গল্প
সাবিত্রীর বর
মর্গ থেকে ছাড়পত্রটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ লাশকাটা ঘরের সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মেঘলা। পা দুটো ভারী হয়ে যেন মাটির মধ্যে গেঁথে গেছে। কিছুতেই নাড়াতে পারছিল না। কেউ একজন এসে তার হাত ধরলে সে যন্ত্রচালিতের মতো এগোতে লাগল।
গেল ছয় মাসে তার জীবনের সব পরিবর্তনগুলো খুব দ্রুত ঘটছে। এই তো সেদিন, মনে হয় যেন গতকাল বা পরশুর কথা, কিন্তু দিনে দিনে প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে। বাবা প্রতিদিনের মতো সেদিনও অফিস থেকে ফিরল। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মেঘলা ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই বাবা হাসি মুখে বলল, দেখ তো মা, কলাগুলা কেমন? চিনিচাঁপা কলা, তোর মা খাইতে পছন্দ করে। দোকানি বলল, একেবারে গাছপাকা, কোনো ওষুধ-টসুধ দিয়া পাকানো হয় নাই।
মেঘলা হাত দিয়ে টিপে দেখল কলাগুলো শক্ত। কেমিক্যাল দিলে কলার শরীরে এক ধরনের কাঠিণ্য আসে ঠিক সে রকম; কিন্তু মুখে কিছু বলল না। বাবা বড় সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে।
তোর মা কই?
রুটিন প্রশ্ন। বাবা জানে, মা এই সময়ে কখনো বাইরে যায় না, বাবা অফিস থেকে ফেরে বলে। মেঘলা এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলল, বাবা তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আস, মা তোমার জন্য পাকোড়া বানাচ্ছে।
বাবা বাথরুম থেকে বেরোলে তাকে খুব ক্লান্ত-শ্রান্ত দেখাচ্ছিল। তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছার সাথে সাথে চওড়া কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের বুদ্বুদ ভেসে উঠতে লাগল। বাবা বিছানায় বসে পড়লেন। বললেন, মাথাটা কেমন ঘুরতেছে মা, চা না বরং একগ্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়া আয়।
মেঘলা দৌড়ে খাবার ঘরে গেল। সব মিলিয়ে মিনিট দুয়েক। ঠান্ডা পানিতে চিনি আর লেবুররস মিশিয়ে নাড়ছে- এর মধ্যে মায়ের চিৎকার; মেঘলা দেখ তোর বাবা কেমন করতেছে! মেঘলা দৌড়ে গেল, টেলিফোন-অ্যাম্বুলেন্স-হসপিটাল-ডাক্তার-সব মিলিয়ে ঘণ্টা খানিকের মধ্যে সব শেষ। বাবা তাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন। মেঘলার ছোটবোন মিমি তখনো কোচিং ক্লাসে।
দুই মেয়ে নিয়ে মা তখন ঘোর বিপদের মধ্যে পড়েছেন। বাড়িতে পুরুষ বলতে আর কেউ নেই। তরুণী দুই মেয়ে নিয়ে একলা মায়ের মনে সারাদিন নিরাপত্তাহীনতার বোধ কাজ করে। আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে এরই মধ্যে মেঘলার বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ চলতে থাকে। তাহলে মাথার ওপর অন্তত একজন পুরুষের ছায়া তো থাকবে! পুরুষ যে কবে থেকে ছায়াদানকারী হলো বাবা হঠাৎ মরে না গেলে মেঘলা এটা জানতেই পারত না।
বাবার ছোট চাকরি ছিল। সহায় সম্পত্তি তেমন নেই। তার ওপরে মাথার ওপরে বাবাটাও নেই, এমন মেয়ের পাত্র জোটানো কষ্ট। তারপরও কেমন করে যেন বড় মামা একজন পাত্র জুটিয়ে ফেললেন। তিনি যেন সমুদ্র সেচার কাজ করে ফেলেছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, ‘অনেক কষ্টে পাত্র জোটাতে পারছি বুঝলি খুকি, আজকাল তো আর কেউ মেয়ে বিয়ে করতে চায় না; বিয়ে করে মেয়ের বাপের অর্থ সম্পদ। তা ছেলেটা এমনিতে ভালো, টুকটাক ব্যবসাপাতি করে। ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি করত এই যা একটু..।’
