রম্যগল্প
গাবলু মিয়ার সেলফি রেকর্ড
গাবলু সাহেব সকালে তড়িঘড়ি ঘুম থেকে উঠলেন। আজ তাঁর ব্যক্তিগত সেলফি দিবস। তবে আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবস পালিত হচ্ছে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। গাবলু সাহেব নিজে ঘোষণা করেছেন, তাঁর প্রথম ব্যক্তিগত সেলফি দিবস। গতকাল রাতে খাওয়ার টেবিলে যখন মুরগির রানের মাংসে কামড় দিচ্ছিলেন, আইডিয়াটা মাথায় আসে তখন।
তড়িঘড়ি উঠে গাবলু সাহেব ওয়ার্ডরোবে তোলা জামা-কাপড় সব বের করে বিছানায় সাজিয়ে ফেললেন। লাল জামার পাশে নীল জামা, নীলের পাশে হলুদ। শার্টের পাশে কোট, কোটের পাশে গেঞ্জি। একটা কালো সানগ্লাস, গোল ফ্রেমের চশমা—সব রেখেছেন খাটে। সব পরে পরে সেলফি তুলবেন। আজ অন্তত হাজারখানেক সেলফি না তুলে তিনি ছাড়বেন না। ব্যক্তিগত দিবস বলে কথা। তা ছাড়া রেকর্ডেরও একটা ব্যাপার আছে।
আরে তাই তো! এতক্ষণ ব্যাপারটা মাথায়ই আসে নাই গাবলু সাহেবের। এই তো রেকর্ড করার চান্স। গিনেস বুকে নাম ওঠানোর এর চেয়ে সহজ তরিকা আর আছে? নাই। মনে মনে হাসেন গাবলু সাহেব। নিজের বুদ্ধির তারিফ করেন নিজেই। এইবার তিনি সেলফি তুলে বিশ্বরেকর্ড করবেন। তারে ছেলেমেয়েদের বুঝিয়ে দেবেন, বয়স বাড়লেও গাবলু সাহেব এখনো একেবারে ফুরিয়ে যায় নাই। এবার একখানা রেকর্ড করে তাক লাগিয়ে দেবেন সবাইকে। পরদিন পত্রিকায় গাবলু সাহেবের ছবি দিয়ে নিউজ ছাপা হবে, ‘সেলফি তুলে গাবলু মিয়ার বিশ্বরেকর্ড’। গাবলু সাহেব খাটের নিচ থেকে পুরোনো একটা পেপার বের করে চোখের সামনে মেলে ধরেন, এই তো, এইখানে ছাপা হবে তাঁর ফটো। আচ্ছা ভেতরের পাতায় ছাপা হবে, নাকি প্রথম পাতায়? প্রথম পাতায়ই হওয়ার কথা। এত বড় একটা রেকর্ড ভেতরের পাতায় ছাপা হতে যাবে কোন দুঃখে। অবশ্য হতেও পারে। আজকালকার পেপার-পত্রিকার কোনো ঠিক আছে? এরা ‘ছাপা’রে বানান ভুল করে লেখে ‘পাছা’!
ভেতরে ভেতরে সে রকম উত্তেজিত গাবলু সাহেব। তার এই পরিকল্পনার কথা এখনি ফাঁস করা যাবে না। তিনি ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যাওয়ায় পেটের ভেতর চু-চু করছে। গাবলু সাহবের এই এক অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠলেন, তো ক্ষুধা লাগে। সেটা পাঁচটার সময় ওঠেন আর বারোটার সময় ওঠেন, ফলাফল একই।
গাবলু সাহেব সব জিনিসপত্তর বিছানার ওপর থরে থরে সাজিয়ে রেখে বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে দেখেন চার্জ খুব কম। মোবাইল লাগালেন চার্জারে। রেকর্ড পরিমাণ সেলফি তুলতে কোনো হ্যাম্পার হওয়া চলবে না। অবশ্য গাবলু সাহেবের স্ত্রীর মোবাইলটা হলে কোনো টেনশন ছিল না। সেইটাতে দুই-তিন দিন চার্জ থাকে। তাঁর মোবাইল তো আর পাওয়া যাবে না।
