বাংলাদেশের সেরা ১০টি প্রাকৃতিক ঝর্ণা
নদীমাতৃক বাংলাদেশের সেরা প্রাকৃতিক ঝর্ণাগুলো সৌন্দর্যের এক অপার মহিমা নিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকে ভ্রমণপিপাসুদের। প্রকৃতিপ্রেমীরা নিজেদের ভেতরটাকে পরিশুদ্ধ করার জন্য শরণাপন্ন হন এই স্বর্গীয় স্থানগুলোর । সারা বছর ধরে প্রতিটি মৌসুমে এই জলপ্রপাতগুলো প্রাণভরে উপভোগ করা সম্ভব। বৃষ্টি এই জায়গাগুলোকে যেন আরো যত্ন সহকারে সাজিয়ে তোলে। প্রবল বর্ষণ, জলপ্রপাত ও ঝর্ণাগুলোকে প্রাণবন্ত করে তোলে। ঠিক জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই অপূর্ব সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। আজকের ভ্রমণ পর্ব সাজানো হয়েছে তেমনি কয়েকটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা নিয়ে।
- খৈয়াছড়া ঝর্ণা
খৈয়াছড়া ঝর্ণা চট্টগ্রাম বিভাগের মিরসরাই উপজেলায় অবস্থিত। এর বিশেষ আকর্ষণ হল এর নয়টি বিচ্ছিন্ন ধাপ, যা বাংলাদেশের আর সকল জলপ্রপাত থেকে একে আলাদা করেছে। আর একই কারণে খৈয়াছড়াকে বাংলাদেশের ঝর্ণার রানী বলা হয়। ঝর্ণাটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে অবস্থিত। পূর্ব দিকে গ্রামের রাস্তা ধরে আধা ঘণ্টা হেঁটে খৈয়াছড়া জলপ্রপাতের মূল ট্রেইলে ওঠা যায়। বনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর অবশেষে দেখা মিলবে এই ঝর্ণার ।
এই ঝর্ণা দেখতে হলে ঢাকার ফকিরাপুল বা সায়েদাবাদ থেকে যেকোনো ফেনীগামী বাসে করে প্রথমে মহিপাল আসতে হবে। তারপর সেখান থেকে চট্টগ্রামগামী আধা-লোকাল বাসগুলো নামিয়ে দেবে বড়তাকিয়া বাজারে।
- আমিয়াখুম ঝর্ণা
এটি মূলত বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলায় অবস্থিত একটি অসাধারণ জলপ্রপাত। বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্তবর্তী এই দুর্গম জলপ্রপাতটিকে ডাকা হয় বাংলার স্বর্গ নামে। এই স্বর্গের দেখা পেতে হলে ঢাকার ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ বাস স্টেশন থেকে বান্দরবানগামী যেকোনো বাসে করে বান্দরবান যেতে হবে। সেখান থেকে বাস বা জিপে করে সরাসরি থানচি। তারপরই সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো একজন গাইডকে সঙ্গে নেওয়া। এই গাইড রেমাক্রি, নাফাখুম, জিনাপাড়া, থুইশাপাড়া, এবং দেবোতাপাহাড় পাড়ি দিয়ে পৌঁছে দেবে আমিয়াখুমের শিয়রে।
থানচি থেকে নৌকায় করে রোমাক্রি পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা হেটে গেলেই পেয়ে যাবেন নাফাখুম ঝর্ণা। নাফাখুম থেকে থুইসাপাড়া পর্যন্ত ৪ ঘণ্টার যাত্রাপথে জিনাপাড়ায় বিশ্রাম নেওয়া যেতে পারে। অতঃপর দেবতাপাহাড় হয়ে অমিয়াখুমের যাত্রাতে সময় লেগে যেতে পারে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা।
- হাম হাম জলপ্রপাত
এটি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। একটি শান্ত পাহাড়ের উপর প্রায় দেড়শ ফুট উচ্চতা থেকে স্রোতের চিত্তাকর্ষক দৃশ্য সমস্ত ভ্রমণকারীর মনে এক অদ্ভূত নেশা জাগিয়ে তোলে। দুর্গম পথের পরে বুনো গুল্ম দিয়ে আচ্ছাদিত উল্লম্ব ভাবে প্রবহমান এই নদীর দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না। এই বিস্ময়ের সাক্ষী হতে ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে প্রথমেই শ্রীমঙ্গল আসতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি বা জীপে করে কলাবন পাড়া যেতে হবে। কলাবন পাড়া থেকে হাম হাম যাওয়ার দুটি পথ রয়েছে- এক হচ্ছে ঝিরি পথ এবং আরেকটি পাহাড়ি পথ। একটু বেশি সময় লাগলেও পাহাড়ি পথের তুলনায় চেয়ে ঝিরি পথের সৌন্দর্য্যটা একটু বেশি। এ পথে হাম হাম পৌঁছতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।
- নাপিত্তাছড়া ট্রেইল
