সাক্ষাৎকার
আমাদের মনটা যাতে ভাগ না হয় : গৌতম ঘোষ
নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষ নির্মাণ করছেন নতুন চলচ্চিত্র ‘শঙ্খচিল’। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি এটি। আগামী পহেলা বৈশাখে (১৪ এপ্রিল) বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশে একসঙ্গে ছবিটি মুক্তি পাবে। ‘শঙ্খচিল’ ছবিটির নানা দিক নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন এই বিখ্যাত পরিচালক।
প্রশ্ন : দেশভাগের স্মৃতি নিয়ে ছবি নির্মাণের পরিকল্পনা কীভাবে এলো আপনার মনে?
উত্তর : আমার জন্ম ফরিদপুরে। যখন আমার জন্ম হয় ঠিক তখনই দেশভাগ হয়েছিল। মনে তখন প্রশ্ন জেগেছিল কেন, আমরা আলাদা হচ্ছি? এরপর ইতিহাস পড়েছি। যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি। এটা মূলত ইতিহাসের একটি অংশ। নানা কারণে এটা হয়েছে। এর পেছনে কে ঠিক, কে বেঠিক- এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বলতে পারেন, দেশ ভাগের স্মৃতি নিয়ে ছবি নির্মাণের ধারণা আমি শৈশব থেকেই একটু একটু লালন করে বড় হয়েছি।
যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন ব্যাপার হলো, আমরা একটাই জাতি- বাঙালি। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি। বাংলা ভাষায় আমরা স্বপ্ন দেখি। আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি এক। এদিকে বিরাট বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষাভাষীর লোক ছড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে যদি আমাদের আদান-প্রদান হয় তাহলে কিন্তু বাঙালি জাতি হিসেবে নিজেদের কৃষ্টি ও ইতিহাস আমরা ছড়িয়ে দিতে পারব।
প্রশ্ন : ‘এমন একটি পৃথিবী কল্পনা করো যেখানে কোনো দেশ নেই, জাতি নেই। যেখানে মানুষের জন্য আছে পরিপূর্ণ শান্তি’- জন লেননের এই গানটি ‘শঙ্খচিল’ ছবির মূল ভাবনা। এমন কথা আপনি ছবি শুরু করার আগে বলেছিলেন। গানটি নিশ্চয় আপনাকে ভাবিয়েছে।
উত্তর : এই গান সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। আমিও ছোটবেলায় এই গান শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছি। সত্যিই তো এটা মানুষের স্বপ্ন। মানুষ কিন্তু আত্মসামাজিক , রাজনৈতিক ও নানান কারণে বিভিন্ন জাতকে ভাগ করে রেখেছে। একটা সময় ন্যাচারাল বাউন্ডারি ছিল। পরবর্তীকালে সমাজ যত জটিল হয়েছে ভাগাভাগি তত বেড়েছে। মানুষ সবসময় মুক্ত কিছু চায়। মুক্ত স্বপ্ন খুঁজে ফেরে মানুষ। ‘শঙ্খচিল’ ছবির সাথে লেননের গানের মিল এখানেই।
প্রশ্ন : ছবিটিতে সীমান্তের গল্প রয়েছে। শুনেছি ছবি নির্মাণের আগে সীমান্ত অঞ্চলে আপনি গেছেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলুন।
উত্তর : সীমান্ত অঞ্চলে গিয়ে অনেক সত্য আমি অনুসন্ধান করতে পেরেছি। সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করেছি। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। তাদের আমি অনেক প্রশ্ন করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি তাদের মতাদর্শ।
প্রশ্ন : সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে মূলত আপনার কী নিয়ে আলাপ হয়েছিল? ছবিতে এর প্রভাব কতটুকু পড়েছে?
উত্তর : অনেক কিছু নিয়েই। দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নানা সমস্যা রয়েছে। এটা এমন একটা আর্টিফিশিয়াল সীমান্ত- এর সম্পর্কে মন্তব্য করা মুশকিল। মাঝে মাঝে সীমান্তরক্ষীদের সহিংসতায় শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের সঙ্গে তারা সংযোগ রেখে চলে। আবার ভারতের অনেক সীমান্তরক্ষী আছে যারা বাংলা ভাষা জানে না। তখন অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয় তারা। দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনী বেশ চাপে থাকে। এটা এমন একটা বর্ডার যেখানে একটা বাড়ির মধ্যে দুই দেশ রয়েছে। বিষয়টা এ রকম, রান্না ঘর এ দেশে তো, শোবার ঘর অন্য দেশে। এগুলো খুব জটিল ব্যাপার। ছবিতে সীমান্ত এলাকার এসব নিয়েই বেশ কিছু ঘটনা আছে তবে ছবির গল্প এখনকার প্রেক্ষাপটে নির্মিত। আর ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কিছু স্মৃতি আছে মাত্র।
প্রশ্ন : সীমান্ত এলাকায় তো অনেক অপরাধ কর্মকাণ্ড হয়। আপনার ছবিতে কী এসব উঠে এসেছে?
উত্তর : একদম নেই। আমি শুধু দেখাতে চেষ্টা করেছি আমাদের মনটা যাতে ভাগ না হয়। আমাদের মন থাকবে মুক্ত শঙ্খচিলের মতো। ভাষা-সংস্কৃতিও থাকবে অভিন্ন। এখন পুরো বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন হচ্ছে। বাঙালি জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য গর্বের।
প্রশ্ন : আপনার ছবিতে শিশুশিল্পী সাঁঝবাতির মধ্যে ফেলানীর কোনো প্রভাব পড়েছে কী?
উত্তর : না, প্রত্যক্ষভাবে এ রকম কোনো ঘটনা এখানে আনা হয়নি।
প্রশ্ন : ছবির অভিনয়শিল্পীদের প্রসঙ্গে কিছু বলুন।
উত্তর : ছবির প্রতিটি শিল্পী নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। পর্দায় তাঁদের অভিনয় ন্যাচারাল মনে হবে।
প্রশ্ন : আপনার নির্মিত প্রতিটি ছবিই প্রশংসিত হয়েছে, পেয়েছে নানা পুরস্কার। তারপরও জীবনে কোনো অতৃপ্তি আছে কী?
উত্তর : অতৃপ্তি নেই। পুরস্কার পেলে আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন তাঁরা অনেক খুশি হন। এটা অনেক আনন্দের ব্যাপার। আমার দায়িত্ব হচ্ছে, যে কাজটা করব সেটা মন থেকেই করব।