রাজনীতি! মা আঁৎকে উঠলেন।
মামা বললেন, ‘না-না এখন করে না।’
কিন্তু কথাটা কতটা সত্যি কি মিথ্যা তা যাচাই হওয়ার আগেই ঘটনা ঘটে গেল। অপর এক সন্ধ্যায় পাঁচ-ছয়জন লোকের উপস্থিতি পান-জর্দা-সেমাই-মিষ্টি-পিঠা-পাস্তা-পুডিং-শরবত-মেহেদী-আলতা-কাজি-মৌলভি-স্বাক্ষী, মেঘের গর্জন-বিদ্যুৎ চমকানি-কম্পিত হাতে বাষ্পরুদ্ধ নয়নে স্বাক্ষর.., মেঘলার বিয়ে হয়ে গেল। মানুষটাকে সে ভালো করে দেখল না, চিনল না, জানল না অথচ সারাজীবনের জন্য তার স্ত্রীরূপে বাঁধা পড়ে গেল। একটা সিগনেচার করার সাথে সাথে মেঘলার জীবনটা কেমন বদলে গেল।
২
মেঘলার বর বিদ্যুৎ। এক সময়ের ছাত্রনেতা, বলার মতো কাজকর্ম কিছু করে না। মানে করার সুযোগও তেমন নাই। তবে যে কাজটা সে নিষ্ঠার সাথে করে সেটা হলো রাজনীতি। যেকোনো আন্দোলন সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে।
তার এই রাজনীতি করাটা বাড়ির কেউ খুব ভালো ভাবে নেয় বলে মনে হয় না। সেদিন তো ওর বোন বলেই বসল পরিস্থিতির চাপে পড়ে বিদ্যুতের ওই সব করা। কলেজে পড়তে গিয়েই তো যত..!
কিন্তু রাজনীতিতে বিদ্যুতের উৎসাহ সে কথা বলে না। কবে কোন পরিস্থিতির কী চাপ- কোনো লক্ষণই তো তার আচরণে নেই। বরং মনে হয় এই ব্যপারে সে একনিষ্ঠ।
ছেলেটা দেখতে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। টাকা-পয়সা না থাকলেও কথাবার্তা এবং স্বভাবে ভদ্র। রাজনীতি করে তো, এদের এত সহজে বুঝে ওঠা যাবে না। আর কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেঘলার বিয়ের এক মাসের মাথায় তার বর বিদ্যুৎ রাস্তায় এক বিক্ষোভে অংশ নিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল।
পুলিশের হাতে ধরা খাওয়া বিদ্যুতের নামে ক্ষমতাবানদের নির্দেশে পুলিশ হত্যা-নাশকতা মামলাসহ আরো কিছু পেন্ডিং মামলা ঠুকে দিল। সঙ্গে আদলতের নির্দেশে ১০ দিনের রিমান্ড।
৩
সদ্যবিবাহিতা মেঘলার স্বামীর রিমান্ড, পরিবার-পরিজনের ফ্যাকাসে হয়ে আসা উদ্বিগ্ন মুখচ্ছবি.., মেঘলা কিছু ভাবতে পারছে না। তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সাবিত্রী কাহিনী। গত বছর বান্ধবী ঊর্মী তাকে পড়তে দিয়েছিল রামায়ণের এই কাহিনী।
এ যুগে সাবিত্রী! তুই বড় ব্যাকডেটেড ঊর্মী! মুখে বললেও পড়েছিল। পড়াটা ওর রক্তে ছিল, নেশার মতো। তখন তো ভাবে নাই এমন হবে জীবনটা; একটা দিকহীন মোড়ে এসে থমকে দাঁড়াবে! বিদ্যুৎ গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে মাথার মধ্যে ক্রমাগত ঘুরছে সেই সাবিত্রী কাহিনী।
পুত্রহীন রাজার একমাত্র কন্যা সাবিত্রী। দেবজ অংশ, পুরুশালী স্বভাব, স্বামীর একবছর পর মৃত্যু অবধারিত জেনেও, রাজ্যপাট হারানো সেই রাজপুত্রকেই বরমাল্য অর্পণ করেছিল। বুদ্ধিমত্তা ও বাকচাতুর্যে মৃত স্বামীকে ফিরিয়ে এনেছিল যমের হাত থেকে।
