এক স্কুলছাত্রের প্রশ্নে চিন্তায় পড়েন আবদুল কালাম!
স্বাধীনভাবে প্রকাশনা পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন সুদেষ্ণা সোম ঘোষ। যে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হয়ে তিনি কাজ করেন সেই প্রতিষ্ঠান থেকে চারটি বই বেরিয়েছে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিজ্ঞানী ড. এ পি জে আবদুল কালামের। বইগুলো প্রকাশকালে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়েছেন তিনি এই ভারতরত্নের সঙ্গে। নিজের সেই সব অভিজ্ঞতাই সুদেষ্ণা লিখেছেন এনডিটিভির পাঠকদের জন্য। গতকাল এনডিটিভির অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হয়েছে সুদেষ্ণা সোমের এই লেখাটি। এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য এটির সরল অনুবাদ করেছেন সিরাজুম মুনিরা।
ড. এ পি জে আবদুল কালাম ছিলেন একজন উর্বর (prolific) লেখক। আমি তাঁর সঙ্গে চারটি বইয়ের কাজ করেছিলাম। এবং প্রতিবারই তাঁর সম্পর্কে নতুন কিছু জেনেছিলাম। এ বছরের মে মাসে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ বৈঠক হয়। সেদিন তাঁর কার্যালয়ে পৌঁছার পর আমি দেখি অপেক্ষমাণদের জন্য নির্ধারিত কক্ষটি লোকে পরিপূর্ণ। তারপর সেখানে বসেই আমি ঠিক করে নিই যে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে কী কী ব্ষিয় নিয়ে আলোচনা করব। কিছুক্ষণ পর যখন আমি তাঁর কক্ষে প্রবেশ করলাম তখন সেখানে কোনো ভিড় ছিল না। ড. কালাম স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন। আমরা সদ্য প্রকাশিত বইটি সম্পর্কে কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। এ ছাড়া নতুন যে বইটি নিয়ে কাজ চলছিল সেটি নিয়েও কথা হলো। এরপর সেদিন কিছু স্কুলপড়ুয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কী কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে তিনি আমাকে বলতে শুরু করলেন।
ড. কালাম বললেন, ‘একজন শিক্ষার্থী আমাকে একটি প্রশ্ন করেছে এবং আমি তাকে উত্তরটি দিয়েছি সেটি নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। সে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, আমার এমন কী অবদান আছে সেটি সত্যিকার অর্থে অনন্য। আমি আসলে উত্তরটা জানি কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম না।’
এ সময় ড. কালামকে সত্যিকার অর্থেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছিল। তিনি বেশ চিন্তিতও ছিলেন। এসব দেখে আমি সত্যিই বিস্মিত হলাম। ইনি হচ্ছেন সেই মানুষ যিনি এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সঙ্গে চলাফেরা করেন এবং কথা বলেন। তিনি মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছেন। ভারতের ছোট ছোট গ্রামের মানুষদের জীবনমানের উন্নয়ন নিয়ে তিনি পরিকল্পনা করেন। দেশের বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর উদ্বেগ রয়েছে। সেখানে একজন সাধারণ স্কুলশিক্ষার্থীর প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়াটাও তাঁর কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থী ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলা ছিল তাঁর কাছে ভীষণ আনন্দের একটি কাজ। তাঁর সঙ্গে প্রতি বৈঠকেই তিনি আমাকে বলতেন যে কীভাবে তিনি অসংখ্য শিশুর সঙ্গে কথা বলেন এবং এই সংখ্যা আরো বাড়াতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। ওই সব শিশুর সঙ্গে মিশে, তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, তাদের চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাদের ডানা মেলতে শিখিয়ে, তাদের চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে আগ্রহী করার ভেতরে দারুণ আনন্দ খুঁজে পেতেন ড. কালাম। শিশুদের করা কোনো প্রশ্নই তাঁর কাছে তুচ্ছ বা কিছুটা কম গুরুত্বের ছিল না। যে দেশে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার কোনো ব্যবস্থাই নেই, সেখানে ড. কালামের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো শিক্ষার্থীদের সামনে কী ধরনের জানালা খুলে দিয়েছিল তা তো অনুমান করাই যায়।
