‘চরিত্রের প্রয়োজনে কলকাতার শিল্পী নিয়েছি’
বিষয়ভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড পরিচিত এক নাম। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার। স্বপ্ন দেখেন একদিন তাঁর চলচ্চিত্র অস্কার জয় করবে। সম্প্রতি তিনি শেষ করেছেন নতুন চলচ্চিত্রের কাজ। অনলাইনে প্রথম পোস্টার মুক্তি পেয়েছে। নতুন চলচ্চিত্র,ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং বর্তমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে।
চলচ্চিত্রের নাম ‘বাষ্পস্নান’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘শেষ কথা’ রাখা হয়েছে। এই পরিবর্তনের পেছনে বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে কি?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : বিশেষ কোনো কারণ নেই। আসলে ‘বাষ্পস্নান’ শব্দটার সঙ্গে অনেকে পরিচিত নন। শুটিং শুরুর পর থেকেই কয়েক মাস ধরে আমাকে ঘুরে ফিরে কেবল একটি প্রশ্ন করছে মানুষ যে, ‘বাষ্পস্নান’ শব্দের অর্থ কী? কোনো নিরক্ষর লোক যে এমন প্রশ্ন করছে তা নয়। অনেক শিক্ষিত লোক এমন প্রশ্ন করছে। অনেকে বলেছে ছবির নাম সুন্দর। কিন্তু পরক্ষণে তারা নামের অর্থ জানতে চাইছে। কেউ কেউ নিজের মতো ব্যাখা করেছে নামটিকে। তাই বোঝার সুবিধার ক্ষেত্রে অনেকটা বাধ্য হয়ে নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে।
চলচ্চিত্রের কাহিনী সম্পর্কে জানতে চাই।
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : গল্প এখন পরিপূর্ণভাবে বলা যাবে না। তবে সংক্ষেপে বলতে পারি। আমি ছবির গল্পে তিনটি গল্পকে প্যারালালভাবে একত্রিত করেছি। একটি হলো একদল ছেলেমেয়ে আমাদের দেশের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে সন্ধান করছে। সেটা হতে পারে যাত্রা,পুতুল নাচ,সার্কাস ইত্যাদি। তাদের একটি হেরিটেজ প্রোমোশন সেন্টার আছে। সেটার মাধ্যমে তারা নিজ উদ্যোগে কাজ করে। তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পরিদর্শন করছে। আরেকটা হলো এই ছেলেমেয়ের টিমটা যখন অন্য এক নতুন জায়গাতে গিয়ে পড়ল। সেখানে গিয়েছে তারা একটি বিষয়কে সন্ধান করতে। কিন্তু একসময় জানতে পারে তারা যে বিষয়টাকে সন্ধান করতে এসেছে সেটা তাদের ভুল হয়েছে। এই জায়গাটি হলো কাঙাল হরিনাথ বা হরিদাসীর জায়গা। তখন তারা হরিদাসী সম্পর্কে জানতে চাইল। এই গল্প চলে যায় তখন দেড়শ-দুইশ বছর পেছনে। তারপর কাঙাল হরিনাথ উঠে আসে। হরিদাসী উঠে আসে। তাঁদের একটি প্রেমের ঘটনা খুব সংক্ষেপে স্পর্শ করে যায়। এই গেল দুটি গল্প। তৃতীয় এবং শেষ গল্পটি হলো বর্তমান আধুনিক সমাজের এক ছেলেমেয়ের প্রেমের গল্প থাকে। এই গল্পটার সমন্বয় ঘটে দেড়শ দুইশ বছর আগের গল্পে। ওই গল্পের পরিণতি যেভাবে হয়েছিল, শেষ গল্পের পরিণতি অনেকটা সেভাবে হয়। এভাবে মূলত সাজিয়ে গুছিয়ে ছবির কাহিনী এগিয়ে যায়।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। সেটার কাজ কত দূর?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পরপর ওটা আরম্ভ করে দেব । সেটা খুব দ্রুত সময়ে আরম্ভ হবে।
শিল্পী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কলকাতার শিল্পীদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণ কী?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : এখানে আমার কোনো কলকাতা প্রীতি কাজ করেনি। শুধু চরিত্রের প্রয়োজনে কলকাতার শিল্পী নিয়েছি। আমার ‘শেষ কথা’ চলচ্চিত্রে সমদর্শীকে নেওয়ার একমাত্র কারণ তাঁর অভিনয়। সমদর্শীর ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছবি দেখে তাঁকে আমার ছবিতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তাঁর অভিনয়, বাচনভঙ্গি আমার ভালো লেগেছে। তাই আমার মনে হয়েছে গল্পের চরিত্রটি ওঁর সাথে যায়। এ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আপনি যে ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন সেই ধারার চলচ্চিত্র বাংলাদেশে খুব একটা জনপ্রিয় নয়। তবু কেন একের পর এক এই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন ? দিনশেষে ব্যবসাটাই তো আসল।
