গল্প
যে রাতে তারাটি খসে পড়েছিল
ময়রার কারখানার বাসি কড়াইয়ের তলার মতো মুখ করে মাথার ওপর ঝুলে আকাশ। ওখানে মেঘের আড়ালে বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে থাকা জোনাকি পোকার মতো তারাদের মশাল মিছিল জ্বলছে মিটিমিটি। দরিদ্র বিধবার পুরোনো জীর্ণ শাড়ি পরে চাঁদটিও হারিকেনের আলো বুকে নিয়ে ধুঁকছে পাশে বসে। পশ্চিম কোণের একপাশ থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রুপার পয়সার মতো অগুন্তি তারার মাঝখান থেকে অকারণে আম পড়ার মতো করে আচমকা খসে পড়ে একটি। পড়ন্ত তারা দেখে নাকি মনে মনে চেয়ে নিতে হয় কিছু। ওতে নাকি মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়। ওই দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ঘড়াভর্তি সোনার মোহর চেয়ে বসেন অনিল মাস্টার। তিনি জানেন, তার বাপঠাকুরদা জানেন, দেশভাগের আগের বছর হিন্দু-মুসলমানে যে রায়ট লাগে, সে বছরই ইন্ডিয়া চলে যায় নিতাইদের পরিবার কোনো এক রাতে। তাদের পতিত বাড়ির পেছনের ঝোপে লুকিয়ে থাকা শেওলাজমা পুকুরটিতে বড় বড় হাঁড়িভর্তি হীরা-মানিক-জহরত ডুব মেরে আছে; গ্রামের কমবেশি সবাই সে কথা শুনে শুনে বড় হয়েছে। সাহস করে সেই পুকুরে ডুব দেয় না কেউ।
ওই পুকুরে নাকি নাগিনী আছে, পা ডুবালেই পেঁচিয়ে টেনে নিয়ে যায় অতলে। যে কজন পা বাড়িয়েছে, পরের দিন সকালে ফুলে ঢোল হওয়া শরীর ভাসতে দেখা গেছে তাদের। সেই ভয়ে অগত্যা কপালে আঙুল ঠুকে মা জগদ্ধাত্রীর নাম জপতে জপতে অনিল বলে ওঠেন, ‘আমার সাধ পূরণ করো মাগো। এক ঘটি ধন পেলেই চলবে। এ আর এমন কী! তোমার কাছে সে তো নস্যি! দিব্যি করছি, তোমায় আমি সোনার নোলক গড়িয়ে দেব। জয় মা জগদ্ধাত্রীর জয়।’
অন্ধকারের চাদর মুড়িয়ে অনিল মাস্টার, মানে অনিল বড়াল ফিরছিলেন বাড়ির দিকে। টার্চলাইটের সরু নলের আলো ফেলে আঁধার কেটে চলছিলেন তিনি। সন্ধ্যার দিকে খানিকটা বৃষ্টি হবো হবো করছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হলো না। কেমন যেন নতুন বউয়ের মতো অভিমানী মুখ করা আবহাওয়া ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। একটা বোটকা হাওয়া চক্কর খাচ্ছে বাতাসে। আজ ছিল হাটের দিন। প্রতি রোববারই আমডাঙ্গা বাজারে হাট বসে। সেখান থেকেই ফেরা হচ্ছিল অনিলের। হাতে হাঁপানির ওষুধ। শ্বাস তো নয়; যেন আমপাতার বাঁশি বাজিয়ে চলছে বিকেল থেকে পুষ্প। ছেলে সুনীল গিয়ে মায়ের এ হাঁপের টানের খবর দিয়ে এসেছিল স্কুলে গিয়ে—মা বলেছে, বাড়ি ফেরাপথে যেন লতিফ কাকার দোকান থেকে পথ্য আনা হয়।