তাঁর বক্তব্য এবং তাঁর লেখা বইয়ের কথাগুলো সব সময়ই দারুণ সব অভিজ্ঞতা দেয়। ‘মাই জার্নি’ নামে তাঁর বইটি প্রকাশ হওয়ার পর ভীষণ ভালো ভালো রিভিউ/প্রশংসা আসতে শুরু হয়। তাঁর বইয়ের প্রকাশক হিসেবে আমাদের কাছে এবং সেই সঙ্গে তাঁর কার্যালয়েও অসংখ্য চিঠি আসতে শুরু হলো। সেই সব চিঠিতে লেখা থাকত কীভাবে বইটি মানুষের আবেগকে ছুঁয়ে গেছে সেসব কথা। তবে বেঙ্গালুরুর একটি প্যাকেজিং ফার্ম থেকে আসা একটি চিঠি পেয়ে ড. কালাম ভীষণ আপ্লুত হয়ে পড়েন। ওই ফার্মের ১৮ জন নির্বাহীর সই করা ছিল চিঠিটি। সেখানে বলা হয়, ফার্মের একজন পরিচালক ড. এ পি জে আবদুল কালামের লেখার উৎসাহী পাঠক ছিলেন। ‘মাই জার্নি’ বইটি পড়ার পর তিনি এতই প্রভাবিত হন যে সে অভিজ্ঞতাটি তিনি তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চান। ফার্মটির নির্বাহীদের ওই দলটি সবাই মিলে বইটি পড়েছেন। তাদের প্রতি মাসের মিটিংয়ে সবাই মিলে বইটির একটি করে অধ্যায় পড়তেন। পুরো বইটি পড়া শেষ হলে তারা এ নিয়ে আলোচনা করেন এবং নিজেদের মধ্যে কিছু অঙ্গীকার করেন।
অঙ্গীকারটি হলো : ‘আমরা কঠোর পরিশ্রম, ইতিবাচক মনোভাব ও সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা করতে সবাই মিলে সম্মত হয়েছি। আমরা এই মর্মে উপসংহারে পৌঁছেছি যে আমরা স্রষ্টা হব, ঘটনার শিকার নয়। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আমরা আমাদের কাজে উন্নতি করার চেষ্টা করব এবং প্রতিদিন চেষ্টা করে আমাদের ভেতরের শক্তিকে বাড়াব।’
আমি কল্পনা করলাম একদল নারী-পুরুষ তাদের মাসিক বেচা-বিক্রির হিসাব আর লাভ-ক্ষতির বিষয়কে একপাশে সরিয়ে রেখে এই বইটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। বইটি নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করছে এবং এটা বিশ্বাস করছে যে এই বইটির কারণেই তারা তাদের ভেতর কিছু পরিবর্তন আনতে পারবে। এই চিঠিটিই সাক্ষ্য দেয় যে একটি বই এর লেখকের নির্যাস নিয়ে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে।
ড. কালাম বিভিন্ন বাধাকে পরিষ্কারভাবে বাতিল করে দেন। সেই সময় আমি তাঁর ‘গভর্নেন্স ফর গ্রোথ ইন ইন্ডিয়া’ শিরোনামে বইটি নিয়ে কাজ করছিলাম। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেই আমরা এটি প্রকাশ করার জন্য কাজ করছিলাম। আমি বইয়ের সব তথ্য-উপাত্ত জড়ো করেছিলাম, এগুলোকে সাজিয়েছিলাম এবং আমার পক্ষের সম্পাদনার কাজ শেষ করেছিলাম। এখন আমার তাঁর সঙ্গে বসা দরকার ছিল এবং যেসব প্রশ্নের উত্তর আর পরিবর্তন দরকার সেগুলো নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন ছিল। রাজাজি মার্গে অবস্থিত ড. কালামের কার্যালয় ও বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার অফিসের গাড়িকে ডেকেছিলাম। গাড়ির চালক ছিল একজন শিখ তরুণ। সে বেশ আড্ডাবাজ ছিল এবং অনেক কথা বলছিল। কিন্তু আমি আমার কাজ এবং সঙ্গে নেওয়া কাগজপত্র দেখায় খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই তাঁর সঙ্গে আলোচনায় ভালোভাবে যোগ দিতে পারছিলাম না। যখন আমাদের গাড়িটি ড. কালামের বাংলো ধরনের বাড়ির পেঁচানো লনে ঢুকছিল তখন চালক আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ম্যাডাম এটা কার বাড়ি?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘এ পি জে আবদুল কালামের।’
এ কথা শুনেই চালকের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে আমাকে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি শুধু একবার তাঁকে নমস্কার জানাতে চাই, এটা কি সম্ভব?’
