কুরোসাওয়া কথা
কেন্দোর পাঠশালা
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
তাইশু যুগে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে, পঞ্চম শ্রেণির নিয়মিত পাঠ্যসূচিতে কেন্দো সোর্ডম্যানশিপ অন্তর্ভুক্ত হয়। সপ্তাহে একদিন, দুই ঘণ্টার ক্লাস ছিল এটি; শুরু হতো বাঁশের তলোয়ার হাতে ধরার প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। এরপর আমরা শিখেছি আঘাত ঠেকানো ও আঘাত করা; এবং সবশেষে আমাদের এ স্কুলটির প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে যাওয়া, এ খেলার বিশেষ পোশাকগুলো পরে লড়তে হতো। বলে রাখা ভালো, পোশাকগুলো আনা হয়েছিল সত্যিকারের প্রতিযোগিতা থেকে—যেগুলোর কি না দুই-তৃতীয়াংশই ব্যবহার উপযোগী ছিল তখনো।
লড়াইয়ে নামার আগে সাধারণত নিয়মিত শিক্ষকদের মধ্য থেকে সেরা একজন আমাদের নির্দেশনা দিতেন, যিনি বিশেষ করে কেন্দো খেলাটা ভালো বোঝেন। তবে কখনো কখনো ফেন্সিং মাস্টার, যার নিজেরই কি না একটি স্কুল রয়েছে, তিনি তার একজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হতেন—আমাদের ভুল-ত্রুটি শুধরে দিতে। পাঠ দেওয়ার জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ছাত্রদেরই বেছে নিতেন তারা; এবং প্রায়ই মাস্টার ও তাঁর সহকারী সত্যিকারের তলোয়ার ব্যবহার করতেন এবং নিজেদের স্কুলের স্টাইলে বেসিক টেকনিকগুলো খেলে দেখাতেন।
কুরোদা প্রাইমারি স্কুলে যে ফেন্সিং মাস্টার এসেছিলেন, তাঁর নাম ওচিয়াই মাগোসাবুরো। [কিংবা তাঁর নাম মাতাসাবুরোও হতে পারে। বস্তুতপক্ষে একজন টিপিক্যাল সোর্ডম্যানের মতোই নাম ছিল তাঁর, তবে তা এখন আর নির্ভুলভাবে মনে পড়ছে না।] তিনি একজন আকর্ষণীয় ও ব্যতিক্রমধর্মী শক্তিধর মানুষ ছিলেন; এবং তিনি যখন নিজের সহকারীর সঙ্গে তার সোর্ডপ্লে স্টাইল খেলে দেখাতেন, তখন তাঁর বিস্ময়াবিভূত রকমের শক্তিমত্তার দেখা পাওয়া যেত। ছাত্ররা শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা নিয়ে দেখতে থাকত তাঁর প্রদর্শনী।
মাস্টারের নিবিড়ভাবে বেছে নেওয়া মেধাবী ছাত্রদের তালিকায় জায়গা পেয়েছিলাম আমিও। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে পাঠ দিতেন; এবং হুট করেই খেলাটির প্রতি আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ি। আমি তাঁর সঙ্গে লড়তে নেমে যেতাম, নিজের মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরতাম আমার বাঁশের তলোয়ার, আর চিৎকার দিয়ে ওঠতাম, ‘শ-য়-তা-ন!’ কিন্তু যখনই তাঁকে আক্রমণ করতে অগ্রসর হতাম, তখন অবাক হয়ে অনুভব করতাম— যেন শূন্যে উড়ছি; বাতাসে লাথি মারতাম আমি; তখনই ওচিয়াই মাগোসাবুরো তাঁর পুরুষালি হাত দিয়ে, না নড়েই, আমাকে ধরে তুলে ফেলতেন তাঁর কাঁধ বরাবর উচ্চতায়। আমি একেবারেই তাজ্জব হয়ে যেতাম। এই সোর্ডসম্যানের প্রতি স্বভাবতই আকাশচুম্বী শ্রদ্ধা জন্মেছিল আমার মনে।
আমি সোজা গিয়ে হাজির হয়েছিলাম বাবার সামনে; তাঁর কাছে মিনতি করেছিলাম, আমাকে যেন ওচিয়াইয়ের ফেন্সিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। বাবা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আমি জানি না, বাবার শিরা বেয়েই আমার শরীরে সামুরাই রক্তের পুনরুত্থান ঘটেছিল, নাকি ঘটেছিল তাঁর মিলিটারি একাডেমি টিচারের আত্মার পুনর্জাগরণ; তবে যেভাবে যা-ই ঘটুক-না-কেন, এর প্রভাব ছিল প্রবল।
