মুক্তগদ্য
একজন বাবার অবয়ব

১৯৮৪ সালের আগস্ট মাস। বৃষ্টি ঝড়া বর্ষা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক আমি। ঢাকায় থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ক্যাম্পাসে যাই। সকাল সাড়ে ৮টার ক্লাস ধরতে বেশ সকাল সকাল বেরুতে হয়। রামপুরা থেকে রিকশায় মৌচাক। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরে ক্যাম্পাসে আসি। ভারি বর্ষণে ছাতা মানে না। আধভেজা হয়ে যখন কলাভবনের দোতলায় আমার বিভাগে আসি, তখন দু-চারটে চড়ুই ছাড়া প্রাণের আর কোনো সাড়া নেই। বৃষ্টির দাপটে ছাত্রছাত্রী দূরের কথা পিয়ন এসেও দরজা খোলেনি। তবু আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্বস্তি পাই। না, এখনো সাড়ে ৮টা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। সহকর্মী বন্ধুরা মনে করেন এ এক পাগলামো। আমি জানি ছেলেবেলা থেকে বাবার সময়ানুবর্তিতা দেখে আমার এ এক মজ্জাগত উত্তরাধিকার।
আমার বাবা (আমরা আব্বা বলে সম্বোধন করতাম) সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। কিন্তু অসাধারণ ছিল তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রের গড়ন। বাবাকে নিয়ে অমন ভাবনা যখন পেয়ে বসে, তখন আচমকা নিজের দিকে তাকাই। নিজের বাবার প্রতি এ আমার কোনো পক্ষপাতিত্ব নয় তো! কিন্তু না, বাবা গত হয়েছেন নয় বছর। এখনো দূরের কাছের পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা হলে সবাই তাঁর গুণ রোমন্থন করেন আর বলেন, অমন মানুষ এখন আর দেখা পাওয়া যায় না। এসব শুনে কেমন এক অহংকার পেয়ে বসে। আমার বাবা ‘সাধারণ’ এই অর্থে যে, দেশজোড়া মানুষ তাঁকে এক নামে চিনে ফেলবে না। আর দশজন ছাপোষা চাকুরের মতো সংসারের জোয়াল বয়ে বেড়ানো মানুষ। ‘অসাধারণ’ এ জন্য যে, তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ বাব। যিনি তাঁর সৎ ও সরল জীবনের আদর্শে সন্তানদের গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে অতিশয় সজ্জন ও সরল মানুষ ছিলেন তিনি। চারপাশের বিরুদ্ধ পরিবেশ যখন ক্ষণিকের জন্য নিজেকে দুর্বল করে দিতে চায়, কাজে না হলেও চিন্তায় যখন কোনো অসততা ভর করতে চায়, তখন একজন পরিপূর্ণ সৎ মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে বাবা এসে সামনে দাঁড়ান। নিজেকে তখন সতর্ক করে ফেলি।
বাবা-মায়ের নয় ছেলেমেয়ের শেষ দিকের সন্তান আমি। তাই বাবা সম্পর্কে কিছুটা দেখে আর কিছুটা শুনে বিস্মিত হয়েছি। চাকরির সীমিত আয়ে কী অসাধারণ নিষ্ঠায় ও সাধনায় সব ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বাবা নিজে ব্যাংকার হলেও তাঁর বিশ্বাস ছিল শিক্ষকতা হচ্ছে সবচেয়ে সৎ পেশা। তাই তাঁর ব্রত ছিল নিজের ছয় মেয়েকে বিয়ে দেবেন শিক্ষকের কাছে। ওরাও শিক্ষকতা করবে। তিনি তাঁর ব্রত পূরণ করেছিলেন। পরে অবশ্য একজন ছাড়া সকল ভগ্নিপতি নিজ নিজ যোগ্যতায় পেশা পরিবর্তন করেছেন।
বাবার যখন অবসর জীবন তখন আমরা কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। সারা জীবন হিসেবের সংসার চালাতে হয়েছে তাঁর। শেষ জীবনটা যাতে স্বচ্ছন্দে কাটান সে চেষ্টা করেছি আমরা। কিন্তু পারিনি। আমাদের কাছ থেকে তাঁর কোনো আর্থিক প্রত্যাশা ছিল না। জোর করলে বলতেন আমি যদি অসহায় হয়ে পড়ি, তখন সাহায্য করো। সেই সুযোগও আমরা পাইনি। পেনশনের টাকায় নিজে চলে আনন্দ পেতেন। আর তা থেকে কিছুটা জমিয়ে রাখতেন। ঈদের আগে চুপি চুপি চলে যেতেন বাজারে। বুড়ো খোকা, ছেলেবৌ আর নাতকুরদের জন্য নিজের উপার্জনের টাকায় উপহার কিনে আনন্দ পেতেন। বাবা তিরাশি বছর বয়সে মারা গেছেন। মনে পড়ে, তাঁর মৃত্যুর দুই মাস আগে একসঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে আসব। রিকশা আর খেয়ানৌকার ভাড়া মেটানো বরাবরের মতো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখন আমি পরিপূর্ণ অধ্যাপক। কিন্তু বাবার চোখে বড় হইনি একটুও। তাঁর উপস্থিতিতে একটি টাকাও খরচ করার সুযোগ ছিল না আমাদের।
বাবা কখনো জোর করে তাঁর ইচ্ছে চাপিয়ে দিতেন না আমাদের ওপর। আমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে হলেও জোর করে আসতে বলতেন না, পাছে যদি আমাদের কাজে কোনো ক্ষতি হয়।
বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা মনে করে যখন নিজের দিকে তাকাই, তখন বড় অযোগ্য মনে হয়। মনে হয় আমার বাবা মো. মোসলেম চোকদারের বিকল্প হওয়া খুব সহজ নয়।