রিমান্ডে ঠিক কতটা অত্যাচার করা হয়! মেঘলা জানে এদেশের রিমান্ডে সব কিছু সম্ভব। গোবেচারাকে খুনি, সাধুকে শয়তান, জীবিতকে মৃত করে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। মেঘলা এও জানে এ যুগের যমেরা হুকুমতের দাস। তাদের নিজেদের কোনো শক্তি নাই। নাই নীতি নৈতিকতাও। আইন-ধারা-মানবতা-বিবেক-ন্যায়বিচার কোনো কিছু তাদের স্পর্শ করে না। তারা শুধু অধীনস্ত। তারপরও একটা ব্যবস্থা যখন হয়েছে তখন এই নির্মম মানুষগুলোর কাছে তাকে একবার যেতে হবে। শরণাপন্ন হতে হবে একবার। একজন রিমান্ডের আসামির স্ত্রীর জন্য এ এক দুর্লভ পাওয়া। স্থানীয় পুলিশ প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ মিলেছে। ওরা, যাদের চোখকে মনে হয়েছে পৃথিবীর তাবৎ বিবর্ণতম বস্তুর অন্যতম। সবচেয়ে কঠিনতম ওদের অস্ত্র আর তার চেয়েও অসহনীয় সেই অস্ত্রের প্রয়োগ। যাদের কানে সহজে সাধারণ মানুষের আর্তনাদ পৌঁছে না। অথচ ওরা মানুষের সেবা করার উদ্দেশ্যেই সরকারের দেওয়া বেতন-ভাতা ভোগ করে। পক্ষান্তরে ভোগ করে অনেক কিছু। সেখানে গিয়ে কি বলবে ও! মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে সাবিত্রী। সাবিত্রী কী বলেছিল যমকে?
যম যখন সত্যবানের প্রাণ নিয়ে পাশবদ্ধ করে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলেন তখন সাবিত্রীও পিছু নিলেন। যম বললেন, ’সাবিত্রী, তুমি ভর্তার ঋণ শোধ করেছ, এখন ফিরে গিয়ে পারলৌকিক ক্রিয়া কর।’
সাবিত্রী বললেন, ’আমার স্বামী যেখানে যান অথবা তাঁকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে যাওয়া আমার কর্তব্য। আমার তপস্যা ও পতি প্রেমের বলে আপনার প্রসাদে আমার গতি প্রতিহত হবে না। পণ্ডিতরা বলেন, একসঙ্গে সাত পা গেলেই মিত্রতা হয়; সেই মিত্রতায় নির্ভর করে আপনাকে কিছু বলছি শুনুন। পতিহীনা নারীর পক্ষে বনে বাস করে ধর্মাচারণ করা অসম্ভব। যে ধর্মপথ সাধুজনের সম্মত সকলে তারই অনুসরণ করে, অন্যপথে যায় না। সাধুজন গার্হস্থ্য ধর্মকেই প্রধান বলেন।’
স্বামী জেলে গেলে সেই জেল থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনা স্ত্রীর কর্তব্য বা বিপদে পড়লে সেখান থেকে মুক্ত করাও। কিন্তু পুলিশের সাথে সাত পা কেন সত্তর হাজার পা হাঁটলেও মিত্রতা হওয়ার কোনো নিদর্শন নাই। পুলিশের সাথে মিত্রতা একমাত্র টাকা-পয়সার লেনদেনের মাধ্যমে হতে পারে যা মেঘলার নাই। তবে একথা ঠিক যে, সংসারধর্ম নারীর একমাত্র অবলম্বন না হলেও পিতা, স্বামী বা ভাই যেকোনো একজন পুরুষের অভিভাবকত্ব এ দেশে এখনো নারীর জন্য আবশ্যক। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তিও তাকে কোনো স্বাতন্ত্র এনে দেয় নাই।
যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি আর এসো না, নিবৃত্ত হও। তোমার শুদ্ধ ভাষা আর যুক্তিসম্মত বাক্য শুনে আমি তুষ্ট হয়েছি, তুমি বর চাও। সত্যবানের জীবন ভিন্ন যা চাও তাই দেব।’
সাবিত্রী বললেন, ‘আমার শ্বশুর অন্ধ এবং রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছেন। আপনার প্রসাদে তিনি চক্ষু লাভ করে অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় তেজস্বী হন।’
যম বললেন, তাই হবে। তোমাকে পথশ্রমে ক্লান্ত দেখছি, তুমি ফিরে যাও।
মেঘলাকে পুলিশ কোনো বর দেবে না এটাই স্বভাবিক। তার নম্র স্বভাব এবং যুক্তিসস্মত বাক্য শুনে তাদের হৃদয়ে কোনো কম্পন হবে না।
৪
