ম্যান্ডেলার ছেলেবেলা
পৃথিবীতে এমন একটা সময় ছিল, যখন কালো ও সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যে বিভেদ ছিল প্রকট। তোমরা ধারণাও করতে পারবে না যে সাদা চামড়ার অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ মানুষরা কতটা অত্যাচার করত কৃষ্ণাঙ্গদের। তারা কৃষ্ণাঙ্গদের কোনো অধিকার দিতে চাইত না, দাস বানিয়ে রাখত। এর বিরুদ্ধে কিছু বললেও অত্যাচারের মাধ্যমে দমিয়ে রাখত। এককথায় কৃষ্ণাঙ্গরা মানুষের মর্যাদাই পেত না। এই সমস্যাটা প্রকট ছিল আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশে। এই অবস্থায় দক্ষিণ আফ্রিকার একজন মানুষ জেগে ওঠেন, সোচ্চার হয়ে ওঠেন সাদা-কালো ভেদাভেদ দূর করতে। তিনি ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। অধিকার আদায় করতে কৃষ্ণাঙ্গদের একত্র করে তিনি আন্দোলন করতে থাকেন। এর জন্য তাঁকে নির্যাতিতও হতে হয়। জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২৭ বছর কাটাতে হয় কারাগারে, দূর দ্বীপে নির্বাসনে। তাঁর অপরাধ ছিল অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা। তবে তাঁর সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি। একসময় বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয়, আন্দোলনের মুখে হটে যায় শ্বেতাঙ্গরা, মুছে যায় স্বৈরাচার, কৃষ্ণাঙ্গরা ফিরে পায় অধিকার। অসামান্য এই কৃতিত্বের জন্য পুরস্কারও পান তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার, তিনি হন তাঁর প্রেসিডেন্ট, পৃথিবীর প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পান তিনি।
নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছো কার কথা বলছি? কে এই ইতিহাসের নায়ক? সে আর কেউ নয়, নেলসন ম্যান্ডেলা। বিশ্বের বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরোধাব্যক্তি হিসেবে আমাদের মণিকোঠায় উজ্জ্বল তিনি। তোমাদের ইচ্ছে হয় না এমন একজন মহৎ ব্যক্তির ছোটবেলা সম্পর্কে জানতে? মনে প্রশ্ন জাগে না কেমন ছিল ম্যান্ডেলার ছেলেবেলা? আজ সে কথাই বলব তোমাদের। শিশু ম্যান্ডেলা সর্বপ্রথম সূর্যের আলো দেখেছিলেন ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই। তাঁর শিশুকাল ছিল বৈচিত্র্যময়। এই মহৎ লোকটি ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ নামক আত্মজীবনীতে সুন্দরভাবেই উল্লেখ করে গেছেন তাঁর শৈশবের কথা। ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ বইয়ের একটা অংশে তিনি বলেছেন, ‘সবুজ এক উপত্যকায় কুনু গ্রামের অবস্থান। তার পাশ দিয়ে বহমান স্বচ্ছ জলের ধারা। কুনুর মাথার ওপর দিয়ে তাকালে নজরে পড়বে সবুজ পাহাড়। খুব বেশি হলে কয়েকশ মানুষের বসবাস ছিল কুনুতে। ছোট্ট কুঁড়েঘরে বাস করত তারা। কুঁড়ে ঘরগুলো দূর থেকে দেখলে মৌচাকের মতো লাগত। কাদা-মাটি দিয়ে তৈরি দেয়াল। মাঝখানে কাঠের লম্বা খুঁটি। তার ওপর খড়ের পাতলা চাল। নিচ থেকে মাটি উঠিয়ে নিজেদের কলোনিতে পিঁপড়ারা যে শক্ত ঢিপি বানিয়ে রাখত, কুনু গাঁয়ের কুঁড়েঘরগুলোর মেঝে ছিল ওই উইঢিপি দিয়ে তৈরি। আর মেঝে ঝকঝকে রাখতে গোবর দিয়ে নিয়মিত লেপে নিতে হতো। এই শিশুটির মতো পৃথিবীর অনেক শিশুর অনুপ্রেরণা পেছনের ছবির এই মানুষটি ঘরের ভেতর আখা জ্বলত, খড়ের চালা দিয়ে দিব্যি বের হয়ে যেত আখার ধোঁয়া। ঘরের দরজা ছিল খুবই ছোট। মাথা