ঢাকার কথা ১২
শিক্ষার বিস্তার ও প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস
১.
আধুনিক গবেষণায় ঢাকার চিত্র অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে। এতে দেখা যায় সহস্রাধিক বছর আগেও মানববসতির চিহ্ন ছিল এই এলাকায়। তা ছাড়া ঢাকার কোনো কোনো অংশে নাগরিক জীবনেরও বিকাশ ঘটেছিল। সেই সূত্রে সহজেই বলা যায় আট থেকে এগারো শতকে বৌদ্ধ পাল রাজাদের শাসন যুগে এবং এগারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে হিন্দু সেন শাসন যুগে মানুষ ঢাকায় বসতি গড়ে তুলেছিল। তবে সমকালীন লিখিত ইতিহাস না থাকায় এবং প্রয়োজনীয় প্রত্নসূত্র না পাওয়া যাওয়ায় প্রাচীন কালে ঢাকার শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে আনুষঙ্গিক সূত্রে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।
বৌদ্ধ শাসনযুগে রাষ্ট্রীয়ভাবে জ্ঞানচর্চার পক্ষে প্রণোদনা ছিল। পালযুগে অনেক সংঘারাম ও বিহার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে। ঢাকার কাছে দক্ষিণ-পশ্চিমে বিক্রমপুরে এবং উত্তরে সাভারে সমৃদ্ধ বৌদ্ধ জনপদ গড়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিক্রমপুরের সন্তান প্রখ্যাত জ্ঞানতাপস শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর শৈশবে বিক্রমপুরী বিহারে পড়াশোনা করেছিলেন। বিক্রমপুরেই ছিল এই বিহারের অবস্থান। তারুণ্যের শুরুতে তিনি রাজাসন বিহারে পড়াশোনা করেছেন। এই বিহারের অবস্থান সাভারে ছিল বলে প্রত্নগবেষকরা মনে করেন। তিব্বতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু লামা তারনাথ সাভার বা তৎকালীন সম্ভারে সমৃদ্ধ বৌদ্ধ বসতির বর্ণনা করেছেন। এই দুই বৌদ্ধ অঞ্চলের মাঝখানে থাকা ঢাকায় যে একটি শিক্ষার ধারাক্রম প্রতিষ্ঠিত ছিল এমন অনুমান সক্রিয়ভাবেই করা যায়।
সেন শাসন যুগে উচ্চশিক্ষালয় টোলে শুধু ব্রাহ্মণ সন্তান পড়তে পারত। সাধারণ পরিবারের সন্তানরা বর্ণ নির্বিশেষে পাঠশালায় পড়ত। এ পর্বে বিক্রমপুর অনেকটা সময় সেনদের রাজধানী ছিল। একসময় সেনযুগে বিক্রমপুরের বাণিজ্য বিস্তৃতির ঢেউ ঢাকায় এসে লাগে। আজকের পুরান ঢাকায় সেন যুগেই বাণিজ্য নগরীর পত্তন ঘটে। ফলে প্রত্নসূত্র না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ঢাকায় পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করতে পারি।
১৩ শতকের শুরু থেকে ধীরে ধীরে পুরো বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সুলতানি এবং মোগল যুগ মিলে আঠারো শতকের মাঝপর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের শাসনাধীকারে থাকে বাংলা। বাংলার এই মধ্যযুগ-কালপর্বে সুলতান, সুবাদার ও সুফিসাধকদের তত্ত্বাবধানে নবগঠিক মুসলিম সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটতে থাকে। এ সময় হিন্দু সমাজে পাঠশালা ও টোলকেন্দ্রিক পড়াশোনা যে অব্যাহত ছিল তা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য- বিশেষ করে মঙ্গলকাব্য, চৈতন্য চরিত কাব্য এবং মুসলিম প্রণয় উপাখ্যানে পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলায় ঢাকা অঞ্চলে হিন্দু বসতি থাকায় অনুমান করা যায় এ পর্বে এই শহরে পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল। তবে প্রয়োজনীয় ইতিহাসের সূত্র সংকটে সে যুগের ঢাকার হিন্দু শিক্ষার স্বরূপ প্রমাণ্যভাবে উপস্থাপন করা যাচ্ছে না।
সুলতানি শাসনযুগে ধর্মীয় প্রণোদনায় এবং শাসক ও সাধক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোগে মুসলিম সমাজে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। প্রত্যেক মসজিদ এ সময় মক্তব হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মক্তব ছিল মুসলমানদের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে মাদ্রাসা। প্রতি মুসলমান পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ ছিল বাধ্যতামূলক। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠ শুরু করতে হতো। সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চারদিন হলে মক্তবের শিক্ষক ইমাম সাহেবকে ডেকে এনে প্রথম পাঠ দেওয়া হতো। সেই অনুষ্ঠানে সামর্থ্য অনুযায়ী মিষ্টান্ন রান্না করে খাওয়ানো হতো। অবস্থাপন্ন অনেকে ভূরিভোজেরও আয়োজন করত। এই অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘বিসমিল্লাহখানি’। ঢাকায় ১৫ শতকের মাঝপর্বে মুসলিম বসতির বিকাশ ঘটে। মুসলিম বসতির প্রত্নতাত্ত্বিক পরিচয় মসজিদ ও মাদ্রাসার অবস্থিতি। এ সময় ঢাকায় তৈরি অন্তত তিনটি মসজিদের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমটি পুরান ঢাকার নারিন্দায়, দ্বিতীয়টি বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছনে গিরিদাকিল্লা অঞ্চলে এবং তৃতীয়টি মিরপুরে শাহআলী বোগদাদীর মাজার সংলগ্ন। মোগল যুগে ঢাকাজুড়ে অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছে। ফলে মক্তবকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। চৌদ্দ শতকের শুরুতে ঢাকার কাছে সোনারগাঁওয়ে একটি বিশাল মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে যুগের বিখ্যাত সাধক শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা।
এসব নানা আনুসাঙ্গিক সূত্রে প্রাচীন ও মধ্যযুগে ঢাকার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সামান্য ধারণা করা যায়। তবে ইংরেজ শাসন যুগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল তা আমরা প্রামাণ্যভাবেই জানতে পারি।
২.
