হাসি ফোটাচ্ছে দামিহার তুষ-হারিকেন

কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার দামিহা গ্রামের হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর তুষ-হারিকেন পদ্ধতি বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এ পদ্ধতিতে ফোটানো হাঁসের বাচ্চার মান ভালো হওয়ায় চাহিদাও রয়েছে ব্যাপক। এতে উদ্যোক্তা, পাইকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টরা লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন। বদলে যাচ্ছে এলাকার অর্থনৈতিক চিত্র।
দামিহার মো. আবুল হোসেন এই পদ্ধতি শুরু করেন ছোট পরিসরে। গত এক যুগে এ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়েছে সারা গ্রামে। বর্তমানে এটি শুধু দামিহা গ্রামে সীমাবদ্ধ নয়, ছড়িয়ে পড়েছে রাহেলা, কাচিলাহাটি গ্রামসহ আশপাশের এলাকায়। urgentPhoto
তাড়াইল উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে এ ধরনের হ্যাচারি আছে এখন ৯০টির মতো। এসব হ্যাচারি থেকে প্রতি মৌসুমে এক কোটিরও বেশি হাঁসের ছানা উৎপাদিত হয়। তুষ-হারিকেন পদ্ধতির সুবিধা হচ্ছে, এতে খরচ কম হয়। বাচ্চা ফোটানো, বিক্রি, ব্যবসা ও পরিবহনের সঙ্গে জড়িত হাজার খানেক বেকার যুবক, নারী ও এলাকার মানুষ। এতে ওই এলাকায় গত এক যুগে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এসেছে গতি। স্বাবলম্বী হয়েছেন অসংখ্য মানুষ।
মো. আবুল হোসেন জানান, ১৯৯১ সালে সাভার যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম ফোটানোর ওপর মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালে কিশোরগঞ্জের সরকারি হাঁস-মুরগির খামারে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর নিজ দামিহা বাজারে শুরু করেন তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম ফোটানোর কাজ। প্রথমদিকে মুনাফা কম হলেও হাল ছাড়েননি। তাঁকে অনুসরণ করে গ্রামের আরো ৩০-৩৫ জন শুরু করেন ওই পদ্ধতিতে হাসের ডিম ফোটানোর কাজ। প্রায় দুই বছর পর প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি আয়ত্ত করেন ওই উদ্যোক্তারা। এরপর তাঁরা সাফল্যের দেখা পান। বিষয়টি এলাকায় রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে। আরো মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত হন।
উদ্যোক্তারা জানান, ‘সিলিন্ডার’ নামে পরিচিত বিশেষ পাত্র, তুষ ও হারিকেন এ পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়। কাঠ, বাঁশ ও টিন দিয়ে ওই বিশেষ পাত্র ও মাচা তৈরি করা হয়ে থাকে। লেপ, রঙিন কাপড়সহ আনুষঙ্গিক কিছু উপকরণও লাগে। ডিম সংগ্রহের পর জীবাণুনাশক দিয়ে সেগুলো ধুয়ে বাছাই করে রোদে শুকানো হয়। এরপর ডিমগুলো রঙিন কাপড়ের থলেতে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভরে সিলিন্ডারের ভেতরে রাখতে হয়। এক সিলিন্ডারে ডিম ও অন্য সিলিন্ডারে হারিকেন রেখে প্রতি তিন ঘণ্টা পর পর তাপ এবং তাপবিহীন অবস্থায় লেপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। পর্যায়ক্রমে এই প্রক্রিয়া ১৭ দিন ধরে চলে। এরপর ডিমগুলো মাচার ওপর সাজিয়ে হালকা কাপড়ে ঢেকে ১১ দিন রাখা হয়। ১২ দিনের মাথায় একের পর এক ডিম ফুটে হাঁসের বাচ্চা বেরোতে থাকে। এভাবে ডিম ফোটাতে ২৮ দিন সময় লাগে।
দামিহাসহ আশপাশের গ্রামের প্রতিটি হ্যাচারিতে এ পদ্ধতিতে প্রতি মাসে পর্যায়ক্রমে ন্যূনতম তিন থেকে সর্বোচ্চ চারবার ডিম ফোটানো হয়ে থাকে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত প্রায় সোয়া দুই মাস বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ থাকে। এ ছাড়া বছরের বাকি সময় ডিম ফোটানোর কাজ অব্যাহত থাকে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাস ডিম ফোটানোর জন্য উৎকৃষ্ট সময়। ৫০টি হ্যাচারি থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে দুই লাখ ২৫ হাজার বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। ডিম পেতে খামারিদের অনেক সময় অগ্রিম দাদন দিতে হয়।
এই প্রক্রিয়ায় প্রতি ১০০ বাচ্চা উৎপাদনে এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত খরচ। প্রতি ১০০ ছানা বিক্রি হয় দুই হাজার ১০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়। এভাবে প্রতি হাজার বাচ্চা উৎপাদনে গড়ে লাভ হয় ৬০০-১০০০ টাকা। মৌসুম ভেদে এ লাভের পরিমাণ কম-বেশি হয়। একদিন বয়সী হাঁসের বাচ্চাগুলো পাইকাররা কিনে নেন। এরপর সেগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হয়। তাপমাত্রার ওঠানামা হলে মাঝেমধ্যে সব ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই ঝুঁকি এড়াতে সব সময় সতর্ক থাকতে হয় হ্যাচারির মালিক ও শ্রমিকদের।
তুষ-হারিকেন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন দামিহা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিতাংশু চৌধুরী। তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানোর ফলে এলাকার পরিচিতি যেমন বেড়েছে, বিপুল মানুষের বেকারত্ব দূর হয়েছে। গ্রামে অর্থনৈতিক গতি এসেছে। আগে এলাকায় কোনো শিল্প ছিল না। বর্তমানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগই আগে বেকার ছিলেন।
একই গ্রামের নূরুল কবীর বলেন, এ শিল্পের জন্য সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। এটি করা গেলে ক্ষুদ্র এই শিল্পের আরো প্রসার ঘটবে। হাঁসের বাচ্চা রফতানিও করা যাবে।
নেত্রকোনার খালিয়াজুরির আবদুল আলী (৪২) জানান, সব খরচ বাদে তাদের প্রতি বাচ্চাতে এক টাকা-দেড় টাকা লাভ হয়ে থাকে। যত বাচ্চা সরবরাহ করা যায়, ততই লাভ বাড়ে। এ ব্যবসায় পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে বলে জানান তিনি।
দামিহা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর ভুঁইয়া বলেন, এ পদ্ধতি সারা দেশের জন্য একটি মডেল। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এটি ছড়িয়ে দিতে পারলে সারা দেশের যুব সমাজ এর মাধ্যমে উপকৃত হবে।
এরই মধ্যে দামিহা ইউনিয়ন হ্যাচারি মালিক সমিতি গঠিত হয়েছে। আবুল হোসেন এই সমিতির সভাপতি। আবুল হোসেন বলেন, সহজ শর্তে স্থানীয় ব্যাংক বিশেষ করে কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হলে এ শিল্প আরো এগিয়ে যাবে। লাভজনক এই শিল্পে ঋণ দিলে ব্যাংকও লাভবান হবে।
তাড়াইলের তুষ-হারিকেন পদ্ধতিতে হাঁসের বাচ্চা উৎপাদনকে নতুন কৃষি ব্যবসার মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ছাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলে এই হ্যাচারিশিল্প আরো সমৃদ্ধ হবে।