হাটের দিন লতিফ মাস্টারের ডিসপেন্সারিতে বসে একটু খোশগল্প করতে ভালোই লাগে অনিলের। কত শত মানুষের দেখা মেলে হাটে। দূরের গ্রাম, আরো দূরের গ্রাম থেকেও হাঁটা পথে, নৌকায় চড়ে, গাড়িতে ঝুলে মালপত্তর নিয়ে হাজির হয় ঠিকঠাক সবাই। সকালের পর থেকেই হৈ-হুল্লোড় চলে। বিকেলের পর থেকে মরে যেতে থাকে মানুষের আওয়াজ। সন্ধ্যার পর কোলাহল দখল করে বসে নৈঃশব্দ। তখন হাট বসে নীরবতার। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা শাকের পাতা, শুকনো খড়, কাঁচা গোবর, পোকায় খাওয়া আলু, ভাঙা পটোল, ছাগলের গুটিগুটি মল এমন কত কিছু যে চোখে পড়ে অনিলের; ভালোই লাগে। এই হদ্দগ্রামে ভৈরব নদের পাড়ের আমডাঙ্গা বাজারে মানুষ আসে; একটা ছুতোতে তো অন্তত আসে। এই মরার গাঁয়ে তবুও মানুষ আসুক।
আমডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খিচুরি শিক্ষক অনিল মাস্টার। সেখানকার অঙ্ক-বিজ্ঞান পড়ায় লতিফ মণ্ডল। তবে মাঝেমধ্যে সবই পড়াতে হয় অনিলের মতো। কোনো বিষয়েই বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। একরকম দিন পার করে দিলেই হলো। স্কুল শেষে বিকেল বেলায় দোকান খুলে বসেন লতিফ। গত পাঁচ বছর ধরে এই তার কাজ। বাড়ি যেতে ভালো লাগে না। ভালো লাগার কারণও কিছু নেই।
লতিফের দোকানে ওষুধপত্তর বলতে আছে কিছু জ্বর-ঠান্ডা-কাশির সিরাপ, মাথাব্যথা, পেট খারাপ, কৃমির কিছু বড়ি আর আছে দুটি কোম্পানির কনডমের লম্বা প্যাকেট। লাল ও কালো রঙের প্যাকেট দুটি দোল খায় তার ঘাড়ের পেছনে। এ ছাড়া বাদবাকি যা দেখা যায়, তার সবই ভুয়া। কাঠের রেকের ওপর ধুলোর স্তরে ডুবে থাকা বাক্সগুলো কেবই লোক দেখানো। খালি বাক্স দিয়ে সাজানো ছোট বেড়ার ঘরটিকে মনে হয় মালপত্তরে ঢাসা। এই রোববারেই কিছুটা বিক্রি হয় শেফালি ফার্মেসিতে। পাশের গ্রামের নিবারণ শীল এসে ইশারায় একটা কনডম চেয়ে নিল এই মাত্র। খবরের কাগজে মুড়িয়ে সেটি যখন নীরবে নিবারণের হাতে তুলে দিচ্ছিল লতিফ, কেন জানি সেই মুহূর্তে তার মৃত স্ত্রী শেফালির কথা মনে পড়ে যায়। নিবারণ আজ রাতে তার বউকে সোহাগ করবে। অথচ গত পাঁচ-পাঁচটি বছর হলো রাতের বিছানায় লতিফ মাস্টারের শরীরে কোনো নারী ছায়া পড়েনি। সন্তান-সন্ততিও নেই ঘরে। বাঁজা মেয়েলোক বলে কম গালি হজম করতে হয়নি শেফালিকে। মুখ বুজে সব সহ্য করত সে, আর রাতে বসে বসে কাঁদত বিছানায় আড় কাত হয়ে। মা হওয়ার বড় আকুতি ছিল শেফালির। কত ওঝা-বদ্যি, হাকিম-কবিরাজ বেটে খাওয়ানো হলো, কোনো কিছুতেই কিছু হলো না। এমনকি ঢাকা শহরে গিয়ে সরকারি ডাক্তারও দেখানো হয়েছে। তবে সমস্যা আর কারো নয়; খোদ লতিফের। শেফালি পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু এ কথা মুখ ফুটে বলবে কি—স্বামীর জাত যায় না তাতে! তাই তো পাড়াপড়শির লতানোপাতানো যা কথা, তা শেফালিকেই কানে ঢোকাতে হয়।