একটা আধা অন্ধকার ঘরে গিয়ে বসল মেঘলা। জায়গাটা তার অচেনা। এটা কোনো অফিস তো নয়। পুলিশের বড়কর্তা হয়তো এখনো আসেন নাই। বা আদৌ আসবেন না। দুজন সাদা পোশাকধারী মানুষ বসে আছে। স্যার আসার আগে আমরা আপনার সাথে কিছু কথাবার্তা সেরে নেই! মেঘলার হ্যাঁ বা না বলায় কিছুই এসে যায় না। অন্যজন বলল, আসামি বিদ্যুৎ তিন ধরনের মামলায় চালান হইতে পারে, তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অভিযোগ থাকতে পারে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা, দ্বিতীয় অভিযোগ হইতে পারে হত্যাকাণ্ড ঘটানো, তৃতীয় হইতে পারে বোমাবাজি ও নাশকতা। বলেন এর কোনটা আপনারা চান?
আমরা চাইব মানে! আমি যতদূর জানি বিদ্যুৎ এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল না। সে একটা স্বাভাবিক দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিল। এ দেশের মানুষের কি গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কিছু থাকবে না!
আছে হয়তো, তবে সবার জন্য না। আর আপনারা যেইটা ভাবতেছেন, পুলিশ কিন্তু সেইটা ভাবতেছে না। পুলিশকে যদি এই রকম ভাবাইতে হয় তাহলে ক্রমান্বয়ে ৭ থেকে ১০ লাখের মতো একটা ডিলে রাজি হইতে হবে। এখন বলেন ডিলটা ঠিক কত লাখে হবে? টাকার ডিলের ওপর রিমান্ডের টর্চার ডিপেন্ড করবে। পার নাইট ১ লাখ।
মেঘলা শুনেছে সরকার নিজের সুবিধানুযায়ী অকারণে শাস্তি, যন্ত্রণা, সকলপ্রকার নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, বর্বরোচিত জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে বিরোধী মতাবলম্বীদের সাথে। মৌলিক অধিকারের দাবি নিয়ে যারা রাস্তায় নামে তাদের সাথেও করে! এর মধ্যে পুলিশের এই ডিলটা কতটা যৌক্তিক!
সাবিত্রী বললেন, স্বামীর নিকটে থাকলে আমার ক্লান্তি হবে কেন? তাঁর যে গতি আমারও সেই গতি। তা ছাড়া আপনার ন্যায় সজ্জনের সঙ্গে একবার মিলনও বাঞ্ছনীয়। তা নিস্ফল হয় না। সে জন্য সাধুসঙ্গেই থাকা উচিত। যম বললেন, তুমি যে হিত বাক্য বললে তা মনোহর বুদ্ধিপ্রদ। সত্যবানের জীবন ভিন্ন দ্বিতীয় একটি বর চাও।’ সাবিত্রী বর চেয়ে শ্বশুরের রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেন।
যম বললেন, কন্যা এখন নিবৃত্ত হও। আর পরিশ্রম করো না। সাবিত্রী বললেন, দেব, আপনি জগতের লোককে নিয়মানুসারে সংযত রাখেন এবং আয়ু শেষে তাদেরই কর্মানুসারে নিয়ে যান, আপনার নিজের ইচ্ছেয় নয়; এজন্যই আপনার নাম যম। আমার আর একটা কথা শুনুন, কর্ম মন ও বাক্য দ্বারা কোনোও প্রণীর অনিষ্ঠ না করা, অনুগ্রহ ও দান করা - এই সনাতন ধর্ম । জগতের লোক সাধারণত অল্পায়ু ও দুর্বল, সে জন্য সাধুজন শরণাগত অমিত্রকেও দয়া করেন।’
যম বললেন, পিপাসিতের পক্ষে যেমন জল, সেইরূপ তোমার বাক্য। কল্যাণী, সত্যবানের জীবন ভিন্ন আর একটা বর চাও।’ সাবিত্রী এবার তার পিতার পুত্রহীনতার দুঃখ ঘোচালেন। পিতার জন্য শতপুত্রের গ্যারান্টি আদায় করে নিলেন।
অপর পক্ষে মেঘলা পুলিশের বড় কর্তার অপেক্ষায় বসে। তার একটু পেছনে বসা লোকটি চাপা গলায় বলল, দেখুন বুঝলাম আপনার বাবা বেঁচে নাই। আপনার শশুরও নাই, আপনার পক্ষে হয়তো নগদ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হবে না; তা বলে কি সোনার গহনা বা জায়গা-জমিও নাই!