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : জনপ্রিয়তা এক জিনিস। আমার নির্মিত ছবিগুলো আরেক জিনিস। সত্য কথা বলতে আমার চলচ্চিত্র যদি আপনি জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে বিচার করেন তাহলে এগুলোকে আপনি সিঁকেয় তুলে রেখে দিতে পারেন। তবে যখন আপনি বার্তা প্রধান চলচ্চিত্রের মানদণ্ডে বিচার করবেন তখন আমার ছবি হবে সবথেকে প্রয়োজনীয় ছবি। ‘নাচোলের রানী’ থেকে আরম্ভ করে আমার সবকটি চলচ্চিত্র ইস্যু ভিত্তিক। আমি ‘অন্তর্ধান’ চলচ্চিত্রের উদাহরণ টেনে যদি বলি তাহলে বলা যায়, এখানে পদ্মার পানি সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরেছি। যত দিন যাচ্ছে ততই পদ্মা মরে যাচ্ছে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে পানি সংকটে ভুগছি। আজকে নদীমাতৃক বাংলাদেশ স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি এই ক্রাইসিস থেকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রশংসা লাভ করেছি। টাইমস অব ইন্ডিয়া, স্টেটমেন্ট নিউজ করেছে। আমি সবসময় চিন্তা করি চলচ্চিত্রে দেশের কথা বলব, মানুষের কথা বলব। সেক্ষেত্রে আমি ব্যবসটাকে খুব বড় করে দেখি না।
এই ধরনের চলচ্চিত্র বুকিং এজেন্টরা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। কারণ হিসেবে তারা চাহিদা না থাকার কথা বলে। আদৌ কি তাই?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : চাহিদা নেই এটা তাদের মনগড়া কথা। একটি ছবি নির্মাণের পর তারা হলে প্রদর্শনের আগেই বলে দিচ্ছে চাহিদা নেই। এটা ঠিক না। আগে তো চাহিদা তৈরি করতে হবে। সেজন্য তাদের এমন ধরনের চলচ্চিত্র সাধারণ দর্শকদের দেখার সুযোগ করে দিতে হবে। এখানে তাদের দায়বদ্ধতার বড় অভাব। আমার কথা ধরুন। আমি পদ্মার পানি সমস্যা নিয়ে ছবি নির্মাণ করেছি। এখন পদ্মা পাড়ের হলগুলোতে যদি ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে মানুষ তো দেখবে। তারা বুঝতে পারবে আমরা কতটা পানি সমস্যার ভেতর আছি। আসলে হল মালিকদের সদিচ্ছার বড় অভাব।
কখনো মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করার পরিকল্পনা আছে?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : আমি তো মূলধারার চলচ্চিত্রই বানাই। আপনি যেটাকে মূলধারা বলছেন সেগুলোর গল্পে প্রেম আছে, মারামারি আছে। আমার ছবিতেও তাই আছে। তবে আইটেম সং কিংবা উদ্ভট মারামারি নেই। এসব না থাকলে যদি মূলধারার চলচ্চিত্র না হয় তাহলে আমার ছবি মূলধারার বাইরে। আমি ওই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাই না। তবে আমার নির্মিত সব চলচ্চিত্রই মূলধারার।
অনুদানের চলচ্চিত্র বিষয়ে আসতে চাই। অনেকে অভিযোগ করেন অনুদানের টাকা যথেষ্ট নয়। এটা দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ শেষ করা সম্ভ নয়। আপনি কি তাদের সঙ্গে একমত?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : আমি অনুদানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করিনি। এ বিষয়ে বলতে পারব না। তবে যারা অনুদানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করার জন্য আবেদন করে অনুদান পেতে, তারা কিন্তু এটা জেনেই করে যে, এখানে টাকার পরিমাণ কম। যেহেতু তারা জেনে বুঝে সব করে, সেহেতু এটা নিয়ে অভিযোগ করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না।