শেফালির সমস্যা ধরা পড়লে না হয় কথা ছিল। আরেকটা বিয়ে করে নিতে পারত লতিফ। শেফালির তো তা করার সুযোগ নেই; তার পক্ষে সম্ভবও নয়। ফলে যা তাকে দিয়ে সম্ভব তাই করে বসে একদিন। বাড়ির পেছনের আমগাছের ডালে শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়ে সে। বছর পাঁচেক হয়ে গেল সেই ঝুলনযাত্রার ইতিবৃত্ত। বছর দু-এক আগে লতিফের মা ছেলেকে পীড়াপীড়ি করে আবার বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে আনতে। পাত্রীও মোটামুটি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সরদার কবিরাজের মেয়ে ফাতেমা সেই বিয়েতে রাজিও ছিল। কিন্তু সব মিলিয়ে হলো না। নাকি হতে দেয়নি লতিফ? দেবেই বা কেন? ফাতেমাও যদি পোয়াতি হতে না পারে তবে কলঙ্ক রটবে; ধরা পড়ে যাবে লতিফের অক্ষমতা।
লতিফের জীবন মানেই বাড়ি, স্কুলের মাস্টারি আর এই দোকান। ঘরে বৃদ্ধ মা আছেন, আর আছে এক মাথা খারাপ বোন লুৎফা। লুৎফার এমনিতে তেমন কোনো সমস্যা নেই। দিব্যি থাকে। বাড়ির সব কাজ এক হাতে করে সে। কেবল গরমের দিন এলেই উল্টাপাল্টা হয়ে যায় সবকিছু। বলা নেই কওয়া নেই, কোনো একদিন হয়তো লাফ দিয়ে উঠানে পা মেলে আকাশে ফাটল ধরিয়ে কাঁদতে বসে যাবে। অবাধ্য গরুর মতো দড়ি দিয়ে বেঁধেও তাকে টেনে ঘরে নেওয়ার সাধ্যি নেই কারো। পুরো গ্রামের মানুষের কাছে তো বটেই, গ্রামের পাশের গ্রাম নলডাঙ্গা, তার পরের গ্রাম কোদলা এবং তার পরের মফস্বল কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত সে খবর কারো কানে পৌঁছাতে বাকি নেই যে লুৎফা পাগল। দেখতে শুনতে দিব্যা ভারতীর বোন বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মুখখানা জামবাটির মতো গোল। বুকের আকারটাও তেমনই। শরীরের গাঁথুনি টানটান। আর তাই তো সুযোগ পেলেই লুৎফার স্নানঘরে চোখ ডুবিয়ে রাখে পাশের বাড়ির মাসুম কমিশনারের কুলাঙ্গার ছেলে সুরুজ আলী।
লুৎফার চেয়ে সুরুজ বছর তিনেকের বড় হলেও একই সঙ্গে খেলত তারা। একদিন দুপুরে নিতাইদের বাড়ির পেছনের পুকুরের পাশের ভুতুড়ে জঙ্গলে চড়ুইভাতি খেলছিল দুজনে। লুৎফার বয়স তখন কতই বা, এগারো-বারো হবে হয়তো। কী মনে করে একসময় সুরুজ তার লুঙ্গি তুলে কালো কুচকুচে শিশ্নটি বের করে নাড়িয়ে নাড়িয়ে লুৎফাকে বলে ওঠে—ক’ তো লুৎফা এইডা কী?
