স্মৃতিতে সেলিম আল দীন
২০০৮ সালের এই দিনে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব যাঁর শিষ্যত্ব আমাদের হীরার মতো সমৃদ্ধ করেছে সেই পিতৃতুল্য শিক্ষক নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
রেখে যান তাঁর স্নেহ, মমতা আর পরম ভালোবাসা। রেখে যান প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অথৈ সমুদ্র। আর আমাদের সেই নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের রেখে যাওয়া দর্শন সমুদ্র মন্থন করাই রোজকার কাজ।
তাইতো লোকান্তরিত নন সেলিম আল দীন। আমরা অশেষ ভালোবাসায় সত্য ও সুন্দরের সেই মানুষকে আমাদের হৃদয় ও মননে বয়ে চলেছি। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে কিছু স্মৃতি তুলে ধরলাম।
প্রথম বর্ষে ক্লাস শুরুর দিন, তাঁর সুললিত কণ্ঠে আমাদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা এখনো মনে আছে। নাটক বিভাগের কোনো ছাত্র বেকার থাকবে না। এমনভাবে তোমাদের তৈরি করে দেব, তোমরা নিজের জায়গা নিজেই সৃষ্টি করবে। স্যারের কথা দিয়েই শুরু হলো আমাদের পথচলা। তিনি এও বললেন, ‘ফার্স্ট ইয়ারে তোমরা আমার ধারে কাছেও আসবে না। থার্ড ইয়ারের আগে আমি ক্লাস নেই না।’ এই কথাগুলো স্যার প্রায় সব ব্যাচেই বলতেন। আর তাই প্রথম দিনেই মন খারাপ হয়ে গেল স্যারের ক্লাস করতে আরো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে!
একদিন বিকেলে মিতু ম্যাডামের মেকআপ ক্লাস। ম্যাডামের আসতে একটু দেরি হচ্ছিল তাই আমরা বিভাগের বারান্দায় সবাই ঘোরাঘুরি করছি। সেলিম স্যার আমাদের পুরো ব্যাচকেই বেশ গম্ভীর মুখে ডাকলেন। আমরা তো অবাক হয়ে স্যারের সামনে গেলাম। সবার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। সবাই নাম বলছে। আমি খানিকটা পেছনে, অতবড় মানুষের সামনে গিয়ে আবার কোন বিপদে পড়ি, এই ভয় একটু দূরে দূরে থাকতাম। স্যার আমাদের কাছে জানতে চাইলেন কার ক্লাস? আমার এক বন্ধু বলল, মিতু ম্যাডামের মেকআপ ক্লাস আছে। শুনেই স্যার হো হো করে হেসে বললেন, ‘আমি তোদের দাদা শিক্ষক, তোদের স্যারেরও স্যার। পরদাদাও বলতে পারিস।’ তিনি বলতে থাকেন মহাভারতের কথা, সেখানে কেমন করে গুরুকে অঞ্জলি দিয়েছে বিদ্যার্থীরা। ওইদিন আমাদের আর ক্লাস হয়নি আমরা সবাই স্যারের কথা শুনে হলে ফিরে গেলাম।
আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়ার কারণে প্রথম প্রথম পড়াশোনা করতে অসুবিধা হতো। আমি একদিন সাহস করে স্যারের কাছে এ বিষয়ে উপদেশ নিতে গিয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে ১০০ সূর্য উদয় আর অস্ত দেখার পরামর্শ দিলেন। আমি স্যারের কথা মতো এক সপ্তাহ কাজটি করেছিলাম। তাতেই আমার অনেক উপকার হয়েছিল।
আমরা তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল প্রোডাকশন করছি। স্যারের নির্দেশনায় মীর মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’কে রূপ দিলাম নাটকে। এ গ্রন্থে লেখক ব্যঙ্গের মাধ্যমে অন্যায়, অত্যাচার, সামাজিক দুর্নীতি, মানুষের নৈতিক অধঃপতন, মনুষ্যত্ব ও হৃদয়হীন আচরণ তুলে ধরেছেন। এ বিষয়টাকে আমরা স্যারের তত্ত্বাবধানে নাটকে রূপ দিলাম। নাটকের সংলাপগুলো স্যারের সাথে আমাকেই লিখতে হতো আর এজন্য স্যারের সাথে অল্পবিস্তর খাতির হতে থাকল। হঠাৎ একদিন বিকেলে স্যার ফোন দিয়ে তাঁর সাথে আমায় হাঁটতে যেতে বললেন এবং আমাকে চৌরঙ্গী ডাকলেন। স্যারের সাথে সারা ক্যাম্পাস হাঁটতে হবে, এটা ভাবতেই প্রথমে খুব মন খারাপ হলো। স্যার হাঁটার শিষ্যসঙ্গী পেলে তাকে আর সহজে ছাড়তে চাইতেন না! সঙ্গত কারণেই আমরা অবোধ ছাত্ররা স্যারের সাথে হেঁটে সময় পার করতে চাইতাম না! কিন্তু শিক্ষার্থী সহযোগে হাঁটা ও জ্ঞান বিনিময়ের বিষয়টা ছিল স্যারের নিজস্ব স্টাইল।
