রহস্যময় আদম পাহাড়
আদম পাহাড় অবস্থিত শ্রীলঙ্কায়। অন্যান্য পাহাড়ের মতো শুধুই পাহাড় নয় এটা, যেন রহস্যের অন্য নাম। রহস্যের কারণটা হলো এর চূড়ায় অবস্থিত বিরাট আকারের এক পায়ের ছাপ। সব গল্প বলব, দাঁড়াও আগে বলে নেই এর নামকরণের কথা। তোমরা নিশ্চয় পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর নাম জানো, তাঁর নামেই নামকরণ হয়েছিল এই পাহাড়ের। এর চূড়ায় অবস্থিত ওই পায়ের ছাপকে সব ধর্মের মানুষই পবিত্র হিসেবে মনে করে।
শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা বিশ্বাস করেন পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) প্রথম শ্রীলঙ্কায় পদার্পণ করেছিলেন। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে তাঁরই পায়ের ছাপ। তাই এ পাহাড় ও পাহাড়ের পায়ের ছাপকে মুসলমানরা পবিত্র হিসেবে গণ্য করে। অনেক বিশ্বসেরা পর্যটক এসেছেন এখানে, তবে ১৫০৫ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে এসেছিলেন পর্তুগিজ এক নাগরিক। তিনি এ পাহাড়কে বলেছেন পিকো ডি আদম। সেই থেকে পাহাড়ের নাম আদম পাহাড়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই পায়ের ছাপটি রয়েছে এখানে। তাই এ নিয়ে মানুষের জানার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। এ পাহাড়ের প্রতিটা ধুলো যেন একেকটা বিস্ময়, রহস্য। পৃথিবীর অনেক মুসলমানই বিশ্বাস করেন হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে অবতরণের সময় সর্বপ্রথম পা রাখেন শ্রীলঙ্কার এই পাহাড়ে। মুসলমানরা তাই শ্রদ্ধা করে একে আদম পাহাড় বলে ডাকে।
আদম পাহাড় শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবার কাছেই সমানভাবে শ্রদ্ধার স্থান। হিন্দুরা মনে করে চূড়ায় অবস্থিত পদচিহ্নটি শিবের পায়ের, খ্রিস্টানরা মনে করে এটা যিশুর পায়ের ছাপ, বৌদ্ধরা মনে করে এটা বুদ্ধের পায়ের ছাপ। সবার ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় জায়গাটি সবার কাছেই শ্রদ্ধার। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ওই পায়ের চিহ্নটি সত্যিই রহস্য, আকারেও বিশাল। পাহাড়ের চূড়া একটি সমতল ক্ষেত্র। সর্বপ্রথম ১৮১৬ সালে লেফটেন্যান্ট ম্যালকম এর পরিমাপ করেন। এতে দেখা যায় এর দৈর্ঘ্য ৭৪ ফুট এবং প্রস্থ মাত্র ২৪ ফুট এবং মোট আয়তন ১৭৭৬ বর্গফুট। এর চূড়ায় রয়েছে একটি বিশাল পাথরখণ্ড যার উচ্চতা আট ফুট। ওই পাথরের ওপরেই রয়েছে ওই পদচিহ্ন, যা দৈর্ঘ্যে ৬৮ ইঞ্চিএবং প্রস্থে ৩১ ইঞ্চি। এ পাহাড় নিজেও একটি বিস্ময়। পাহাড়ের চূড়ায় যেখানে পদচিহ্ন রয়েছে সেখানে পৌঁছা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তবে অনেক পর্যটকই ঝুঁকি নিয়ে সেখানে গিয়েছেন। তাঁরা নিজের চোখে ওই পায়ের ছাপ দেখে বিস্মিত হয়েছেন।
অ্যাডামস পিকে বা আদম পাহাড়ে আরোহণ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। চূড়ায় পৌঁছানোর পথটি চলে গেছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। সেই জঙ্গলে আছে বিষধর কীটপতঙ্গ। চূড়ার কাছাকাছি আছে একটি ধাতব সিঁড়ি, তাতে রয়েছে ৪০০০ ধাপ। এর প্রতিটি ধাপ নিরাপদ নয়। তার ওপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে শীর্ষে যেতে হলে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা সময় লাগে। এই সিঁড়িটি কবে, কে নির্মাণ করেছিল তারও কোনো হদিস পাওয়া যায় না। পাহাড়ের ওপরের আবহাওয়াও তেমন অনুকূল নয়। বছরে মাত্র তিন থেকে চার মাস এ পাহাড়ে আরোহণ করা যায়। বছরের অন্য সময়টাতে এতে আরোহণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ তখন পাহাড় মেঘের ভেতর লুকিয়ে যায়। চারদিক থেকে মেঘের জেঁকে আসা মেঘে অদৃশ্য হয়ে পড়ে চূড়া। পাহাড় ও পাহাড়ের রহস্যময় পদচিহ্ন নিয়ে ‘দ্য স্যাক্রেড ফুটপ্রিন্ট : এ কালচারাল হিস্ট্রি অব অ্যাডামস পিক’ নামে একটি বই রয়েছে, লিখেছেন মারকুস অকসল্যান্ড। এতে সুন্দরভাবে পাহাড়ের নানা অজানা কথা বলা আছে।
৮৫১ খ্রিস্টাব্দে এ পাহাড়ের পদচিহ্ন সর্বপ্রথম নজরে পড়ে আরবের সোলাইমানের চোখে। ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলোসহ বিশ্বের অনেক নামকরা পর্যটক এই আদম চূড়া ভ্রমণ করেছেন। ইবনে বতুতা রত্নপুরা হয়ে পবিত্র এ পাহাড়ে আরোহণ করেছিলেন। এখানে ওঠার জন্য তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন বারবেরিন থেকে। তার আগে বণিক ও ভ্রমণপিপাসু মার্কো পোলো আদমের পদচিহ্নে তাঁর সম্মান জানানোর জন্য এ পাহাড়ে আরোহণ করেন। তিনি ১২৯২ সালে চীন থেকে ভেনিস যাওয়ার পথে এ সফর করেন। অনেক ইতিহাসবিদই মনে করেন যে এই চূড়া বিখ্যাত ছিল দ্বীপের ইতিহাস লেখার অনেক অনেক আগে থেকেই। সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত অবিকল রয়ে গেছে চূড়াটি, যা সত্যি বিস্ময়ের।