একই ট্রেইলে একাধিক ঝর্ণা দেখতে চাইলে চলে যেতে হবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের নাপিত্তাছড়ায়। এই একটি ট্রেইলে পাওয়া যাবে মিঠাছড়ি, বাঘবিয়ানী, এবং বান্দরখুমসহ ছোট বড় নানা ঝর্ণা। এত ঝর্ণা একসাথে থাকায় ট্রেইলটি ভ্রমণপ্রেমীদের নিকট খুবই জনপ্রিয়।
নাপিত্তাছড়ায় যেতে হলে ঢাকার ফকিরাপুল বা সায়েদাবাদ থেকে যেকোনো বাসে চড়ে চলে যেতে হবে চট্টগ্রামের মিরসরাই। ট্রেন যাত্রা পছন্দ করলে কমলাপুর থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো ট্রেনে উঠে নামতে হবে ফেনী স্টেশনে। সেখান থেকে মহিপাল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে লোকাল বাস বা লেগুনা নিয়ে সোজা মিরসরাইয়ের নদুয়ারী বাজার। এই নদুয়ারী বাজার থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে পায়ে হেটে নাপিত্তাচোরা ট্রেইলে পৌঁছানো যায়।
- শুভলং ঝর্ণা
বাংলাদেশের অপরূপ শহর রাঙ্গামাটি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে শুভলং বাজারের পাশেই দেখা পাওয়া যায় শুভলং ঝর্ণার। বর্ষাকালে প্রায় ১৪০ ফুট উঁচু পাহাড় থেকে বিপুল জলধারা আছড়ে পড়ে কাপ্তাই লেকে। ঝর্ণার কাছেই আছে প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু শুভলং বা টি-এন্ড-টি পাহাড়। এখানে বিছানো চমৎকার সিঁড়ি বেয়ে চূড়ায় পৌঁছে দেখা যাবে সেনাক্যাম্প ও টি-এন্ড -টি টাওয়ার।
শুভলং যাবার জন্য ঢাকা থেকে রাঙামাটি পৌঁছে প্রথমেই রিজার্ভ বাজার থেকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। সারাদিনের জন্যে নৌকা নিয়ে নিলে ঝর্ণার পাশাপাশি কাছাকাছি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোও ঘুরে দেখা যাবে। ঘাট থেকে শুভলং ঝর্ণা পর্যন্ত যেতে প্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
- সুপ্তধারা-সহস্রধারা
এই দুটি ঝর্ণা ঐতিহাসিক চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে বাংলাদেশের প্রথম ইকোপার্ক সীতাকুন্ড ইকোপার্কের ভিতরে অবস্থিত। ঝর্ণা দুটি দেখতে হলে ইকোপার্কের টিকেট কেটে অনেকটা ভেতরে হেটে আসতে হয়। সুপ্তধারা ঝর্ণার প্রবেশ পথে ত্রিশ মিনিট হাটতে হবে। মূল স্রোতের সামনে যেতে নেমে যেতে হবে প্রায় ৪২২টি ধাপ। এভাবে মোট দেড় ঘণ্টা হাটার পর অনেক দূর থেকে সুপ্তধারার শ্রুতিমধুর শব্দ কানে আসবে। সুপ্তধারা থেকে আরও ত্রিশ মিনিটের হাটা পথ হল সহস্রধারার সিঁড়ি। সেখানে আরো প্রায় ৪৮৭টি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে হবে। সিঁড়ির শেষেই সহস্রধারার মোহনীয় অবিরাম পতনের দৃশ্য।
ঢাকার কমলাপুর থেকে মেইল ট্রেনে বা সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল কিংবা মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে করে সীতাকুন্ড যাওয়া যায়। সীতাকুন্ড বাজার থেকে লোকাল বাস ও সিএনজিগুলো সোজা ইকোপার্কে নিয়ে যায়।
- বাকলাই জলপ্রপাত
বান্দরবানের থানচি উপজেলার নাইটিং মৌজার দারুণ একটি গ্রাম বাকলাই। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং থেকে তাজিংডং যাওয়ার পথে পড়বে এই গ্রামটি। আর এরই মধ্যমণি হলো ৩৮০ ফুট উঁচু বাকলাই জলপ্রপাত। এখন পর্যন্ত এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। গ্রামটি ট্রেকারদের ক্যাম্পিং স্পট হিসেবে সুপরিচিত। গ্রামের মধ্য দিয়ে পায়ে হেটে জলপ্রপাত পর্যন্ত পৌঁছতে মাত্র এক ঘণ্টা সময় লাগে।
এ পর্যন্ত আসতে হলে ঢাকা থেকে বাসে করে প্রথমে বান্দরবান পৌঁছাতে হবে। বান্দরবান থেকে বাস বা জীপগুলো (চান্দের গাড়ি) চার ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৭৯ কিলোমিটার দূরত্বের থানচিতে নিয়ে যায়। থানচি বাজার থেকে বাকলাই জলপ্রপাত পৌঁছাতে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। এই সময়টি একদমই বৃথা যাবে না, কেননা বাকলাই ট্রেকিং এর পথে রয়েছে দারুণ কিছু মনোমুগ্ধকর জায়গা।
- রিসাং ঝর্ণা
