গল্প
কুড়িয়ে পাওয়া গল্প
এক.
সকালবেলা ঘর থেকে বেরোতে যাবে, ঠিক সেই সময় ছোট মেয়েটা বিছানায় শুয়ে থেকে চিৎকার করে বলে উঠল, বাবা, কই যাও?
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। থমকেও দাঁড়ালাম। দরজা থেকে ফিরে গেলাম ঘরে,
: অফিসে মা।
অফিস কী জিনিস, তিতির বুঝল কি বুঝল না ঠিক বোঝা গেল না, তবে সে খলখল করে হেসে উঠল। আমি অবাক হয়ে তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তিতির যখন এ রকম করে হাসে, তখন ওকে খুব ভালো লাগে।
তিতিরের কাণ্ডকারখানা দেখে ভেতরের ঘর থেকে তিতিরের মা এসে ধমক লাগাল মেয়েকে,
: বাপে অফিসে যাওনের কালে তোমার খালি মন-মতলইব্যা কথা! এক্কেবারে বাপের বাদুক হইছো?
আমি তিতিরকে কোলে তুলে ওর কপালে আদর এঁকে দিই। তিতির তখন চোখ বন্ধ করে রাখে। এত্তোটুকু মেয়ে তিতির সেও কী না বোঝে বাবার আদর! প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় তিতির আমাকে কিছু না কিছু বলবেই বলবে।
তিতিরকে ঘরে রেখে বের হওয়ার সময় ওর মা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
: কামে মন দাও। খালি মাইয়ার কথায় নাইচো না।
: নাচলাম কই? আমি ক্ষীণস্বরে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করি।
: য্যায় নাচে হ্যায় কি আর নিজের নাচ দেখে!
দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে আমার চোখে ভেসে ওঠে তিতিরের মুখ। আর আমার মুখে ভেসে ওঠে হাসি। তিতিরের স্বর্ণমাখা হাসি।
দুই.
বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ হাঁটলে বাসস্ট্যান্ড। প্রতিদিন বাস ধরে যেতে হয় অফিসে। যানজট, ভিড়-ভাট্টা ঠেলে ১০ মিনিটের পথ যেতে লেগে যায় কমসে কম ৩০-৪০ মিনিট।
বাস এলে বাসে উঠে পড়ি। প্রায় দিনই বাসের যাত্রীদের এলোমেলো আর অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা আমার শুনতে ভালা লাগে না। এসব এড়াতে রোজকার মতো দুই টাকা দামের পত্রিকা কিনি। তাতে সময়টা ভালোই কাটে। দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যায়। কত খবর যে পত্রিকার পাতায় থাকে! কয়েক দিন ধরে পত্রিকাজুড়ে লিবিয়ার খবর। আজো দেখলাম, প্রথম পাতায় লাল অক্ষরে বড় বড় করে লেখা, ‘লিবিয়া জ্বলছে : বাংলাদেশিরা বিপদে’। খবরে বলা হয়েছে, হাজার হাজার বাংলাদেশি লিবিয়ায় আটকে আছে। দেশে ফিরতে পারছে না। যারা দেশে ফিরে আসছে, তাদের মুখে শোনা যাচ্ছে করুণ আর্তনাদের কথা, কষ্টের কথা। আমি বাসে বসে বসে নীরবে লিবিয়ায় আটকে পড়া বাংলাদেশিদের খবর মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকি। পেছনের পাতায় চলে যাই। সেখানেও একই বিষয়ের অনেক খবর। চোখ আটকে যায় ডবল কলামে ছাপা হওয়া একটা বক্স আইটেমে, ‘নাইমার বাপ আর ফিরবে না’।
জাহাঙ্গীর আফ্রাদ নামের একজনকে নিয়ে নিউজটা ছাপা হয়েছে। সঙ্গে তার একটা ছবিও। নিউজটা পড়ে জাহাঙ্গীর আফ্রাদ সম্পর্কে জানলাম। তার মেয়ের নাম নাইমা। বয়স সাড়ে তিন। আফ্রাদ লিবিয়ায় গিয়েছিল কাজের জন্য। এতদিন ভালোই ছিল। কাজ শেষে বেতন। শান্তিতে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কাছের দেশ মিসরে গণ্ডগোল শুরু হলে সেই ধাক্কার রেশ এসে পড়ে লিবিয়ায়। মানুষজন লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফির বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে। শুরু হয় অশান্তি। অশান্তি শুরু হয়ে গেলে আফ্রাদের মতো মানুষরা পড়ে যায় ঝামেলায়। কাজ বন্ধ, টাকা-পয়সা নেই, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। অনিশ্চয়তা সবার চোখে-মুখে অন্ধকার। বাসাবাড়িতে গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। ১৫ দিন ধরে আফ্রাদ না খাওয়া। শুধু আফ্রাদ নয়, আফ্রাদের মতো আরো অনেক বাংলাদেশির অবস্থা ওর মতোই। না আছে খাওয়া, না আছে থাকার জায়গা। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধে নেমেছে, তাদের কেউ কেউ ক্যাম্পে ঢুকে আফ্রাদদের টাকা-পয়সা, মোবাইল, মূল্যবান জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বললে অকথ্য ভাষায় গালাগালি তো আছেই, উল্টো মারধরও জোটে। এত কষ্টের মধ্যে আর এখানে থাকতে ইচ্ছা করে না আফ্রাদের। একেকবার দেশে ফেরার ইচ্ছা জাগে আফ্রাদের। ইচ্ছা হলো আর সে দেশে ফিরে যাবে, তা তো হয় না। বিমানবন্দর অবরুদ্ধ। বিমান চলাচল কমে গেছে। আর ওখানকার মালিকপক্ষ পালিয়ে যাওয়ার সময় আফ্রাদদের সবার পাসপোর্ট নিয়ে গেছে। পাসপোর্ট ছাড়া আফ্রাদরা দেশেও ফিরে যেতে পারছে না। আফ্রাদের বন্ধুরা কেউ কেউ আফ্রাদকে বুদ্ধি দিয়ে বলেছিল,
: চল, লিবিয়ার বর্ডার দিয়ে পালিয়ে গ্রিসে যাই।
গ্রিসের কথা শুনে আফ্রাদের চোখ ঝিকমিক করে ওঠে। তার ছোটবেলার এক বন্ধু থাকে গ্রিসে। সে বলেছে, কোনোমতে একবার গ্রিসে ঢুকতে পারলেই কাজ পাওয়া যাবে। আর কাজ মানেই টাকা আর টাকা। আফ্রাদ এটাও জানে, তার ক্যাম্পেরই কয়েক বাংলাদেশি এভাবে বর্ডার দিয়ে পালাতে গিয়ে মারা গেছে। কেউ গুলি খেয়ে, কেউ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আফ্রাদের মরে গেলে চলবে না। তাকে তো বেঁচে থাকতে হবে। কেন আফ্রাদকে বেঁচে থাকতে হবে ? হ্যাঁ, তাকে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকার কথা মনে হলে আফ্রাদের কানে বেজে ওঠে তার মেয়ের না বলা কথা। অস্ফুট স্বরে, বাবা তুমি কই, বাবা কই? তারপর বিরতিহীনভাবে বলে যেতে থাকে, বাবা তুমি আতো, তুমি আতো।
জাহাঙ্গীর আফ্রাদের সাড়ে তিন বছরের মেয়ে নাইমার এই কথাটুকু তার ভেতরে শক্তি জোগায়। আফ্রাদকে বেঁচে থাকার বল-ভরসা জোগায়। আফ্রাদ ভাবে, সে গ্রিসে যাবে কি যাবে না। তার পরও পালানোর ধান্ধায় থাকে ক্যাম্পের অনেকে। গ্রিসে গেলেই তো কাজ আর টাকা! আফ্রাদের সঙ্গে যারা লিবিয়ার সীমান্তে খেয়ে না-খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছিল, তারাও তাকে টাকার লোভ দেখায়।
আফ্রাদের মন গ্রিসে যাওয়ার পক্ষে একবার সায় দেয়, পরমুহূর্তে কে যেন তাকে বাধাও দেয়। পালিয়ে গ্রিসে যাওয়ার সময় সে যদি মরে যায়! মরে যাওয়ার কথা মনে হতেই আফ্রাদ শুনতে পায় তার মেয়ের কথা। ভাবনায় পড়ে আফ্রাদ। আর পালায় না। খেয়ে না-খেয়ে কষ্ট করে সে লিবিয়ার সীমান্ত এলাকায় পড়ে থাকে আর আশায় থাকে, কখন দেশে যাওয়ার সুযোগ মিলবে।
গাদ্দাফিবিরোধী আফ্রাদদের ক্যাম্পের সব খাবার-দাবার লুট করে নিয়ে যায়। না খেতে খেতে পনেরো দিন কেটে যায় আফ্রাদের। একটানা পনেরো দিন না খাওয়ার ফলে আফ্রাদ ক্লান্ত হয়ে নুয়ে পড়ে। ক্ষুধার জ্বালায় শরীর খারাপ হয়ে যায় তার।
সেদিন সকালবেলা খুব তেজাল রোদ পড়েছিল। আফ্রিকার দেশগুলোতে কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। রাতের বেলা হাড়-কাঁপানো শীত থাকে তো পরদিন থাকে বুক-ফাটানো গরম। সেদিন সকালবেলা আফ্রাদের এক বন্ধু খবর দেয়, মানবাধিকার সংস্থা থেকে খাবার এসেছে। খাবারের জন্য নানা দেশের মানুষের লম্বা লাইন পড়বে, সুতরাং লাইনের জন্য আগেভাগে যাওয়াই ভালো। সকাল সকাল আফ্রাদ গিয়ে হাজির হয় লাইনে। অবাক হয়ে যায় সে। মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখে ঘাবড়ে যায় সে। যতদূর চোখ যায় আফ্রাদ দেখে শুধু পিঁপড়ার মতো মানুষ আর মানুষ। কিলবিল করছে। আর শোরগোল উঠেছে গুনগুন করে।