এই মুহূর্তে জমি বিক্রি করা কি সম্ভব!
সে ব্যবস্থা আমাদের কাছে আছে, জমি থাকলে বলুন, ব্যবস্থা হয়ে হয়ে যাবে পাশ থেকে দ্বিতীয়জন বলল।
আর দেখেন, আমাদের হাতে বেশি সময় নেই; এমন যদি হয় রিমান্ড যখন অর্ডার হয়েই গেছে নিয়ম মাফিক এটা তো করতেই হবে। কীভাবে করা হবে, কতটা কীভাবে করতে হবে; বুঝতেই পারছেন সবটাই পুলিশের হাতে!
লোকটা বলল, পুরোটাই যে এমন না আপনিও জানেন। আপনি চাইলে ক্ষমতাবান নেতার কাছেও যেতে পারেন; তবে তাতে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। আপনার হাজব্যান্ড তো বিরোধী শিবিরের লোক। ক্ষমতাবান আবার এত কাঁচা কাজ করে না।
যম বললেন, তুমি বহুদূরে এসে পড়েছ , এখন ফিরে যাও। সাবিত্রী বললেন, আমার পক্ষে এ দূর নয়, কারণ স্বামীর নিকটে আছি । আমার মন আরো দূরে ধাবিত হচ্ছে। আপনি বিবস্বানের(সুর্যের) পুত্র, সেজন্য আপনি বৈবস্বত; আপনি সমবুদ্ধিতে ধর্মানুসারে প্রজাশাসন করেন সেজন্য আপনি ধর্মরাজ। আপনি সজ্জন, সজ্জনের ওপর যেমন বিশ্বাস হয় তেমন নিজের ওপরও হয় না।
যম বললেন, তুমি যা বলছ তেমন বাক্য আমি কোথাও শুনিনি। তুমি সত্যবানের ভিন্ন আর একটি বর চাও।
সাবিত্রী বললেন, আমার গর্ভে সত্যবানের ঔরসে যেন বলবীর্যশালী শতপুত্র হয়।
যম বললেন, শতপুত্র তোমাকে আনন্দিত করবে। রাজকন্যা, দূরপথে এসেছ, ফিরে যাও।
সাবিত্রী বললেন, সাধুজন সর্বদাই ধর্মপথে থাকেন, তাঁরা দান করে অনুতপ্ত হন না। তাঁদের অনুগ্রহ ব্যর্থ হয় না, তাঁদের কাছে কারও প্রার্থনা বা সম্মান নষ্ট হয় না। তারা সবাই রক্ষক। যম বললেন, তোমার ধর্ম সম্মত হৃদয়গ্রাহী বাক্য শুনে তোমার প্রতি আমার ভক্তি হয়েছে। পতিব্রতা তুমি আর একটা বর চাও।
সাবিত্রী বললেন,... হে মানদ আপনি আমাকে শতপুত্রের বর দিয়েছেন অথচ আমার পতিকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। সত্যবান বেঁচে উঠুন এই বর চাচ্ছি। তাতে আপনার বাক্য সত্য হবে।
ধর্মরাজ যম বললেন, তাই হবে। তোমার পতিকে মুক্তি দিলাম। ইনি নিরোগ বলবান ও সফলকাম হবেন।
মেঘলার একবার মনে হয়েছিল, এই ছোটাছুটি বা তদ্বির সব অনর্থক নাতো! এ তো এক ভিন্ন লড়াই। এক ক্ষমতাধরের টিকে থাকার প্রশ্ন এখানে। এ মামলায় আপাত দৃষ্টিতে দৌর্বল্য কেউ দেখাবে না। এমন একটা আশঙ্কা মনের ভেতরে ঘুরে বেড়ালেও, অন্যদিকে তার হাল ছাড়ারও উপায় নেই।
ক্ষমতাবানের টাকার প্রয়োজন না থাকলেও অন্য ডিমান্ড থাকতে পারে। তবে সেই দিকটা এখন খোলা নেই। বিষয়টা মিডিয়ায় এসে গেছে। ফিসফিস করে বলছিল সাদা পোশাকের লোকটা। আপনি বরং একটা কাজ করতে পারেন। আমাদের একটা অস্ত্র দিন।
অস্ত্র! অস্ত্র কোথায় পাব! ওর তো কোনো অস্ত্র ছিল না।
অস্ত্রও নাই! এই না বললেন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলের ছাত্র নেতা ছিল!