এসব ঘটছিল সে সময়টিতে, যখন আমার ভাইয়া—যার ওপর নাকি বাবার অশেষ প্রত্যাশা ছিল, অথচ তিনি সেসব প্রত্যাশায় গুড়েবালি দিতে শুরু করেছিলেন। এ সময়টির আগপর্যন্ত আমাকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না বাবা; তবে এর পর থেকে, মনে হলো, তার প্রত্যাশাগুলো ভাইয়ার কাছ থেকে সরে গিয়ে আমার ওপর পড়তে শুরু করেছে; এবং আমার প্রতি অগাধ মনোযোগ ও কড়াকড়ি মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেন তিনি।
কেন্দোর প্রতি আমার আসক্তিকে বাবা বেশ সমীহের সঙ্গে নিয়েছিলেন; এবং জোর দিয়ে বলেছিলেন, ক্যালিগ্রাফির পাঠও যেন আমি ভালোভাবে নিই। তা ছাড়া নিজের আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে, আমি যেন প্রতিদিন সকালে ওচিয়াই স্কুলে কেন্দো পাঠ সেরে ফেরার পথে হাচিমান মন্দিরে হাজির হই—সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। ওচিয়াই স্কুলটি ছিল অনেক দূরে। আমাদের বাড়ি থেকে কুরোদা প্রাইমারি স্কুলটির দূরত্ব ছিল একজন শিশুর পক্ষে পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট দূরেই; অথচ সেই তুলনায় ওচিয়াই স্কুলের দূরত্ব ছিল পাঁচ গুণ বেশি।
সৌভাগ্যক্রমে, প্রতি সকালে যে সুনির্দিষ্ট হাচিমান প্রার্থনালয়ে যাওয়ার জন্য বাবা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেটি ছিল কুরোদা প্রাইমারি স্কুলের কাছেই; এবং ফেন্সিং স্কুল থেকে ফেরার পথেই পড়ত সেটি। অথচ বাবার নির্দেশ মানতে গিয়ে, সকালে আমাকে যেতে হতো ওচিয়াই স্কুলে, ফেন্সিং পাঠ শেষে ফেরার পথে যেতে হতো হাচিমান প্রার্থনালয়ে, তারপর বাড়ি ফিরতে হতো সকালের নাশতা খাওয়ার জন্য এবং তারপর যেতে হতো কুরোদা প্রাইমারি স্কুলে। স্কুল ছুটি হলে, আমাকে যেতে হতো ক্যালিগ্রাফি শিক্ষকের বাড়িতে : সৌভাগ্যক্রমে সেটি ছিল আমার বাড়ি ফেরার পথের মাঝেই। এরপর আমি যেতাম মিস্টার তাচিকাওয়ার বাড়ি। এই শেষ যাত্রাটি অবশ্য আমার নিজেরই বেছে নেওয়া ছিল। কুরোদা প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন মিস্টার তাচিকাওয়া; তবু উয়েকুসা আর আমি তাঁর বাড়ি আসা-যাওয়া থামাইনি। উন্মুক্ত শিক্ষার আবহ এবং তাঁর সৃষ্ট শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে অনেকগুলো অর্থবহ দিন আমরা কাটিয়েছি; পরম মমতা নিয়ে আমাদের সমাদর করতেন তাঁর স্ত্রী। আমার অন্য কাজ-কারবারের কী হাল—সেসব না ভেবে, এই গভীর তাৎপর্যময় সময়গুলো মিস করতে আমি চাইতাম না।
এই দৈনন্দিন কর্মসূচিটি পালন করার জন্য, প্রতি সকালে ঊষালগ্নের আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হতো আমাকে, আর রাতে বাড়ি ফেরার আগেই সূর্য যেত ডুবে। প্রার্থনালয়ে যাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল বের করার চেষ্টা করেছিলাম আমি; কিন্তু বাবা সে পথ আটকে দিয়েছিলেন। আমার ধার্মিকতার হিসেব টুকে রাখার জন্য, তিনি আমাকে ছোট্ট একটা ডায়েরি দিয়েছিলেন—যেটিতে প্রতি সকালে প্রার্থনালয়টির সিলমোহরের ছাপ নিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা ছিল আমার জন্য!