মানবাধিকার সংস্থার সাদা চামড়ার মানুষজন আফ্রাদদের সবাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেয়। তার পর কিছুক্ষণের ভেতর সেই লাইন ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে। শোরগোল হতে হতে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। মারামারি হয়। এর মধ্যে হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগে আফ্রাদকে ইথিওপিয়ার লম্বা হাড়-জিরজিরে চেহারার এক মানুষ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। আফ্রাদ কিছু বলল না। চেয়ে থাকল শুধু। তার পেটে তখন রাজ্যের ক্ষুধা চিতাবাঘের মতো মোচড় দিয়ে উঠছে। সে আর তখন কী করবে! ইথিওপিয়ান লোকটাকে যে আফ্রাদ ধাক্কা দেবে, সেই শক্তি আফ্রাদের শরীরে নেই। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আফ্রাদ লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে তাকিয়ে লোকটাকে দেখতে থাকে। আফ্রাদের মনে হয়, তাকে যে ধাক্কা দিয়েছে সে-ও কি আফ্রাদের মতো পনেরো দিন না খাওয়া! ফড়িংয়ের মতো টিংটিঙে গড়নের লোকটার চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন বেরিয়ে আসছে। হঠাৎ কী হলো, আফ্রাদ বুঝে উঠতে পারে না। আশপাশে একটা শোরগোল ওঠে। ফেনিয়ে। তারপরই হুড়াহুড়ি শুরু হয়ে যায়। নিজের শরীরটাকে আফ্রাদের মনে হয় কদিনে খেতে না পেয়ে শিমুল তুলোর মতো হালকা হয়ে গেছে।
চারদিকে খাবারের দীর্ঘ লাইন। আর কত যে মানুষ! ক্ষুধার্ত মানুষের কোলাহল-চিৎকারের মধ্যে হঠাৎ করে একটা কালো রঙের মানুষ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের নাম ধরে বাজে ভাষায় গালাগাল শুরু করে দেয়। আর কালো মানুষকে ঘিরে উড়তে থাকা মাছিরা দল বেঁধে ঘিরে থাকে। আফ্রাদ কোলাহলের ভেতরও মাছি ওড়ার ভনভন শব্দ টের পায়। আফ্রাদের এতটুকু স্পষ্ট মনে পড়ে, তার পর কী হলো তার আর মনে নেই। প্রবল ধাক্কাধাক্কিতে আফ্রাদ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। সকাল থেকে মাথাটা এমনিতে তার ঘুরছিল। এই ভিড়-ভাট্টায় তার মাথা যেন শুধু ঘুরছিলই না। আফ্রাদের মনে হচ্ছিল, বর্ষাকালে পানি পেয়ে বাড়-বাড়ন্ত ধৈঞ্চা গাছের ডাল থেকে যেমন ছোট পাখি উড়ে যায়, সে রকম করে তার মাথা যেন নিজের মাথাটা খুলে গিয়ে আপনা-আপনি উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ প্রবল এক ধাক্কা এসে আছড়ে পড়ল আফ্রাদের ওপর। টাল সামলাতে না পেরে আফ্রাদ পড়ে গেল মাটিতে। পড়ে যাওয়ার সময় আফ্রাদ যেন আরেকজনের চোখে দেখল, সে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে ধীরগতিতে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর আফ্রাদের আর কিছু মনে নেই।
মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর আফ্রাদের শরীরের ওপর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে টের পেল তার শরীরের ওপর দিয়ে মানুষের দৌড়ঝাঁপ-হুড়োহুড়ি-চিৎকার-চেঁচামেচি। মানুষের পায়ের চাপে আফ্রাদের হাড়গোড় যেন ভেঙে যাচ্ছে। আফ্রাদের তখন মনে পড়ে গেল তার গ্রামের কথা। জেলা নরসিংদী। থানা মনোহরদী। তার গ্রামের পাশে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের শাখা এসে ছোট খালের মতো রূপ নিয়েছে। সেই খালে সারা বছর হাঁটুজল থাকে। খালের ওপর কবেকার ভাঙা মতো বাঁশের সেতু। প্রতিবছর গ্রামের সমাজ চাঁদা তুলে সেই বাঁশের সেতুটাকে নতুন করে মেরামত করে। আফ্রাদরা বলে বাঁশের পুল। নড়বড়ে পুল। ক্ষুধার্ত আফ্রাদকে পদদলিত করে তার শরীরের ওপর দিয়ে যখন মানুষজন খাবারের জন্য দিগ্বিদিক হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, তখন আফ্রাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আর ঠিক সে সময় আফ্রাদের কেন যেন তার গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই নড়বড়ে বাঁশের পুলের কথা। সেতুর কথা। আর তখন কেবলই মনে হচ্ছিল, সে কী তবে তার গ্রামের সেই ভাঙা বাঁশের সেতু?
একমাত্র মেয়ে নাইমার কথা তখন জাহাঙ্গীর আফ্রাদের মনে আসে না।
আফ্রাদের ওপর ক্ষুধার্ত মানুষজনের দাঁড়িয়ে থাকা খাবার লাইনটা আরো দীর্ঘ হয়ে ওঠে। মানুষের পায়ের নিচে সে ঘুমিয়ে পড়ে।