টোকাই যখন সেরা ফটোগ্রাফার!
'টোকাই' শব্দটি শুনলেই নিশ্চই তোমার চোখে ভেসে উঠবে ঢাকার রাস্তায় তোমার প্রতিদিন দেখা কোনো ছোট শিশুর মুখ, যার পরনে ছেড়া কাপড়, ময়লায় ছেয়ে গেছে শরীর। কখনো ভেসে উঠবে সেই শিশুটির কথা, যে তোমার সামনে হাজির হয়েছিল ফুল কেনার বায়না নিয়ে, কিংবা দুটো টাকা। এদের দেখলেই নিগ্রহের একটা ভাব হয়তো তোমার হয়, কারণও হয় তো আছে। সেই আলাপে আমরা না যাই।
শুনে খুশি হবে একজন টোকাই বড় হয়ে বিশ্বখ্যাত ফটোগ্রাফার হয়েছে, তোমার হয়তো বিশ্বাস নাও হতে পারে। তবে হ্যা, এমনটাই হয়েছে। টোকাই থেকে ফটোগ্রাফার হওয়া মানুষটির নাম ম্যারিও ম্যাসিলু। ম্যারিও ম্যাসিলু মোজাম্বিকের মানুষ, অর্থাভাবে ছিলেন টোকাই। সময়ের পরিক্রমায় এই টোকাই আজকের দিনে হয়ে উঠেছেন একজন নন্দিত ও খ্যাতনামা ফটোগ্রাফার। এখন পর্তুগালের লিসবনে চলছে তার একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। জানা যায় ম্যাসিলুর জন্ম হয়েছিল মাপুতুর এক দরিদ্র পরিবারে। তার বাবা যখন কাজের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা চলে যায়, তখন সে কেবল সাত বছরের বালক। তার বাবার সাথে পরিবারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ম্যাসিলুর ঘরে ছিল তার মা আর বোন। এই অল্প বয়সে তাদের নিয়ে খুবই বিপাকে পড়ে ম্যাসিলু। কারণ পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে তার ওপরই সব দ্বায়িত্ব। তাই মাত্র সাত বছর বয়সেই কাজে নামতে হলো তাকে। কি কাজ আর সে করতে পারে? কখনো কারোও গাড়ি ধুয়ে দিত, আবার কখনোবা কারো বাজারের ব্যাগ বয়ে দিত। এভাবেই চলতে থাকে তার জীবন। এসব করতে করতে তার সঙ্গী জুটে যায় কয়েকজন টোকাই। তাদের কাছেই চুরি করা শেখে ম্যাসিলু। কখনো কখনো ওরা সবাই মিলে ছোটখাটো চুরি করত। সবাই একসাথে নেশাও করত। এর ফলে কোনো কোনো রাতে বাড়ি ফেরা হতো না তার। রাত কাটতো ফুটপাত কিংবা কোনো দোকানের সিঁড়িতে। পুলিশের কাছে ধরাও খেয়েছে ম্যাসিলু, পিটুনি তো ছিলই। এভাবে চুরি, নেশা, মার খাওয়া'র মধ্যেই চলতে থাকে তার দিন।
তার বয়স তখন ১৪ বছর, একদিন তার এক বন্ধু কুড়িয়ে পেল একটি ক্যামেরা। ক্যামেরা দেখে ফটো তোলার ইচ্ছে জাগে ওর। বন্ধুর কাছ থেকে ক্যামেরা ধার করে ছবি তোলা শুরু করে ম্যাসিলু। ম্যাসিলু রাস্তায় ঘুরে বেড়াত আর ফিল্ম ক্যামেরায় রাস্তার লোকদের সাদা-কালো ছবি তুলত। তখন বন্ধুর পরামর্শে বাড়িতে একটি ঘরে ডার্করুম বানায় ম্যাসিলু। কেমিক্যাল জোগাড় করে ছবি ধোয়ার কাজও শিখে ফেলে সে।
২০০৭ সালের কথা, হঠাৎ একদিন তার প্রতিবেশী এক লোক একটি নিকন ফিল্ম ক্যামেরা নিয়ে এলো বিক্রি করতে। ওই লোক ক্যামেরাটি চালাতে পারত না। ক্যামেরাটি দেখে কেনার ইচ্ছে জেগে ওঠে ম্যাসিলুর, কিন্তু হাতে কোনো টাকা-পয়সা নেই। তাতে কি? গোপনে সে তার মায়ের মোবাইল ফোনের বদলে লোকটির ক্যামেরা নিয়ে নিল। মাকে মিথ্যা বলল যে, ছিনতাইকারীরা তাকে মারধর করে ফোনটি নিয়ে গেছে। তখন ম্যাসিলুর বয়স ২৩ বছর, শুরু হলো নিজের ক্যামেরায় ফটো তোলা। তার তোলা ফটো দেখে মুগ্ধ হতে থাকে অনেকে। তাই তার বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দেয় ইন্টারনেটে কয়েকজনের সাথে যোগাযোগের জন্য। ম্যাসিলু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিভিন্ন ব্লগে ছবি প্রকাশ করা শুরু করে। দিনে দিনে তার ছবির চাহিদা বাড়তে থাকে, ডাক পেতে থাকে বিভিন্ন যৌথ প্রদর্শনীতে। এরই ধারাবাহিতায় একদিন ডাক পড়ল কানাডায়। সেই শুরু তার সাফল্যের, আর পেছনে তাকাতে হয়নি কখনো। সে সময় ম্যাসিলুর একক প্রদর্শনী শুরু হয় লিসবনে। চারদিক থেকে আসতে থাকে অভিনন্দন ও শুভকামনা। টোকাই ম্যাসিলু শহরের কোনো সেরা সন্ত্রাসী না হয়ে, হয়ে উঠে একজন সেরা ফটোগ্রাফার। ম্যাসিলুর এসব কথা আমরা জানতে পেরেছি বিবিসি থেকে।