নুইয়ে বাইরে বেরুতে বা ভেতরে ঢুকতে হতো। কুঁড়েঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে থাকত। গ্রামে কোনো রাস্তা ছিল না। তবে ঘাস মাড়িয়ে পায়ে হাঁটার সরু পথ ছিল। কুনু গাঁয়ের চারপাশে কিন্তু বড় কোনো গাছ ছিল না। তবে কুনুর মাথার ওপর দিয়ে তাকালে সরু লম্বা কিছু গাছ চোখে পড়ত পাহাড়ের গায়ে। খাবারের তালিকায় ছিল মেইজ, পশ্চিমারা যাকে ভুট্টা বলে। খাদ্যতালিকায় আরো ছিল মটরশুঁটি আর কুমড়া। ঐতিহ্য বলে নয়, এসব আমরা খেতাম কারণ, এর চেয়ে বেশি কিছু তৈরি করার সামর্থ্য ছিল না। আমাদের গায়ে সবচেয়ে বিত্তবান যাঁরা ছিলেন, তাঁদের খাদ্যাভ্যাসের তালিকায় যোগ ছিল বড়জোর চা, কফি আর সুগার।
তবে কুনুর বেশির ভাগ মানুষের জন্য সেসবই ছিল সাধ্যের বাইরে। রান্নাবান্না, ধোয়ামোছা আর সেচের জন্য দরকারি পানির উৎস ছিল খালবিল-ডোবানালা। এসব কাজ করতেন নারীরা। আসলে কুনু ছিল নারী ও শিশুদের গ্রাম। পুরুষরা দূরে খনিতে কাজ করতেন। বছরে বড়জোর দুবার তারা গাঁয়ে আসতেন, তাও শুধু লাঙল বাইতে। নিড়ানি, আগাছা পরিষ্কার আর ফসল কাটার দায়িত্বটা চাপত নারীদের ঘাড়ে। পড়তে বা লিখতে জানত এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। অনেকের কাছে পড়াশোনা ছিল ভিনদেশি চাল। পাঠশালা বলতে দুটো প্রাইমারি স্কুল ছিল আমাদের গাঁয়ে। আমার মা মোটে তিনটা কুঁড়েঘরের নেতৃত্ব দিতেন। পিচ্চি-পাচ্চা আর শিশুদের চিৎকার-চেঁচামেচি এখনো কানে বাজে। আফ্রিকার সংস্কৃতিতে চাচা-চাচির সন্তানরা কাজিন নয়, নিজের ভাইবোন বলে বিবেচিত।
সম্পর্কের ব্যাপারে শ্বেতাঙ্গরা যে সংস্কৃতি লালন করে, আমরা কিন্তু তেমন নই। সৎভাই বা সৎবোন বলে কিছু ছিল না আমাদের সংস্কৃতিতে। আমার চাচার ছেলে ছিল আমারই ভাই, আমার ভাইয়ের সন্তান মানেই আমার ছেলে, আমার মেয়ে। আমাদের তিনটা ঘরের মধ্যে একটা ছিল হেঁসেলঘর, একটা শোবার ঘর আর একটা গুদামঘর। শোবার ঘরে কোনো আসবাবপত্র ছিল না। আমরা মেঝের ওপর মাদুর পেতে ঘুমাতাম। বসতাম মেঝেতেই। এমনকি ঘুমানোর জন্য বালিশও ছিল না। খোলা আগুনের ওপর ত্রিপদী একটা লোহার পাত্রে রান্না করতেন মা।
আমরা যা খেতাম সবই ছিল নিজেদের চাষ করা। এর মধ্যে ভুট্টাই প্রধান। ভুট্টা থেকে মূলত রুটি বানানো হতো। এ ছাড়া গরু-ছাগলের দুধ ছিল অঢেল। এই সেই কুনু গাঁ, যেখানে ম্যান্ডেলা জন্মেছিলেন। মায়ের পিঠে ঝোলার ভেতর সেই আমি ছিলাম মানিক-রতন। ছোটবেলা থেকেই বেশির ভাগ সময় কাটাতাম খেলাধুলা করে, আমার মতো বালকদের সঙ্গে কুস্তি করে। রাতে ওদের সঙ্গেই খেতাম, একই কম্বলের নিচে ঘুমাতাম। পাঁচ বছরে হলাম পাল-বালক। পাল-বালক মানে ভেড়া আর বাছুরের পাল দেখাশোনা করা। শিখলাম গুলতি দিয়ে কী করে উড়ন্ত পাখি মারতে হয়। শিখলাম বন্য মধু আর ফল সংগ্রহ করা আর সরাসরি গরুর দুধ দুইয়ে গরম গরম পান করা। শিখলাম বিলে সাঁতার কাটা আর বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে। প্রেমে পড়লাম খোলা হাওয়া আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের। আবিষ্কার করলাম জোঝা (যে অঞ্চলে ছিল কুনু গাঁ) আসলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ, সুখের স্বর্গ।’
এই লেখা থেকেই মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায় তার শৈশব সম্পর্কে। কে জানত যে এই ছেলেটিই হয়ে উঠবে আমাদের চেনা ইতিহাসের নায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা!