ঢাকার কথা ৫
রাজধানীতে কাটরা ইমারত

মোগল আমলে রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েকটি কাটরা ইমারত নির্মিত হয়েছিল। কাটরা হচ্ছে রাজকীয় অতিথিশালা বা সরাইখানা। মোগলদের মধ্যে অনেক পারস্যের প্রভাব ছিল। বিশেষ করে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনকালে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের প্রভাবে পারস্যের ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। পারস্যের সংস্কৃতির প্রতিফলন সুলতানি শাসন যুগ থেকেই স্পষ্ট হতে থাকে। সুলতান এবং মোগলদের রাজভাষা ছিল ফারসি। সুলাতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সাথে পত্র মারফত যোগাযোগ রেখেছিলেন। ঢাকাতে মোগল যুগে শিয়া বসতি গড়ে উঠেছিল। এরা প্রধানত ইরান অর্থাৎ পারস্য থেকে মোগল যুগে ঢাকায় এসেছিলেন। এ সময়ে ঢাকায় তৈরি মোগল স্থাপত্য, চিত্রকলা ও মোগল অভিজাতদের পোশাকে ইরানি প্রভাব ছিল অনেক বেশি স্পষ্ট। কাটরা ইমারত নির্মাণও পারস্য স্থাপত্যেরই প্রতিফলন।
পারস্যে এক ধরনের ক্যারাভান সরাইখানা নির্মাণ করা হতো। এসব সরাইখানাতে অতিথি কক্ষগুলোর সামনে থাকত খিলানযুক্ত বারান্দা। সামনে থাকত একটি বড় উঠোন। প্রাচীন পারস্যে এই সরাইখানা ধারণাটি উপস্থাপন করেন সম্রাট প্রথম দারায়ুস (৫১২-৪৮৬ খ্রিস্টপূর্ব)। তিনি বিশাল সাম্রাজ্যের খোঁজ খবর দ্রুত নেওয়ার জন্য ঘোড়ার ডাকের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য পথের পাশে ১৪ মাইল পরপর সরাইখানা তৈরি করেছিলেন। যাতে এখানে শ্রান্ত ঘোড়া ও ঘোরসওয়ার বদল করে নতুন ঘোড়া নিয়ে দ্রুত ডাক পৌঁছে দেওয়া যায়। তাই আঙিনার পাশে ঘোড়া বাধার জায়গাঁও ছিল।
মোগল সুবাদাররা কাটরা নির্মাণের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন প্রশাসনিক কারণে। দিল্লির সাথে সুবাদারদের সরাসরি যোগযোগ রাখতে হতো। অনেক কর্মকর্তা আসতেন দাপ্তরিক কাজে। ব্যবসায়িক কাজে বণিকরাও আসতেন ঢাকায়। এই রাষ্ট্রীয় অতিথিদের অবস্থানের জন্য ঢাকায় অনেক কাটরা বা অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়। বিখ্যাত বড় কাটরা ও ছোট কাটরা ছাড়াও আরো অনেক কাটরা নির্মিত হয়েছিল ঢাকায়। কালের আঘাতে তা আজ আর টিকে নেই। প্রতিটি কাটরাই পরিপূর্ণ অতিথিশালা ছিল। এখানে যেমন রাত কাটানোর ব্যবস্থা ছিল, তেমনি প্রতিটি কাটরাতে ছিল রান্নাঘর, স্টোররুম, গোসলখানা, মসজিদ এবং ছোট আকারের চিকিৎসালয়।
বড় ও ছোট কাটরা ছাড়া অন্য যেসব কাটরার নাম সমকালীন দলিলে পাওয়া যায় তা হচ্ছেÑমুকিম কাটরা, মোগলটুলি কাটরা, বখশিবাজারের কাটরা, মায়া কাটরা (অবস্থান নিশ্চিত নয়), নওয়াব কাটরা (বর্তমান ইসলামপুর), নাজিরা বাজারের নাজির কাটরা. বাদামতলী কাটরা (চকবাজারের কাছে), রহমতগঞ্জ কাটরা ইত্যাদি। এ ছাড়া বর্তমান মিটফোর্ড হাসপাতালের স্থানে শায়েস্তা খান একটি কাটরা নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। এখনকার কারওয়ান বাজার এলাকায়ও মোগল যুগে কয়েকটি কাটরা নির্মিত হয়েছিল। মোগল আমলের ধ্বংসপ্রাপ্ত কাটরাগুলোর মধ্যে মুকিম কাটরা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এখন মুকিম কাটরার অস্তিত্ব না থাকলেও মুকিম কাটরা নামের মহল্লাটি রয়েছে। চকবাজার ও মৌলভী বাজারের মাঝামাঝি এর অবস্থান। মির্জা মুকিম সুবাদার মীর জুমলার অধীনে কর্মকর্তা ছিলেন। ‘নাওয়ারা মহল’নামের একটি মহলের তদারকির প্রধান দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। তিনি বসবাস করতেন দিলখুশা অঞ্চলে। বর্তমান বঙ্গভবন এলাকাটি ছিল তাঁর বসবাস অঞ্চল। মির্জা মুকিম মৌলভী বাজারের কাছে কাটরাটি নির্মাণ করেছিলেন। এ কারণেই ইমারতটির নামকরণ করা হয়েছিল মুকিম কাটরা। কাটরাটির নির্মাণকাল ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দ।
একটি নগর ঘিরে এতসব কাটরার অবস্থান সে যুগে ঢাকার নাগরিক জীবনের উন্নয়ন ও ব্যবসা বাণিজ্যের গতিশীলতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। কারণ বাংলা সুবার বাইরে থেকে বিভিন্ন কারণে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির ঢাকায় আগমন ঘটত বলেই তাঁদের জন্য এত সব অতিথিশালা নির্মাণের প্রয়োজন পড়ত।
