সেলিম আল দীন স্মরণ
আমি কোন সাধনে পাবোরে তারে...
সেলিম আল দীন মূলত ঐতিহ্য অনুসন্ধানী নাট্যকার। বঙ্গ-ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে কেন্দ্রে রেখেই তাঁর নাটকের ভিত্তিভূমি রচিত। বেদ থেকে শুরু করে রামায়ণ-মহাভারত হয়ে মধ্যযুগের সাহিত্যে তাঁর বিচরণভূমি। অতীতের শিক্ষাকে তিনি বর্তমানের সঙ্গে একাঙ্গীভূত করেছেন। ঐতিহ্যের সূত্র ধরে সমকালকে ধরবার চেষ্টা ছিল তাঁর। তাঁর প্রায় সব নাটকেই ঐতিহ্যের অনুসন্ধান প্রবল। এই নাট্যকারের সঙ্গে রয়েছে আমার হাজারো স্মৃতি, সেসবের একটি হলো তাঁর সঙ্গে আমার মাছ কেনার স্মৃতি।
মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন তিনি। প্রায়ই চলে যেতেন ইসলামপুর নয়ারহাট বাজারে। ভোরবেলায়। ঘুম থেকে জাগতেন তো শেষরাতে। চিনি ছাড়া এক কাপ দুধ-চা খেয়ে লিখতে বসতেন। সূর্য যখন উঠি উঠি করছে, তখন বেরিয়ে পড়তেন বাসা থেকে। আমার বাসার সামনে গিয়ে ফোন দিতেন। মোবাইলটি আমার সিথানেই থাকত। রিসিভ করে ঘুমজড়ানো গলায় বলতাম―‘স্যার...।’ তিনি বলতেন, ‘তাড়াতাড়ি নাম। আমি নিচে।’ আমি বলতাম, ‘আসছি স্যার।’
দাঁত ব্রাশ না হয় থাক, মুখটা ধুয়ে প্যান্ট-শার্ট পরতে তো কিছুটা সময় লাগে। ততক্ষণ তর সইবে কেন তাঁর! চলে আসতেন দরজার সামনে। শুরু করতেন দরজায় লাথি মারা। লাথি মারতেন আর বলতেন, ‘ওঠরে বাপ। নোমান? কই? উঠলি?’ আমি বের না হওয়া পর্যন্ত থেমে থেমে লাথি চালিয়ে যেতেন। মাঝেমধ্যে খুব বিরক্ত হতাম। মুখ দেখে হয়তো তিনি সেটা বুঝতেন। বলতেন, ‘শোন, মাছ একটা কিন্তু তোর বাসায় নিয়ে আসবি।’ কথাটা এমনভাবে বলতেন, আমি মাছটি না আনলে সত্যি সত্যি যেন তিনি আমাকে কঠিন শাস্তি দেবেন।
নয়ারহাট বাজারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ৭টা। মাছ বাজার জমে উঠেছে ততক্ষণে। মাছওয়ালারা তাঁকে দেখলেই হাঁকডাক শুরু করে দিত, ‘স্যার, একদম ফ্রেশ। নদীর মাছ স্যার।’
: দাম কত? স্যার জিজ্ঞেস করতেন।
: আপনার জন্য তিন হাজার। অন্য কেউ হলে ঠিক চার হাজার নিতাম স্যার।
স্যার মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলতেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, গাড়িতে তোলো।’
প্রথম প্রথম আমি অবাক হতাম। পরে রাগও করতাম। কারণ, ধরা যাক একটা বোয়াল। বাজারদরে তিন কেজি ওজনের বোয়াল মাছটির দাম বড়জোর দুই হাজার টাকা। অথচ স্যারকে ঠকিয়ে মাছওয়ালারা তিন হাজার নিয়ে নিচ্ছে! আমার বেজার মুখ দেখে স্যার বলতেন, ‘ওরা আমাকে ঠকায় না, বুঝলি? বহু বছর ধরে মাছ কিনি তাদের কাছ থেকে।’
: না, ঠকাবে কেন? ওরা আপনাকে চেনে না!
স্যার আমার গলার টোন বুঝে বলতেন, ‘তুই বুঝবি না। চল চল।’
একদিন রাগ করে বলেই ফেললাম, ‘না, আমি কী করে বুঝব? আমি তো এখনো খোকা।’
হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, ‘বেয়াদবি করবি না ব্যাটা।’
: আমি তো কথা বললেই বেয়াদবি। আমাকে বাজারে না আনলেই তো হয়।
: তোকে আসতে বলল কে? এলি কেন?
: সকালে আমার বাসায় গিয়ে দরজায় লাথি না মারলে তো আমি আসতাম না।
প্যান্টের পকেটে হাত দুটো ঢুকিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, ওরা টাকা বেশি নিলে তোর সমস্যা কী?’
: না, আমার কিসের সমস্যা?
: তাহলে টাকা দিয়ে দে।
সাধারণত স্যারের টাকা থাকত আমার কাছে। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে দিতাম। মাছ নিয়ে তিনি বাসায় ফিরতেন। আমাকে যে একটা মাছ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তা বেমালুম ভুলে যেতেন। প্রতিবারই।
আমি কি আর সে কথা মনে করিয়ে দিতে পারি! দুদিন বা তিন দিন পর মনে পড়ত তাঁর। ফ্রিজ খুলে এক পোঁটলা মাছ ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘নিয়ে যা।’ আমি নিতাম। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এভাবে মাছের পোঁটলা ধরিয়ে দিতেন। ফলে আমাকে মাছ খুব একটা কিনতে হতো না।
এই তো আমাদের সেলিম আল দীন। বাংলা নাটকের অমর কারুকার। তিনি আমাকে বিশ্বসাহিত্যের মানচিত্রটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন হাতে। বলেছিলেন, ‘অল টাইম বিশ শতকে থাকবি। এবং হোমার, দান্তে, তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, রবীন্দ্রনাথকে মাথার ওপর রাখবি।’
আইড়, ইলিশ ও বোয়াল মাছ খুব প্রিয় ছিল তাঁর। অদ্ভুত মাছ-পাগল মানুষটি একদিন হুট করেই চলে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়ার দিনটি ছিল ১৪ জানুয়ারি, ২০০৮। এত এত দিন পর আমি এখনো আইড়, ইলিশ কিংবা বোয়াল মাছ খাওয়ার সময় তাঁর মুখটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুকের ভেতর তখন কেমন উথাল-পাথাল শুরু হয়। সেই সঙ্গে পঙ্ক্তিটি মাথায় ঘোরে, ‘আমি কোন সাধনে পাবোরে তারে আমার মনের মানুষ রতন...।’