আবুল বরকত প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণা
১৯৫২ সালে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবিতে মুখর হয়ে উঠে। জারি হয় ১৪৪ ধারা । ছাত্রজনতার স্লোগানে প্রকম্পিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় কাম্পাস।পুলিশ বাধা দেয় । পুলিশ ঢুকতে চায় ছাত্রদের হোস্টেলে ।কিন্তু ছাত্রদের বাধার কারণে পুলিশ ঢুকতে পারেনি। হোস্টেলে ঢুকতে না পেরে পুলিশ গুলি চালায় হোস্টেল চত্বরে । এই সময় আবুল রবকত এক বন্ধুর দিকে যাচ্ছিলেন।পুলিশের গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়েন মাটিতে । অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে থাকে । এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় শহীদ হন আবুল রবকত । আর তাঁর স্মৃতিচারণা করেছেন ড. রফিকুল ইসলাম এবং প্রয়াত হাসান হাফিজুর রহমান ও গাজীউল হক।
হাসান হাফিজুর রহমান
'সে সময় কিছুসংখ্যক লোক আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে পুলিশের ইনফরমার হিসেবে কাজ করলেও করতে পারে। প্রায় সব আন্দোলনেই এ ধরনের কিছু কিছু লোক থাকে যাদের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেওয়া। তবে কিছুদিন আগে 'বিচিত্রা' পত্রিকায় বরকতকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার আমি তীব্র প্রতিবাদ করি। আমি যতটুকু জানি, বরকত নন-পলিটিক্যাল ছাত্র ছিল। বরকত আমার বন্ধুস্থানীয় ছিল। আমার সাথে সেও পলিটিক্যাল সায়েন্সে ভর্তি হয়েছিল। বরকত অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ছেলে ছিল। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে বরকত জড়িত ছিল বলে আমার জানা নেই।'
সূত্র : একুশে সংকলন '৮০ : স্মৃতিচারণ
গাজীউল হক
'মেডিকেল কলেজের গেট দিয়ে ছাত্ররা বেরোবার চেষ্টা করলে সেখানে পুলিশের বাধা এলো। লাঠিচার্জ হলো। পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের প্রায় খণ্ডযুদ্ধ শুরু হলো। এ সময়ে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে এবং পুলিশের গুলিতে বরকত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে যায়। বরকত ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ শেষবর্ষের ছাত্র। দীর্ঘদেহী, বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘদেহী। শ্যামলা ছিপছিপে একহারা গড়নের। মুখটা শিশুর মতো সরল। আমাদের সঙ্গে বিশেষ করে হাফিজুর রহমান, আবু নাছের ওয়াহেদ প্রমুখের সঙ্গে বেশ হৃদ্যতা ছিল। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খুব সক্রিয় ছিলেন বলে জানি না। তবে ঐদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং শামসুল হক যখন রেস্তোরাঁয় বসে তাঁর বক্তব্য পেশ করছিলেন তখন বরকতও উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। পরে বন্ধু ড. রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে বরকতের গুলি খাওয়ার ঘটনা শুনেছিলাম। পুলিশ সরাসরি গুলি চালিয়েছিল এবং বরকত গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। বরকতকে ছেলেরা ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ড. রফিকুল ইসলাম (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক) বরকত যে বাসায় থাকত সেখানে খবর দেন।'
সূত্র : একুশের সংকলন' ৮০: স্মৃতিচারণ।
ড. রফিকুল ইসলাম
'শহীদ বরকত গুলিবিদ্ধ হলে তাঁর বন্ধু মিয়া মোহন ( এখন ঢাকা হাইকোর্টে ওকালতি করেন) তাঁকে বহন করে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান। তখন মিয়া মোহন আমাকে বলেছিলেন বরকতের বাড়িতে খবর দিতে, তিনি আমাকে বরকতের বাড়ির ঠিকানাও দিয়েছিলেন। আমরা বরকতের বাড়িতে খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলাম। ২১ ফেব্রুয়ারিতে গুলি চলার পর পরই হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানুদ্দীন খান জাহাঙ্গীর এবং তিনজনে বেগম বাজারের এক প্রেসে গিয়ে একটি লিফলেট ছাপানোর ব্যবস্থা করি। সে লিফলেট আমরা প্রচার করেছিলাম।
বরকত সম্পর্কে যে কুৎসা একটি পত্রিকায় উঠেছিল সে বিষয়ে আমি ইতিমধ্যে লিখেছি। নূরুল আমিনের সময়ও বলা হয়েছিল- যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে তারা কালপ্রিট, ইন্ডিয়ার এজেন্ট, কমিউনিস্ট, দেশের দুশমন ইত্যাদি। ফলত বরকতের বিষয়ে যা যা বলা হয়েছিল তা সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বানোয়াট। ভাষা-আন্দোলনের শহীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করাই ঐ প্রচারণার উদ্দেশ।'
সূত্র : একুশের সংকলন' ১৯৮১ : স্মৃতিচারণ।
গ্রন্থনা : সেখ ফয়সাল আহমেদ