বর্ণিল আয়োজনে ‘মার্সেল হা-শো’ গ্র্যান্ড ফিনাল, শেষ হাসি হাসলেন চট্টগ্রামের রিয়াজ

ঢাকার এনটিভির তেজগাঁও স্টুডিও আজ এক ভিন্ন রূপে সেজেছে। আলোক-বর্ণিল এক মঞ্চ, যেখানে ঝলমলে রঙে জ্বলছে প্রতীক্ষার আলো। মাথার ওপর দপদপ করছে স্টেজ লাইট, আর চারপাশে দর্শকসারিতে জমেছে এক অন্যরকম উত্তেজনা—হাসির।
আজ বৃহস্পতিবার (২৯ মে) সেই বহুল প্রতীক্ষিত সন্ধ্যা। ‘মার্সেল হা-শো’ সিজন–৭ এর গ্র্যান্ড ফিনাল। এই মঞ্চে হাসবে দেশ, হাসবে ভবিষ্যতের স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান তারকারা।
প্রতিযোগী, বিচারক, দর্শক—সকলেই যেন নিঃশ্বাস ধরে অপেক্ষা করছিলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, যখন আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে শুরু হবে হাসির ঝড়। চারদিক কাঁপিয়ে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠছে, আলোয় ভাসছে মুখগুলো। মঞ্চের এক পাশে গম্ভীর-চোখে বিচারকের আসনে বসে আছেন চিত্রনায়ক আমিন খান, তুষার খান আর শবনম ফারিয়া—তাঁরা যেন খুঁজে ফিরছেন আগামী দিনের হাসির রাজপুত্র বা রাজকন্যাকে।
আর এই বিশেষ রাতকে আরও জ্বলজ্বলে করে তুলেছেন দুই অতিথি বিচারক ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় দুই চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস ও পূজা চেরি। তাঁদের উপস্থিতিতে গ্রান্ড ফিনালের মঞ্চ যেন হয়ে উঠেছে আরও মোহনীয়, আরও উজ্জ্বল। হাসির সুরে, তারকাদের চোখে, আর দর্শকের হৃদয়ে—জমে উঠেছে এক অপূর্ব অপেক্ষার বিস্তার।
টেলিভিশন রাউন্ডে দেশের সাত বিভাগীয় শহর থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল ৪৫ জন হাসির যোদ্ধা। সেই লড়াই শেষে আজ ছয় ‘হাসির নক্ষত্র’ বাকি—গ্র্যান্ড ফিনালের ঝলমলে মঞ্চে তারা উড়াবে কৌতুকের ডানা, আর তাদের হাসি জ্বালাবে দীপ্তিময় নক্ষত্রপুঞ্জ!

মীরাক্কেল তারকা উপস্থাপক আবু হেনা রনি মঞ্চে উঠেলেন আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল এই সিজনের গ্র্যান্ড ফিনাল। পরিচয় করালেন বিচারকদের সঙ্গে। সাত প্রতিযোগী একে একে মঞ্চে এসে শোনাচ্ছেন তাঁদের সেরা জোকস। কেউ গল্পের মিষ্টি রস নিয়ে হাসির রেশ ছড়লেন, কেউ বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় সব সংলাপ ও অদ্ভুত দৃশ্য মনে করিয়ে দিয়ে, কেউ গ্রাম-নগরের ব্যঙ্গ দিয়ে দর্শকদের হাসালেন। সাত প্রতিযোগী যখন পুরো মনোযোগ দিয়ে তাদের জোকস উপস্থাপন করছিল; উত্তেজনা এত, শ্বাস ওঠা–নামা কঠিন। একের পর এক পারফরম্যান্সের ফাঁকে মঞ্চে নেচে এলেন পূজা চেরি ও পারসা ইভানা আর পরে কনা আর কর্ণিয়ার মাইকে গাওয়া সুমধুর গান ভরিয়ে দিল মন প্রাণ। এভাবেই জমে উঠল গ্র্যান্ড ফিনালের রাত।
চ্যাম্পিয়ান রিয়াজ উদ্দিন
চুপচাপ নিঃশব্দে কেটে গেল ছোট্ট একটা বিরতি, যেন ঝড়ের আগে শান্ত কিছু মুহূর্ত। স্টুডিওর বাতাসে তখন লেগে ছিল অদ্ভুত এক চাপা উত্তেজনা। আলো নিভে যায়, আবার জ্বলে ওঠে। প্রতীক্ষার সেই মুহূর্তে কারও ঠোঁটে কম্পন, কারও চোখে বিশ্বাস আর কান ধরে রেখেছে দর্শকদের কৌতূহল।
তারপর এল সেই প্রথম ধাক্কা তৃতীয় স্থান। আবেগে টলমল চোখ, কিন্তু মুখে প্রশান্ত এক হাসি। মোহাম্মদপুরের মেহেদী হাসান তরু, ব্যঙ্গের ভাষায় জীবনকে ছুঁয়ে যিনি হাসিয়েছেন দর্শককে, এবার পেলেন দুই লাখ টাকার স্বীকৃতি। এক মুহূর্তের নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘এই ভালোবাসার জোরেই তো এগিয়ে যাওয়া।’
এরপর দ্বিতীয় নাম আদিব হাসান নিরব, সোনাইমুড়ির ছেলে, তিন লাখ টাকার আলোয় দাঁড়ালেন নির্ভার কণ্ঠে। বললেন, ‘এটুকু পথই তো সারা জীবনের অনুপ্রেরণা—হাসির আলো আরও ছড়িয়ে দিতে চাই।’
শেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। চারপাশ থমকে গেল। ঘোষণা হল চ্যাম্পিয়নের নাম মো. রিয়াজ উদ্দিন, মিরসরাই, চট্টগ্রাম। পাঁচ লাখ টাকার পুরস্কার হাতে যখন তিনি মঞ্চে উঠলেন, তখন তাঁর চোখে ছিল জল, আর ঠোঁটে বাক্য ‘আমার হারানো স্বপ্ন আজ ধরা দিল।’