মোবাইল দূরে থাক, গাবলু সাহেবের সঙ্গে ঘুমানোই বন্ধ করে দিয়েছেন এখন তাঁর স্ত্রী। আলাদা রুমে ঘুমান। গাবলু সাহেব নাকি বাঘের গর্জনের মতো নাক ডাকেন। তাঁর সঙ্গে ঘুমানো যায় না। অবশ্য এতকাল এই গর্জন শুনেই ঘুমানো যেত, কোনো অসুবিধা ছিল না। দিন যত যাচ্ছে, গাবলু সাহেবের নাকের গর্জন, চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া সবকিছুতেই ইদানীং সমস্যা হচ্ছে তাঁর স্ত্রীর। সব দেখেশুনে গাবলু সাহেব নিজেই একদিন বলেছেন, তাহলে আর কী? বিছানা আলাদা করে ঘুমালেই হয়! সেদিনই বাইরে থেকে এসে দেখেন, গাবলু সাহেবের বিছানাপত্তর সব অন্য রুমে শিফট করা হয়ে গেছে। গাবলু সাহেব সব দেখেশুনে তাঁর ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছেন, তারা চুপ; বরং মায়ের মতে তাদেরও মত আছে, চেহারা দেখে সহজেই বুঝতে পারেন তিনি। গাবলু সাহেব আলাদা থাকতে শুরু করেন।
শুধু ঘর আলাদা হলে কথা ছিল না, গাবলু সাহেব ইদানীং সবকিছু থেকেই আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দিনে দুই-একবার দেখা হলে হয়, না হলে নাই। তবে ছেলেমেয়েদের তিনি যে দেখেন না, তা না। দেখেন। ওদের ফেসবুকে ঢুকে ওদের হাসিমাখা মুখের ছবি দেখেন। অবশ্য তারা গাবলু সাহেবের ফ্রেন্ডলিস্টে নাই। গাবলু সাহেব সার্চ করে ওদের আইডিতে ঢুকে ছবি দেখে বের হয়ে যান। মাঝেমধ্যে মনে হয় কমেন্ট করেন, এমন হাঁসের মতো মুখ বানায়া ছবি তোলার চেয়ে স্বাভাবিকভাবে তুললেই তোরে খুব সুন্দর লাগে রে মা! কিন্তু করেন না।
গাবলু সাহেবের ছেলেমেয়েরাও সেলফি তোলে। নিজেরা নিজেদের ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়। গাবলু সাহেবের মনে হয়, হইল না তো! আরেকটু সুন্দর করে ছবিটা তুললে ভালো হইত। তার মাঝেমধ্যে মনে হয়, নিজে ছেলেমেয়ে দুটিকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে দেন।
ফেসবুকে ছেলেমেয়েদের এসব সেলফি দেখতে দেখতেই গাবলু সাহেবের মাথায় আইডিয়াটা আসে। একদিন তিনি সেলফি দিবস পালন করবেন। কয়েক হাজার সেলফি তুলে সবাইকে চমকে দেবেন। অবশ্য এখন সেই আইডিয়াটা আরেকটু ডেভেলপড হয়ে বিশ্বরেকর্ড করার আইডিয়ায় এসে ঠেকছে। সেলফি তুলে বিশ্বরেকর্ড। তাঁর স্ত্রীকেও বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, যতই কদর কমুক, গাবলু সাহেবের সব এখনো ফুরিয়ে যায় নাই। সারাদিন এই পার্টি সেই অনুষ্ঠান করে বেড়াও তো, দেখ এইবার আমি কী করি, ভাবেন গাবলু সাহেব।
গাবলু সাহেব নিজের রুম বন্ধ করে ডাইনিং রুমে এসে দেখেন, নাশতা এখনো রেডি হয় নাই। নাশতা হবে কী, তাঁর স্ত্রীই এখনো উঠে নাই। রাতের কিছু ভাত আর এক বাটি ডাল ঢাকা আছে। গাবলু সাহেব চুপচাপ বসে খেয়ে নিলেন। খেতে বসে একবার হাসি পেল তাঁর। আজ দেখবে মজা সবাই।
কড়কড়া ভাত আর বাসি ডাল দিয়ে নাশতা সেড়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলেন গাবলু সাহেব। এইবার তাঁর সেলফি তোলার পালা। ঠিক করলেন বিভিন্ন স্টাইলে তুলবেন সেলফি। শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, আধশোয়া হয়ে, কোনোটা খালি গায়ে, কোনোটা জামা গায়ে। কখনো লাল শার্ট, কখনো নীলটা। কখনো গেঞ্জি তো কোনোটা আবার তুলবেন কোট-টাই লাগিয়ে চোখে কালো সানগ্লাসটা পরে। তবে প্রশ্ন হলো, কতগুলো সেলফি তুললে বিশ্বরেকর্ড গড়া সম্ভব হবে? এক হাজার, দুই হাজারের বেল নাই। অন্তত লাখখানেক তো তুলতে হবেই। মনে মনে ভাবলেন, আরেকটা রেকর্ড অবশ্য এর ভেতর দিয়েই করে ফেলা যায়। নিরবচ্ছিন্ন সেলফি তুলবেন তিনি। বাইরে যাবেন না, কারো সঙ্গে কথা বলবেন না, খাবেন না, এমনকি পানিও না।