ওটা দেখে হাঁ হয়ে গেল সে। নিজের হাতের তালুতে চেপে ধরে নিজের মুখ। সুরুজের টাক মাথার উত্তুঙ্গ লিঙ্গটি দেখে ভ্যাঁ করে কেঁদে সব ফেলে দৌড় দেয় লুৎফা। এমন পুরুষ্টু পুরুষাঙ্গ এর আগে দেখেনি সে। ওর ধারণা ছিল, শিশ্ন মানেই ছোট্ট ফুলদানির আকারের মতো একটা কিছু। লজ্জায় নাকি ভয়ে লুৎফা সেদিন কেঁদেছিল, তা সেই ভালো বলতে পারবে। কারো জানার সাধ্যি রইল না। সেদিনের পর থেকে সুরুজের সাথে যম্মের আড়ি তার। কথা বলা বন্ধ, খেলা তো দূরের কথা। দেখলেই নিজেকে আড়াল করে। সেই ঘটনার কথা আজো কাউকে বলেনি লুৎফা। ওদিকে এর শোধ নিতে চায় সুরুজ। এত সুযোগ থাকতেও লুৎফাকে জোর করে কিছু একটা করতে পারেনি সে। এ যেন তার পৌরুষে ঘা খেয়েছে। শুনেছে, পাশের গ্রামের নলডাঙ্গা বাজারের পাশের মাজারে এক ল্যাংটা ফকির বসে। ওই ফকির নাকি বাণ মারতে পারে যে কাউকেই। লুৎফার মাথার চুল একদিন কেটে নিয়ে ওই ফকিরের কাছে যায় সুরুজ। বলে, ছ্যাঁকা দিয়ে প্রেমিকা তার প্রেম করে নতুন নাগরের সঙ্গে। তাই ওই খানকি-মাগিকে বাণ মারতে হবে।
ফকির কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে, নাক-মুখ দিয়ে হুম-হাম শব্দ করে লুৎফার চুলটাকে মুঠোবন্দি করে ছুড়ে মারে। এর মাসখানিক পর থেকে ধরা পড়ে লুৎফার ওই রোগটা। বক কিসে মারা গেল, তা কেবল ঝড়ই বলতে পারবে।
লুৎফার চিকিৎসা সবই চলছে কমবেশি। অভাবী সংসারে এর বেশি কিছু করা আর সম্ভবও না লতিফের একার পক্ষে। বোনের বাইপোলার ডিসঅর্ডার ধরে, সেই সাধ্যি নেই শহরের বড় বড় ডাক্তারেরও। কেবল ঘুমের ওষুধ দেয়। খেয়ে খেয়ে পড়ে পড়ে ঘুমায় লুৎফা। সারা দিন ঘুমানোর পর সে আজ এই সাঁঝের বেলায় উঠানের এক কোণে চুল মেলে বসে আছে একা। ঘর থেকে এক ছড়া আলো তার গায়ে পড়েছে মৃদু। দূর থেকে অন্ধকার গায়ে মেখে ঝোপের ভেতর থেকে এ দৃশ্য দেখে যাচ্ছে সুরুজ কুলাঙ্গার। লুৎফার ওড়না ছাড়া সুডৌল বুকের দিকে চেয়ে থেকে শরীরে তাপ নিতে থাকে সে।
মাথার ওপর হাঁ করা কালচে আকাশ। লুৎফার চোখ ওই দিকেই ভিঞ্চির মোনালিসার মতো স্থির। সন্ধ্যার পর মেয়েমানুষের চুল খুলে রাখা অমঙ্গল, মায়ের এ কথায় গা করেনি লুৎফা। এমন সময় হঠাৎ তারাময় আকাশে খসে যাওয়া একটি তারা দেখে আনমনে হেসে ওঠে সে। রহস্যময় কণ্ঠে বলে ওঠে—সুরুইজ্জার চোখ দুইডা আমি ছেনি পুড়াইরা গাইল্যা দিয়াম। হারামির বাইচ্যা খালি আমারে দ্যাহে, খালি দ্যাহে আর দ্যাহে...।