ধর্মীয় ইমারতের বাইরে মোগল যুগে ঢাকায় যেসব ইমারত নির্মিত হয়েছিল, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বড় কাটরা এবং ছোট কাটরা নামের দুটো রাজকীয় অতিথিশালা। বড় কাটরাটি নির্মিত হয়েছিল সুবাদার শাহ সুজার সময়। বড় কাটরায় ফার্সিতে লেখা দুটে শিলালিপি পাওয়া গেছে। তাতে বোঝা যায় দুই পর্বে এই ইমারতটি নির্মিত হয়েছিল। প্রথম শিলালিপিতে নির্মাণ তারিখ রয়েছে ১৬৪৩ থেকে ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ। দ্বিতীয়টিতে লেখা হয়েছে ১৬৪৫ থেকে ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ। এই সময়কালের মধ্যে বড় কাটরাটি নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল। এখন বুড়িগঙ্গা নদী অনেকটা সরে যাওয়ায় বড় কাটরার সাথে দূরত্ব বেড়েছে। কিন্তু সে যুগে বড় কাটরা ছিল বুড়িগঙ্গার ধার ঘেঁষে। চকবাজারের দক্ষিণ দিকে এই ইমারতের অবস্থান। এখন বড় কাটরা একটি ধ্বংসপ্রায় ইমারত। দখলদারদের অবস্থান- ইত্যাদি কারণে বড় কাটরার বিবর্ণ দশা। কিন্তু মোগল ঢাকায় এটি ছিল দৃষ্টিনন্দন ইমারত। সে সময় আয়তকার একটি প্রাঙ্গণকে ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছিল ইমারতটি। মাঝখানে আঙিনা রেখে চারদিকে ২২টি কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। বুড়িগঙ্গার দিকে মুখ করা ছিল সদর দরজা। মোগল তোরণের আদলে তিনতলা বিশিষ্ট বিশাল তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল কাটরার প্রবেশমুখে। কাটরার কিছু অংশ ছিল দ্বিতল। সব রকম সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল এই অতিথিশালায়।
শাহ সুজা কাটরা নির্মাণের পর তা ব্যবহার ও পরিচালনার জন্য কিছু নিয়মনীতি প্রণয়ন করেছিলেন। প্রথমে কাটরা পরিচালনা করার জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। মীর আবুল কাশিম নামের এক সরকারি কর্মকর্তাকে তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাটরাটিকে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কর্মচারীদের নির্দেশ দেওয়া হয় কেউ অতিথিশালায় বসবাস করার যোগ্য বিবেচিত হলে তাঁর কাছ থেকে কোনো ভাড়া নেওয়া যাবে না।
সবাই জানেন বড়কাটরার এখন বিবর্ণ দশা। এ দেশে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, জমি দখলকারীদের থাবা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা এই প্রত্নস্থাপনাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এখানে আইনের বাধ্যবাধকতাও আছে। মালিকপক্ষ বলে দাবিদারদের বিরোধিতায় ভবনটির প্রথামাফিক সংস্কারও করা যাচ্ছে না। উপরন্তু প্রত্নবিধি না মেনে একাধিকবার সংস্কার করে ইমারতের আদিরূপ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বহুতল ভবন নির্মাণের দাপটে এরপর হয়তো বড় কাটরাকে বইয়ের পাতা থেকেই চিনে নিতে হবে।
ছোট কাটরাটি নির্মিত হয় আরো পরে। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন খ্যাতিমান সুবাদার শায়েস্তা খান ঢাকাকে নিজের মতো করে সাজাচ্ছেন। এই নতুন অতিথিশালা নির্মাণের জন্য তিনি বড় কাটরার কাছাকাছি জায়গা নির্বাচন করলেন। ছোট কাটরার অবস্থানও বুড়িগঙ্গার তীরে। বড় কাটরা থেকে সামান্য পূর্ব দিকে। এর স্থাপত্য শৈলীও বড়কাটরার অনুরূপ। শাহ সুজার কাটরার চেয়ে আকারে একটু ছোট হওয়ায় মানুষের মুখে মুখে আগেরটি বড় কাটরা আর এটি ছোট কাটরা নামে পরিচিতি পায়। ছোট কাটরার উত্তর ও দক্ষিণে দুটো বড় তোরণ আছে।
বড় কাটরার পাশেই আরেকটি কাটরা তৈরির বড় কারণ সম্ভবত সুবাদারের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করার তাগিদ। প্রকৃত অর্থে ঢাকায় মোগল সুবাদারদের জন্য কোনো প্রাসাদ নির্মিত হয়নি। যে কারণে লালবাগ প্রাসাদ দুর্গে কোনো প্রাসাদ নেই। বিভিন্ন সূত্রের আলোকে মনে করা হয়, সুবাদাররা দূর্গ ঘেঁষে বুড়িগঙ্গায় রাজকীয় বজরাতে বসবাস করতেন। অথবা কেউ কেউ কাটরাকেই বাসস্থানে রূপান্তর করতেন। সূত্র মতে শায়েস্তা খান নিজের বাসস্থানের চিন্তা করেই ছোট কাটরাটি নির্মাণ করেছিলেন।
কাটরাতে মোগল রীতির চমৎকার মিনার তৈরি করা হয়েছিল। প্রাসাদের সিঁড়ি ও মেঝে কাঠের তৈরি। সিঁড়ি ছিল বেশ প্রশস্ত। মোগল কাটরার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাটরার আঙিনার পাশে ঘোড়া রাখার জায়গা, তাহাখানা বা হাম্মাম নামে পরিচিত গোসল খানা, রান্নাঘর সব কিছুরই বন্দোবস্ত ছিল।