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার সাপমারা গ্রামের দর্শণীয় স্থানটি হলো এই ঝর্ণাটি, যাকে স্থানীয়রা সাপ মারা রিসাং ঝর্ণা বলে ডাকে। এই ঝর্ণার আরো একটি নাম আছে, আর তা হলো তেরাং তৈকালাই। খাগড়াছড়ি সদর থেকে এই ঝর্ণার দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার, যা অতিক্রম করতে প্রয়োজন হয় জীপ, মাইক্রো বা প্রাইভেট কার। অবশ্য ঝর্ণার পাদদেশে এসে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হয়। সেখান থেকে মূল স্রোত দেখতে পাহাড়ি রাস্তা ধরে কিছুটা পথ পায়ে হেটে এগিয়ে যেতে হয়।
ঢাকা থেকে সরাসরি খাগড়াছড়ি পৌঁছে প্রথম কাজ হবে চান্দের গাড়ি বা জীপ রিজার্ভ করে নেওয়া। রিসাং র্ঝণাসহ আলুটিলা গুহা, ঝুলন্ত ব্রিজ, বৌদ্ধ মন্দির, এবং দেবতা পুকুর সবগুলোই কাছাকাছি দূরত্বের। তাই গাড়ি ঠিক করার সময় এই সবগুলো জায়গার কথা বলে নেওয়া উত্তম। একসাথে সবগুলো ঘুরে দেখতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় লেগে যাবে।
- জাদিপাই জলপ্রপাত
এই প্রশস্ত ঝর্ণাটিকে বলা যেতে পারে বান্দরবানের পাহাড়ী এলাকার প্রাণ। এটি রুমা উপজেলায় অবস্থিত। কেওক্রাডং থেকে জাদিপাই জলপ্রপাত হেটে যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। প্রায় ২০০ ফুট কালো পাথরের নিচ দিয়ে প্রবাহিত পরিষ্কার পানির স্রোত গিয়ে মিশেছে সাঙ্গু নদীর সাথে। বগা লেক থেকে হেটে কেওক্রাডং-এর পরেই সাক্ষাত পাওয়া যাবে বান্দরবানের সর্বোচ্চ গ্রাম পাশিংপাড়ার। এই পাশিংপাড়াই পৌঁছে দেবে সোজা জাদিপাই ঝর্ণায়।
ঢাকা থেকে বাসে করে বান্দরবান আসার পর জীপ বা চান্দের গাড়িগুলো নিয়ে চলে যেতে হবে রুমায়। বিকাল ৪টার মধ্যে রুমা বাজারে পৌঁছাতে হবে, কেননা এর পরে সেনাবাহিনী বগা লেকের দিকে যাওয়ার অনুমতি দেয় না।
- সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা
সিলেটের জাফলং-এর এক দারুণ মন্ত্রমুগ্ধতা মিশে আছে এই সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণায়, যাকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছে মায়াবী ঝর্ণা। জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিট এগোলেই এই নামের সার্থকতা টের পাওয়া যাবে। বিএসএফের প্রহরায় বাংলাদেশিরা ভারতের সীমান্তে অবস্থিত এই মায়াবী ঝর্ণা দেখতে যেতে পারে। এই অবিরাম ধারার মোট তিনটি ধাপ রয়েছে, যার মধ্যে তৃতীয় ধাপে এমন একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে যার অন্য প্রান্ত এখন পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি।
ঢাকার গাবতলী, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ বা মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সিলেটগামী যেকোনো বাসে সিলেট আসতে সময় লাগে প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। কমলাপুর কিংবা এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটের ট্রেনে ওটা যেতে পারে। এই যাত্রাতে দুয়েক ঘণ্টা বেশি সময় লাগতে পারে। অতঃপর সিলেটের জাফলংগামী বাস বা সিএনজিগুলো নিমেষেই পৌঁছে দিবে জাফলং-এ।
বাংলাদেশের সেরা এই প্রাকৃতিক ঝর্ণাগুলো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে। সেই অর্থে এই দর্শনীয় স্থানগুলো বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মর্যাদা বহন করে চলেছে। তাই এই স্থানগুলোর সৌন্দর্য্যকে টিকিয়ে রাখা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। পাশাপাশি বিপজ্জনক স্থানগুলোতে ভ্রমণের সময় নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। পর্যটন বিভাগের পক্ষ থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে এগুলোকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পর্যটন শিল্পের ল্যান্ডমার্ক করে তোলা যেতে পারে।
সূত্র- ইউএনবি