ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি তৈরিতে প্রভাব বিনিয়োগ চাইল ভিসিপিয়াব
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইক্যুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ভিসিপিয়াব) যৌথভাবে ‘প্রভাব বিনিয়োগ : কোভিড পরবর্তী স্থিতিশীল অর্থনীতির লক্ষ্যে’ শীর্ষক ওয়েবিনার আয়োজন করেছে।
বুধবার (৬ অক্টোবর) রাতে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিজ কমিশনের (আইওএসকো) উদ্যোগে বিশ্বজুড়ে সপ্তাহব্যাপী ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ ২০২১’ উদযাপনের অংশ হিসেবে অনলাইনে এই ওয়েবিনার আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রভাব বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমসের সমৃদ্ধিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন উদ্যোগের বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
প্রভাব হচ্ছে যে কোনও ব্যবসা বা উদ্যোগ পরিবেশগত (ইনভায়রনমেন্টাল), সামাজিক (সোশ্যাল) এবং সুশাসন (গভর্নেন্স) বা সংক্ষেপে ইএসজির মাধ্যমে কতটুক কল্যাণ সাধন করছে তার মানদণ্ড। শুধু ক্ষতিকারক বিষয়গুলোকে কমিয়ে আনা নয়, বরং উদ্যোক্তাদের প্রতিভা এবং উদ্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সক্রিয়ভাবে ভালো ফলাফল তৈরি করার নামই হলো প্রভাব বা ইমপ্যাক্ট। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সময় ইএসজি উদ্যোগগুলোকে মাথায় রাখতে হবে, যেন উদ্যোক্তাগণ উদ্দেশ্য-চালিত ব্যবসার পরিচালনায় আগ্রহী হন, যা কিনা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে সাহায্য করবে।
আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এককভাবে পৃথিবীর সব হুমকি মোকাবিলা করতে পারবে না। মানুষের তৈরি সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার জন্য সরকারের একার প্রচেষ্টাও যথেষ্ট নয়। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী একটি নতুন সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তার জন্ম হয়। এই নতুন সিস্টেমই হলো ‘প্রভাব বিনিয়োগ বা ইমপ্যাক্ট ইনভেস্টমেন্ট’। এটি সরকার, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, জনকল্যাণ এবং সামাজিক উদ্যোগের সাথে ব্যবসা, বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তাদের সেতুবন্ধন তৈরি করে। পুঁজি এবং উদ্ভাবনাকে একত্র করে ইএসসি সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য ‘প্রভাব বিনিয়োগ বা ইমপ্যাক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ অতীব জরুরি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলি রুবায়েত-উল-ইসলাম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল অ্যান্ড প্রাইভেট ইক্যুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ভিসিপিয়াব) সভাপতি শামীম আহসান এবং সঞ্চালনা করেন লাইট ক্যাসেল পার্টনারস লিমিটেডের পরিচালক শাকওয়াত হোসেইন।
পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, মানুষের তৈরি সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো সমাধান করা সরকারের একার পক্ষে সহজ নয়। সরকার, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, জনকল্যাণ এবং সামাজিক উদ্যোগের সাথে ব্যবসা, বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তাদের সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে এবং সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনীমূলক উদ্যোগ নিতে হবে।
বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলি রুবাইয়্যাত-উল-ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতি। আমাদের অর্থনীতির জন্য প্রভাব বিনিয়োগ খুবই জরুরি; কারণ, এটি আর্থিক আয়ের পাশাপাশি ইতিবাচক সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব তৈরি করে। বাংলাদেশ এখন তার দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির কারণে এ রকম অবস্থানে রয়েছে যে এটি বিশ্বের প্রভাব বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থল হতে পারে।