হ্যাঁ।
বিয়ে কতদিন যেন হয়েছে বললেন?
এক মাস।
তাহলে জানার কথাও না। একটা অস্ত্র পেলে সুবিধা হতো আর কি। সেটা শো করা যেত। বলা যেত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে, রিমান্ড কার্যকর।
আপনি হয়তো জানেন না, এরা যাতে রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এজন্য এই সব বন্দিদের জেলেও মানসিকভাবে হেয় করার জন্য নানা ভাবে অনাবশ্যক ভাবে অপমান করা হয়- পায়ে বেড়ি পরিয়ে, আদালতের মেঝেতে বসিয়ে, অযথা চুরি অথবা ছিনতাইয়ের মতো কেস দিয়ে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সৎভাবে জীবন যাপনের যে সব মুখ্য প্রেরণা সব নষ্ট করে দেওয়া হয়।
মেঘলা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না, সে মাথা নিচু করে বসেছিল। ক্রমশ তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। অফিসার আদৌ আসবে না এটা সে বুঝতে পারছিল শুধু।
ঠিক আছে, আপনি তাহলে আজ আসুন।
কিন্তু রিমান্ডের ব্যাপারটা!
আপনাকে তো বললাম, কী কী করতে হবে। ব্যবস্থা করেন; আপনার কথাই রাখার চেষ্টা করব।
৫
রিমান্ডের ১০ দিন যেন কিছুতেই কাটতে চাইছিল না। জমি বিক্রি করার বিষয়টা খুব সহজ ছিল না। বিদ্যুতের বাবা মারা যাওয়ার পর জয়গা জমি কিছু ওর নামে ট্রান্সফার করা হয় নাই। জমি বিক্রির বিস্তর হ্যাপা। দলিলপত্রের ঝামেলা, মিউটেশন, এসবের সামনে ১০ দিন খুব অল্প সময়। তা ছাড়া জমি যা আছে তাতে কিছুতেই সাত লাখ টাকাও দাম উঠছিল না, ১০ লাখ তো দূরের কথা। জমির বাজার দর হয়তো আছে কিন্তু বিপদের সময় সবাই সস্তায় নিতে চায়। দিন যত ফুরোচ্ছিল, মেঘলার দম যেন ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছিল। একটা ভীষণ চাপ যেন তার পাঁজর ভেঙে দিচ্ছিল। এক-দুই-তিন করে দিনগুলো ঝরে পড়ছিল। নিষ্ফল প্রতিটি দিন। বিদ্যুৎকে বলাই হলো না সে তাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছিল। বলবে, যেদিন ওকে কোর্টে চালান করবে সেদিন বলবে। চারপাশে হয় তো অনেক লোকজন থাকবে, বিদ্যুৎ হয় তো সুস্থ অবস্থায় থাকবে না, তারপরও বলবে। ফিসফিস করে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলবে..!
অন্য সব দুর্ভোগের দিনের মতো সেই দিনটাও এলো আচমকাই! ফোনটা এলো ভোর রাতে..। সে যেন হঠাৎ কানে কালা হয়ে গেল। যেন প্রচণ্ড শব্দে একটা বোমা পড়েছে কোথাও। সারা পৃথিবীটা যেন কেঁপে উঠেছে। চারদিক শূন্য হয়ে যাওয়ার এক অনুভুতি হলো মেঘলার।
কথাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই চাউর হয়ে গেল, এক কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছে বিদ্যুৎ!