এর থেকে নিষ্কৃতির কোনো পথ ছিল না। কেন্দোর পাঠ নিতে চাওয়ার যে নিষ্পাপ আর্তি আমি জানিয়েছিলাম, সেটির পরিণাম আমার জন্য বয়ে এনেছিল এমন অপ্রত্যাশিত চাপের বহর। কিন্তু যেহেতু এই চাওয়াটি ছিল নিজেরই, ফলে আর কিছুই করার ছিল না আমার। ভর্তির আবেদন করার সময় ওচিয়াই ফেন্সিং স্কুলে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং বাবা, এবং ক্লাস শুরু হয়েছিল পরের দিন সকালেই; আর এই কঠোর দৈনন্দিন কর্মসূচি আমাকে চালিয়ে যেতে হয় এর পরের বেশ কয়েকটি বছর—যত দিন না আমি কুরোদা প্রাইমারি স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হই। শুধু রোববারগুলো আর গ্রীষ্মের ছুটিতেই কেবল এটি থেকে রেহাই পেতাম এ থেকে।
বাবা আমাকে কাঠের খড়মের সঙ্গে ‘তাবি’ [খড়মের জন্য বিশেষ রকমের] মোজা পরার অনুমতি দেননি; এমনকি শীতকালেও না। ফলে শীতের দিনে আমার পা বাজেভাবে ফেটে যেত এবং কালসিটে দাগ পড়ে ঘা হয়ে যেত পায়ে। গরম পানিতে পা ধুয়ে দিয়ে, আর ওষুধ লাগিয়ে মা আমাকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। আমার মা ছিলেন সেই মেইজি যুগের, মানে দ্রুততার সঙ্গে আধুনিকায়িত হতে থাকা জাপানের সেই সবিশেষ সময়কালের একজন টিপিক্যাল নারী—যখনো কি না নিজ পিতা, স্বামী, ভাই কিংবা পুত্রের সুবিধার জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগে প্রস্তুত ছিলেন নারীরা। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি ছিলেন একজন মিলিটারির স্ত্রী। [অনেক বছর পরে, ইতিহাসভিত্তিক ঔপন্যাসিক ইয়ামোতো শুগোরোর ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অব দ্য ডিউটিজ অব জাপানিজ উইমেন’ বইটি পড়ে এসব অসম্ভব ধরনের বীর্যবান প্রাণীর (পুরুষ) মধ্যে মায়ের অবস্থান আমি টের পেয়েছিলাম, এবং শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম।] এভাবেই বাবার চোখ এড়িয়ে, আমার যত অভিযোগ-অনুযোগের সুরাহা করতেন তিনি। তার কথা লিখতে গেলে মনে হয়, যেন কোনো নীতিগল্পের একটি আদর্শ চরিত্র হিসেবে তাকে আমি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়; বরং তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন এমন নম্র আত্মার অধিকারিনী যে, এ কাজগুলো তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করেছেন।
প্রথমত আমি মনে করি, তিনি যা যা করেছেন, তা সেই সময়ের তুলনায় বরং উল্টো ছিল। আমার বাবা ছিলেন আসলে ভীষণ রকম আবেগপ্রবণ মানুষ; আর মা ছিলেন বাস্তবধর্মী। যুদ্ধের দিনগুলোতে, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি যখন আকিতা প্রিফেকচার অঞ্চলে যেতাম—যেখানে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন বসবাস করতে, তখন তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমাকে এমন সব অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হতো, যেন আর কোনোদিনই হয়তো দেখা হবে না আমাদের। বাড়িটির সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে, নিঃসঙ্গ এক রাস্তা ধরে হেঁটে চলে আসতাম আমি। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতাম, বাবা-মা দাঁড়িয়ে অপলক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মা-ই আচমকা ঘুরে দাঁড়াতেন, আর ফিরে যেতেন বাড়ির ভেতরে। বাবা তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, অপলক তাকিয়ে থাকতেন আমার দিকে—যতক্ষণ না তার চোখের সামনে আমার অবয়ব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়ে মিলিয়ে যেত।
যুদ্ধের দিনগুলোতে একটা গান খুব জনপ্রিয় ছিল—‘বাবা, তুমি খুব দৃঢ়চেতা ছিলে’; কিন্তু আমি বলতে চাই, ‘মা, তুমি খুব দৃঢ়চেতা ছিলে’। আমার মায়ের শক্তিমত্তা নিহিত থাকত মূলত তার সহনশীলতার মধ্যে। একটা বিস্ময়কর উদাহরণ মনে পড়ে আমার। একদিন তিনি যখন রান্নাঘরে টেম্পোরা ডিপ-ফ্রাই করছিলেন, ঘটনাটি ঘটেছিল তখন। পাত্রে থাকা তেলের মধ্যে আগুন ধরে গিয়েছিল। আগুন যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য গরম পাত্রটি খালি হাতেই তুলে নিয়ে, ভ্রু ও চোখের পাতার লোম কুঁচকে, তাতামি-ম্যাট রুমটি ধরে শান্তভাবে হেঁটে, যথাযথভাবে পায়ে খড়ম পরে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন বাগানের দরজার দিকে; তারপর বাগানের ঠিক মাঝখানে গিয়ে, শান্তভাবে নামিয়ে রেখেছেন আগুন-জ্বলা পাত্র। এরপর ডাক্তার এসে, পুড়ে যাওয়া চামড়াগুলো চিমটা দিয়ে তুলে, ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছেন মায়ের দগ্ধ হাত দুটিতে। দৃশ্যটা আমার সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু মায়ের মুখের অভিব্যক্তিতে যন্ত্রণার কোনো ছাপই ফুটে ওঠেনি। ব্যান্ডেজ করা হাত দিয়ে প্রায় এক মাসের মতো কোনো কিছু ধরতেই পারেননি তিনি। হাত দুটো বুকের কাছে ভাঁজ করে রাখলেও, যন্ত্রণা সম্পর্কে সামান্য টুঁ-শব্দও করেননি কখনো; স্রেফ শান্তভাবে বসে থেকেছেন। জানি, যতই চেষ্টা করি না কেন, আমি কখনোই তার মতো এমন হতে পারব না।
(চলবে)