আপনাকে কখনো অনুদানের চলচ্চিত্র নির্মাণে দেখা যাবে কী?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : আপাতত সেই ইচ্ছে নেই।
সম্প্রতি একটি অনুদানের চলচ্চিত্র ভিনদেশি শিল্পী, সংগীত এবং পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ দেশের বাইরের ছিল। সরকারি অনুদানের টাকা দেশের বাইরে চলে যাওয়াটা কতটুকু ইতিবাচক বা নেতিবাচক?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : চরিত্রের প্রয়োজনে শিল্পী বা অন্যকিছু বাইরের হতে পারে। তবে যেহেতু অনুদানের ছবি দেশের, সরকারের টাকা সেহেতু এটাকে ইতিবাচক বলব না। চাইলে দেশের ভেতর থেকে সব করা যেত। আমার চলচ্চিত্র তো সব দেশের আর্টিস্ট। দেশের পোস্ট প্রোডাকশন করা। সেগুলো তো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের আরো ভাবা উচিত।
বর্তমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : অনেককে বলতে শুনি চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালো না। কিন্তু তবুও একের পর এক চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে। চলচ্চিত্রের অবস্থা যদি ভালো না হতো তাহলে তো নতুন পরিচালক আর প্রযোজক আসত না।
মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র তো ব্যবসা করতে পারছে না। চলতি বছর একটি চলচ্চিত্রও লগ্নিকৃত টাকা ফেরত আনতে পারেনি।
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : তা ঠিক। এজন্য মানুষকে হলে আনতে হবে। হলের পরিবেশ ভালো করতে হবে। আগে তো পরিবার নিয়ে হলে যেতাম। এখন তো যেতে পারি না। সেখানে বসে সিনেমা দেখার পরিবেশটা তো থাকতে হবে। আমাদের সময়ে বিনোদনের খুব একটা মাধ্যম ছিল না। তাই বিনোদনের জন্য হলে আসত। এখন বিনোদনের অনেক মাধ্যম। তা ছাড়া মানুষের তিন ঘণ্টা বসে সিনেমা দেখার সময় নেই। কর্মসংস্থান বাড়ছে। বেকার সময় কাটাতে কেউ চায় না। ছবির দৈর্ঘ্য কমিয়ে দুই ঘণ্টার স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাটে আনতে হবে।
এখন যৌথ প্রযোজনার ছবি হচ্ছে। কতটুকু লাভবান হবে দেশীয় চলচ্চিত্র?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : যদি সঠিকভাবে যৌথ প্রযোজনা হয় সেটা লাভবান হবে। তবে ইদানীং শুনছি সঠিকভাবে যৌথ প্রযোজনা হচ্ছে না। নামমাত্র এ দেশের শিল্পী থাকছেন। বাকি সব অন্য রাষ্ট্রের। যৌথ প্রযোজনা মানে তো সবকিছুতে সমান সমান থাকতে হবে।
সঠিক উপায়ে যৌথ প্রযোজনা হচ্ছে না জেনেও ছবিগুলো সেন্সর ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে।
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : তারা হয়তো কাগজপত্রে সব সঠিক দেখাচ্ছে। যার কারণে ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে।
কাগজপত্র আর পর্দায় অমিল তো সহজে দেখা যায়। এটা কি সেন্সর বোর্ড কর্মকর্তাদের বোঝার ক্ষমতা নেই?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : ব্যাপারটি নিয়ে কথা না বলাই ভালো। এটা নিয়ে আমার নিজের মেধাও কাজ করছে না।
এফডিসির সেন্সরশিপ নিয়ে মাঝেমধ্যে বিতর্ক ওঠে। আপনার মতে সেন্সরশিপের ধরন কেমন হওয়া উচিত?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : আমি তো ভুক্তভোগী একজন মানুষ। সে হিসেবে বলব, সেন্সর বোর্ডকে কিছু কিছু বিষয়ে আরো নমনীয় হতে হবে। বোর্ড থেকে নির্মাতাদের এমন কিছু শর্ত দেওয়া হয় যা একজন নির্মাতার মাথার উপরে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়। এসব বিষয়ে শিথিল হতে হবে।
একটু ভিন্ন প্রশ্ন করতে চাই। ‘অস্কার’ জয়ের স্বপ্ন দেখেন?
সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড : কেন দেখব না? সব নির্মাতাই চায় চলচ্চিত্রের সব থেকে সম্মানের এই পুরস্কারটি নিজের ঘরে আসুক। আমিও চাই। তবে পূরণ হবে কি না বলতে পারছি না।