আমি এক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। আমি চাই, সেই অভিজ্ঞতাকে পরবর্তী প্রজন্মে কাজে লাগাক। আমি মনে করি, এটাই মানুষের ধর্ম।
প্রশ্ন : পরবর্তীকালে আপনার কাছ থেকে আরো ভালো ভালো ছবি উপহার পাওয়ার আশা রইল।
গৌতম ঘোষ : আমার ও আমার টিমের পক্ষ থেকে রইল আপনাদের জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকবেন, আর আরো বেশি বেশি করে বাংলা ছবি দেখবেন।