এরপর থেকে প্রায় হাঁটতাম স্যারের সাথে। প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে কিন্তু খুব ভালো লাগতে শুরু করল আমার, কারণ স্যারের সাথে হাঁটলে বিভিন্ন কিছু শেখা যেত। খুব ভোরে এই নগণ্য শিষ্যের সাথে ক্যাম্পাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হেঁটে বেড়াতেন স্যার। ভোরের সূর্যের স্নিগ্ধতা দেখতেন, মহুয়ার গন্ধে মাততেন। পাখপাখালির সুরশব্দ আর রঙে মুগ্ধ হতেন। ভোরের দুর্বা কুয়াশায় নিজের পদযুগল ভিজিয়ে শিশুদের মতো আনন্দে মেতে উঠতেন তিনি। এ দৃশ্য কোনোদিনই ভোলার নয়।অনেকদিন স্যারের বাসায় গিয়েছি। স্যার নিজ হাতে চা করে খাইয়েছেন। অনেকদিন স্যারের সাথে নয়ার হাট থেকে মাছ কিনে এনে স্যারের সাথে রান্না করে খেয়েছি— তা বর্ণনাতীত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বুঁনোঘাস মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভরা চাঁদের খুশির আলোতে লাল পদ্মফুলের লেকের পাড়ে শানবাঁধানো সিঁড়িতে বসে স্যার আমাদের শিল্প-সাহিত্যের গল্প শোনাতেন।
আর একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না। স্যারের ক্লাস নেওয়ার পদ্ধতি ছিল অন্য শিক্ষকদের থেকে আলাদা। একটানা আট ঘণ্টা পর্যন্ত আমাদের ক্লাস নিতেন। ক্লাসের মাঝখানে তিনি আমাদের টিউটরিয়াল পরীক্ষাও নিতেন। পরীক্ষায় বই দেখে লেখার বিধান ছিল কিন্তু তিনি যে বিষয়ে লিখতে দিতেন তাতে বই দেখে বা বই খুঁজে লিখতে গেলে আরো ১০ ঘণ্টা লাগত। আমরা বিপদে পড়েছি তা বুঝতে পেরে স্যার হাসতেন। স্যারের ঠোঁটের কোণের হাঁসি আজও আমার মণিকোঠায় অম্লান হয়ে আছে।
স্যার মৃত্যুকে অসম্ভব ভয় পেতেন কিন্তু ততটা নিজের প্রতি খেয়াল রাখতেন না। প্রচুর অনিয়ম করতেন তিনি। আমার প্রায় ব্লাড প্রেসারের সম্যস্যা হতো। প্রেসার হাই হয়ে যেত। একদিন মেডিকেল সেন্টারের আমি প্রেসার মাপাচ্ছিলাম তখনই স্যার তার প্রেসার মাপাতে আসলেন। আমাকে দেখ বললেন, তোর আবার কিসের প্রেসার? পরে যখন দেখলেন আমার প্রেসার আসলেই হাই তখন তিনি আমায় উপদেশ দিলেন মুরগির মাংসের হাড় যেন না খাই। অপরকে যা উপদেশ দিতেন সেটা যদি তিনি মেনে চলতেন তাহলে হয়তো আজও তিনি আমাদের মাঝে থাকতেন। সেলিম আল দীন স্যারের সাথে স্মৃতির কথা লিখে শেষ করা যাবে না। এই মুহূর্তে স্যারের একটা কথা খুবই মনে পড়ছে, যা তিনি প্রতিনিয়ই বলতেন, ‘একটা ক্ষয়ে যাওয়া দিবসের মৃত্যু শেষে পরের দিন নতুন দিন নিয়ে আসা ভোরের সূর্য যে দেখেনি, তার কাছে পৃথিবীর রূপ পুরোটাই অধরা।’ এমন করে এত সুন্দর ও সত্য কথা আর কে কবে বলতে পেরেছেন!
বিশ্ব সাহিত্যের ধ্র“পদী ধারায় শ্রমজীবী মানুষ এবং বাংলার আবহমান কালের সংস্কৃতিকে নাটকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদানে সমর্থ হন অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীন।শিল্প বিষয়ে জ্ঞান অর্জন, নিজের শিল্পবিশ্বাস নির্মাণ করে তা অনুশীলন ও পরবর্তী প্রজন্মকে সেই শিল্প ধারণায় অবগাহনের প্রেরণা আমৃত্যু সঞ্চার করেন যিনি তিনিই তো একজন আচার্য হয়ে ওঠেন। সেই অর্থে সেলিম আল দীনের অবস্থান আমাদের সাহিত্য ক্ষেত্রে একজন আচার্যের মতোই। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে দায়িত্ব তিনি আমাদের কাছে অর্পণ করে গেছেন, তা আমাদের অবিরাম প্রেরণা দিয়ে যাবে।
পরিশেষে বলতে চাই, অস্তিত্বের স্রষ্টা বিধাতা, আর বোধের স্রষ্টা একজন ভালো শিক্ষক। আমার সৌভাগ্য যে আমার এই শিক্ষা জীবনে অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীনের মতো একজন মেধা, মনন ও বোধের নিবিড় রূপকারকে পেয়েছিলাম। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার রূপকে তিনি আমার ভাবনায় সমৃদ্ধ করেছেন বহুরূপে।