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিক ইংরেজদের মাধ্যমে বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ইংরেজ শাসকরা ছিল দূরদর্শী ও কুশলী। বাংলার মধ্যদিয়ে অচিরেই বিশাল ভারতের অধীশ্বর হয় এরা। বুঝতে পারে ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে বহু বৈচিত্র্যের দেশ ভারতবর্ষ। তাই শুরুতেই এসে সবার ওপর ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দিলে একটি জনবিক্ষোভ তৈরি হতে পারে। ফলে প্রচলিত ফারসি ভাষাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে অব্যাহত রাখা হয়। আর নিজেরা প্রশাসনিক কাজ চালানোর প্রয়োজনে ইংরেজি ও ফারসি জানা দেশীয় শিক্ষিত মানুষদের জন্য একটি কেরানির পদ সৃষ্টি করে। যারা ‘মুন্সি’ নামে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকে বাংলায় শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমান সমাজের ভেতর বেশ কয়েকজন সমাজ সংস্কারক বেরিয়ে আসেন। তাঁরা ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব অনুভব করেন এবং যাঁর যাঁর সমাজের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে। এমন একটি অনুকূল অবস্থা তৈরি হওয়ার পর ১৮৩৫ সালে রাজভাষা হিসেবে ইংরেজির যাত্রা শুরু হয়।
প্রকৃত অর্থে ১৮৩৫ সালের আগে ঢাকা নগরীতে আধুনিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল তেমন প্রমাণ ইতিহাস সূত্রে পাওয়া যায় না। পূর্ববাংলা একটি পশ্চাদপদ জনপদ ছিল। এই জনপদে শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া আসে ১৮৩৫ সালে। এ সময় ঢাকায় গভর্নমেন্ট কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এই স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলে তৈরি হয় ইংরেজি শিক্ষার পথ। এরপর থেকে শিক্ষা বিস্তারের ধারা অব্যাহত থাকে। ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজ। পূর্ববাংলার মুসলমান তরুণরা ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব বোধ করছিল। এই অভাব পূরণের সুযোগ আসে ১৮৭৪ সালে। এ সময় প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মাদ্রাসা। মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৮৪ সালে প্রথম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকায় ‘জগন্নাথ কলেজ’ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ শাসন যুগে এটি ছিল স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এভাবে উনিশ শতকজুড়ে শিক্ষার বিস্তার ঘটতে থাকে ঢাকায়। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি উনিশ শতকের শেষ দিকে কয়েকটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এগুলোর মধ্যে ১৮৬৩ সালে ঢাকা কলেজে খোলা হয় আইন বিভাগ। বর্তমান মিডফোর্ড হাসপাতালের পাশে ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা সার্ভে স্কুল। পরবর্তী সময়ে এগুলো বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। নারী শিক্ষার পথে তৈরি অচলায়তন ভেঙে ইডেন গার্লস কলেজ প্রথম যাত্রা শুরু করে ইডেন গার্লস স্কুল হিসেবে। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৮ সালে।
ঢাকার শিক্ষা বিকাশের এই অব্যাহত ধারায় বিশ শতকের প্রথমার্ধেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সংযোজন ঘটে। তা হচ্ছে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। প্রায় ১০০ বছরব্যাপী ঔপনিবেশিক যুগে ঢাকায় যেভাবে শিক্ষার বিস্তার ঘটতে থাকে তারই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা শহরকে ঘিরে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গতি সঞ্চারিত হয়। ঢাকায় প্রকাশিত হতে থাকে বেশ কয়েকটি সাহিত্যসাময়িকী। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার প্রথম সাহিত্য সাময়িকী ‘কবিতাকুসুমাবলী’র নাম করা যেতে পারে। ১৮৬০ সালে সাময়িকীটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। একই বছর ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘মনোরঞ্জিকা’নামের একটি মাসিকপত্র। এভাবে এক দুই দশকের মধ্যে ছোটখাটো আরো কয়েকটি মাসিকপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৬০ সাথে ঢাকায় প্রথম সাপ্তাহিক প্রত্রিকা ‘ঢাকা প্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে থাকে। শিক্ষিত সমাজের নানামুখী চাহিদার কারণে ক্রমে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে সমাজ সংস্কারবিষয়ক সাময়িকী, ধর্ম ও তত্ত্বজ্ঞানভিত্তিক সাময়িকী, চিকিৎসাবিষয়ক পত্রিকা ইত্যাদি। এভাবে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠার পর সুলতানি ও মোগল যুগে ঢাকায় শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট ধারা রচিত হয়েছিল। ঔপনিবেশিক যুগে কলকাতাকেন্দ্রিক প্রশাসনের দৃষ্টি-গোচরে না থাকায় ঢাকার শিক্ষাচর্চার ধারাবাহিকতায় কিছুটা স্থবরিতা আসে। তবে তা ছিল সাময়িক। উনিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে আবার রূপান্তরের ধারা লক্ষ করা যায়। এভাবে ঢাকায় শিক্ষা বিস্তারের যে ধারা রচিত হয়েছিল তা অব্যাহত রয়েছে অদ্যাবধি।