আমি বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম না তাই তাকে বললাম যে আমি জিজ্ঞাসা করে জানাব। এরপর আমি মিটিংয়ের জন্য ভেতরে ঢুকলাম।
ড. কালাম আমার সঙ্গে বসে বইয়ের কিছু পাতার প্রুফ দেখলেন এরপর ছোটখাটো ভুলগুলো সংশোধনের জন্য তাঁর বিশ্বস্ত সচিব শেরিডনকে দায়িত্ব দিলেন। এরপর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে বাড়ির লনে চলে গেলেন। এই সময়ের মধ্যে আমি আমার কাজ গুছিয়ে এনেছিলাম। তিনি লনে হাঁটছিলেন এবং গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে ছিলেন।
চোখের কোণা দিয়ে আমি দেখলাম যে তাঁকে দেখে আমার গাড়ির চালক অভিবাদন জানাচ্ছে এবং হাসছে। আমি ড. কালামের কাছে অনুমতি চেয়ে বলি, ‘আমার সঙ্গে আসা ট্যাক্সি ড্রাইভার আপনাকে নমস্কার জানাতে চায়।’
এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ড. কালাম রাজি হয়ে গেলেন এবং নির্দ্বিধায় চালকটিকে তাঁর কাছে ডাকলেন। তিনি চালকটির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁর নাম জানতে চাইলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে চালকের পিঠও চাপড়ে দিলেন তিনি। এ সময় আমার হাতের কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তাঁদের মধ্যকার কথোপকথন পুরোটা শুনতে পাইনি আমি।
সেখান থেকে ফিরে আসার সময় পুরোটা পথ গাড়ির চালক তাঁর সৌভাগ্য প্রসঙ্গে কথা বলছিল। সে বলল, ‘তিনি নেতাসুলভ নন। তিনি আসলে আমাদের বিশ্বাস করেন, তিনি আমাদের জন্য কিছু করতে চান এবং তিনি সেটা করছেন। আপনাকে ধন্যবাদ ম্যাডাম। কারণ আপনি সেখানে গেছেন এবং আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পেরেছি। আপনার প্রতিষ্ঠান বই প্রকাশ করে তাই না? এই বইটা কখন প্রকাশ হবে?’
একজন বিখ্যাত ব্যক্তির বিষয়ে আপনি যখন এমন টাটকা প্রশংসা শোনেন তখন কী বলা উচিত?
ড. কালাম একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল এবং একজন লেখক ছিলেন যিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে নিজের ধারণা ছড়িয়ে দিতেন। বিশেষ করে তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি গুরুত্ব দিতেন। কোনো ছল-চাতুরি ছাড়াই যিনি যত্ন করতেন। ভারতের জন্য যতটুকু যত্নশীল হওয়া সম্ভব, তিনি ততটুকু ছিলেন। শুধু তাই নয়, ওই চালক ও সেই সব অসংখ্য শিশু যাদের সঙ্গে তিনি দেখা করতেন তাদের সবার জন্যই যতটুকু সম্ভব তিনি ততটুকু করতেন।
প্রতি বৈঠকের পরেই তিনি আমাকে বলতেন, ‘ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছিও।’
আর এটাই ছিল আমাকে বলা তাঁর শেষ বাক্য।
যে কাজটা করতে তিনি সবচেয়ে পছন্দ করতেন সেই তরুণদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এবং নিজের মতবাদ জানাতে জানাতেই ড. কালাম নিজের গন্তব্যে পৌঁছে গেলেন। আর সে কারণেই তাঁর জন্য আমি আনন্দিত।