ভিসিপিয়াব সভাপতি শামীম আহসান বলেন, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে, বিশ্বের অধিকাংশ কোম্পানি অনতিবিলম্বে প্রভাব-ভিত্তিক ব্যবসা শুরু করবে এবং বিশ্বের জনসংখ্যার বেশিরভাগই প্রভাব-ভিত্তিক কোম্পানিগুলো পণ্য এবং সেবাসমূহ গ্রহণ করবে। এটি কোভিড-১৯ এর মতো মহামারির ঝুঁকিপূর্ণতা হ্রাস করতে এবং একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে আমাদের সাহায্য করবে। প্রভাব বিনিয়োগ যেন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়, তাই সরকারি বিভাগ এবং সংস্থাগুলো যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, আইসিটি মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উচিত হবে এই ইকোসিস্টেমকে অনুকূল নীতিমালা এবং কর প্রণোদনা দিয়ে সহায়তা করা জরুরি।
বিএসইসি কমিশনার প্রফেসর ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা যদি আমাদের পৃথিবীকে একটি টেকসই অবস্থানে দেখতে চাই তাহলে বৈশ্বিক প্রভাব বিনিয়োগের চাহিদানুসারে আগামী ২০ বছরের মধ্যে অতিরিক্ত ২০ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। আমাদের সব পরিকল্পনায় দেশের গ্রামীণ অঞ্চলকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া অতীব জরুরি। উদ্ভাবন ও আমাদের গ্রামীণ অঞ্চলের সাথে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে মধ্যম-আয়ে উন্নীত করতে সক্ষম হব।
বিএসএসি কমিশনার প্রফেসর ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। ১৯৯১ সালের তুলনায় বর্তমানে আমাদের অর্থনীতির পাঁচ গুণ অধিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রভাব বিনিয়োগের সুবিধা উপলব্ধি করতে আমাদের একটি প্রাণবন্ত পুঁজিবাজার দরকার। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইক্যুইটি খাতের সহায়তা বাংলাদেশ থেকেও টেসলা, ফেসবুক, গুগলের মতো কোম্পানিগুলো উঠে আসতে পারে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। প্রত্যেক দেশকেই বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব কমাতে এগিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই পৃথিবী রেখে যেতে আমাদেরকে খনিজ সম্পদ ব্যবহারে আরও সচেতন হতে হবে।
ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মো. হামিদ উল্লাহ ভুইয়া বলেন, গত কয়েক বছরে প্রভাব বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশাল প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে অগ্রযাত্রা এবং কৃষি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা এবং ফিনটেক খাতের পরিপূর্ণ সম্ভাবনার ফলে বাংলাদেশ প্রভাব বিনিয়োগের জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সভাপতি মাহমুদুল হাসান খসরু এফসিএ বলেন, আমরা যখনই কোনও পরিকল্পনা করব, সেটির সাথে ইএসজি উদ্যোগের সম্পৃক্ততা থাকা প্রয়োজন। প্রযুক্তি, বিশেষ করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এই সম্পৃক্তটা সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইক্যুইটি খাত যৌথভাবে প্রভাব উদ্যোগে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক নুরুন নাহার বলেন, বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা এখন ব্যবসার ঝুঁকি ও মুনাফার পাশাপাশি তা পরিবেশগত, সামাজিক এবং সুশাসনের মাধ্যমে কতটুক কল্যাণ সাধন করছে, তাও বিবেচনা করেন। এই কারণেই অনেক কোম্পানি এখন আর্থিক বিবরণীর পাশাপাশি তাদের ইম্প্যাক্ট ওয়েটেড স্টেটমেন্ট বা প্রভাব-ভিত্তিক বিবরণীও প্রস্তুত করছে। পরিবেশবান্ধব ব্যবসায়ের প্রসারে বাংলাদেশ ব্যাংক খুবই কম সুদে সবুজ পণ্য ও উদ্যোগে ফাইন্যান্স সহায়তা দিচ্ছে।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএসিইসির নির্বাহী পরিচালক শফিউল আজম, ভিসিপিয়াবের সহ-সভাপতি জিয়া ইউ আহেমদ, সিফ বাংলাদেশ ভেঞ্চারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ মাহমুদ, মসলিন ক্যাপিটাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান এ হাফিজ, অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এইচ আসাদুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির আহমেদ প্রমুখ।