গাবলু সাহেব সব গোছগাছ করে সেলফি তোলা শুরু করলেন সকাল ৯টায়। এখন দুপুর ১২টা বাজে। তিনি সেলফি তুলছেন। একটার পর একটা। আরেকটার পর আরেকটা। বসে, শুয়ে, চিৎ হয়ে, কাত হয়ে। হাঁ করে, মুখ বুজে। চোখ খুলে, চোখ বুজে। হাঁটু ভাঁজ করে, হাঁটু সোজা করে। শুধু ডাক ফেস কেনো, গাবলু সাহেব ফক্স ফেস, র্যাট ফেস, টাইগার ফেস, মাংকি ফেস, ক্যাট ফেস, আউল ফেস করে ছবি তুলছেন। একটা একটা ফেস আবিষ্কার করছেন মনে মনে, অমনি তুলে ফেলছেন ওই ফেসে সেলফি। তুলছেন তিনি একের পর এক। তুলছেন, কাপড় বদলাচ্ছেন। আবার তুলছেন।
রাত ১০টার ওপরে বাজে। এর মধ্যে একবার শুধু গাবলু সাহেবের স্ত্রী তাঁর খোঁজ করেছিলেন। বাসার কাজের মেয়েটি বলেছে, খালুজান নিজের ঘরেই আছেন। গাবলু সাহেবের স্ত্রী আর গা করেননি। আছে যখন থাকুক। বিকেলে বের হয়েছিলেন। খানিক আগে ফিরেও যখন গাবলু সাহেবের কোনো সাড়াশব্দ পেলেন না, তখন ছেলেমেয়ে দুটিকে ডাকলেন—দেখ তো বুড়ো ভামটা কী করছে নিজের ঘরে? সারা দিন বের হয় নাই। গাবলু সাহেবের স্ত্রী ইদানীং তাকে বুড়ো ভাম বলে ডাকে। অবশ্য গাবলু সাহেব এতে আপত্তি করেন না। বেশি বয়সে অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করলে এট্টু-আট্টু এমন হয়ই।
গাবলু সাহেবের ছেলেমেয়ে, স্ত্রী সবাই এসে দরজার পাশে ডাকাডাকি শুরু করল। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নাই। তবে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে মানুষের নড়াচড়া হচ্ছে। গাবলু সাহেবকে ডাকছেন সবাই। তাঁর মেয়ে, তাঁর ছেলে, তাঁর স্ত্রী। তিনি জবাব দিচ্ছেন না। দরজাও খুলছেন না।
অবশেষে গাবলু সাহেবের স্ত্রী-ছেলেমেয়ে জানালার পর্দার ফাঁক গলিয়ে দেখল, গাবলু সাহেব ঘরের ভেতর সেলফি তুলছেন। তাঁর গা ঘেমে একাকার। কখনো হাসছেন, হাসি হাসি মুখের সামনে মোবাইল ধরে ক্লিক করছেন। কখনো চোখ করছেন বড়বড়। তুলছেন সেলফি। সারা দিনভর জামা-কাপড় পরে অনেক কায়দায়, অনেক বেকায়দায় সেলফি তুলেছেন তিনি। এখন আর ওইসব জামা-কাপড় ভালো লাগছে না তাঁর। কিন্তু রেকর্ড তো করতে হবে। তিনি একে একে গা থেকে জামা-কাপড় খুলছেন আর সেলফি তুলছেন।
এ মুহূর্তে গাবলু সাহেবের পরনে শুধু একটা শর্টস। সারা গা উদাম। বোগলের নিচে পশমগুলো অনেক বড় হয়েছে। অনেক দিন ওসব কাটাকাটির মধ্যে দিয়ে যান না। বাইরে থেকে ডাকছে ওরা, গাবলু সাহেব সেই ডাক কানেই নিচ্ছেন না। তিনি একের পর এক সেলফি তুলে যাচ্ছেন। বারবার হাত ঢুকিয়ে দিচ্ছেন শর্টসের ভেতরে। হাবেভাবে মনে হচ্ছে, ওইটাও খুলে ফেলবেন কখন যেন।
গাবলু সাহেবের ছেলে এরই মধ্যে চলে গেছে দরজা ভাঙার মিস্ত্রি আনতে। সে নিজে বারকয়েক লাথি দিয়েছিল দরজায়। শক্ত কাঠের দরজা। কিচ্ছু হয় নাই। প্লাস্টিকের দরজা হলে অবশ্য কোনো কথা ছিল না। এক লাথিতেই কাজ হয়ে যেত। কাঠের দরজা লাথি খেয়েও বন্ধ রইল ঠায়। উল্টো পায়ে আঘাত পাবে বলে গাবলু সাহেবের স্ত্রী আর লাথি দিতে দেয় নাই তার ছেলেকে। গাবলু সাহেবের মেয়েটা, বাবা দরজা খোল, বাবা দরজা খোল বলে ডাকছে। তার দুই গাল ভেজা। সে চিৎকার করে কাঁদছে। কিন্তু মার ধমকের ভয়ে টুঁ শব্দ করছে না।
গাবলু সাহেব সেলফি তুলেই যাচ্ছেন একের পর এক। আজ বিশ্বরেকর্ড না করে ছাড়ছেন না তিনি।