তিন বিজয়ীকে এই পুরস্কার তুলে দেন এনটিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশফাক উদ্দিন আহমেদ ও মার্সেলের সিএমও গালিব বিন মোহাম্মাদসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা।
এই ছিল সেই মুহূর্ত, যেটা কেবল পুরস্কারজয় নয়, এক জীবনের হাসিমাখা প্রতিশ্রুতি। তবে এই গল্প শুধু এই তিনজনের নয়। আরও চারটি নাম জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছিল ফাইনালের আকাশে ইমন চৌধুরী (মৌলভীবাজার), আল-আমিন নিরব (কচুয়া, চাঁদপুর), সুশান্ত দে (চট্টগ্রাম) আর জাহিদুল ইসলাম হৃদয় (শাহরাস্তি, চাঁদপুর); তাঁরা চারজন পেয়েছেন মার্সেল রেফ্রিজারেটর ও মার্সেল ওশিং মেশিনসহ অন্য পুরস্কার। তাঁদের পুরস্কার ছিল ভালোবাসার ঠাণ্ডা ছোঁয়া আর হাসির মর্যাদা।
সাতজনের এই দল যেন সাত রঙের দীপ্ত রত্ন। তাঁদের কণ্ঠে ছিল হাসির ভাষা, আর হৃদয়ে ছিল সাহস। এই ছিল ‘মার্সেল হা-শো সিজন ৭’ শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, হাসিকে ভালোবেসে গড়ে তোলা এক বিজয়-নাটক।
এ নাটকের পর্দা নামল, কিন্তু চরিত্রগুলো রয়ে গেল আমাদের বুকের গভীরে, আর ভবিষ্যতের অসংখ্য মঞ্চে।
ছিলেন ৭ মেন্টর, তারাও পেয়েছে পুরস্কার
প্রতিযোগীদের পাশাপাশি এবার সম্মানিত করা হয়েছে শোয়ের পেছনে ছায়ার মতো কাজ করা সাত জন মেন্টরকেও।তাঁরা হলেন সাইফুর রহমান সাইফুর, শাওন মজুমদার, শাহাজাদা শাহেদ, ইসতিয়াক নাসের, মোহাম্মদ পরশ তারেক মাহমুদ ও হৃদয় আল মিরু। যারা কেবল প্রতিযোগীদের হাসানোর কৌশল শেখাননি, বরং তাদের গড়ে তুলেছেন আত্মবিশ্বাস ও পরিশ্রমে—তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে আয়োজকরা তুলে দিয়েছেন বিশেষ পুরস্কার মার্সেল ওভেন।

সাত মেন্টের হাতে পুরস্কার তুলে দেন এনটিভি অনলাইনের সম্পাদক খন্দকার ফকরউদ্দীন আহমেদ, মার্সেলের ডিসিএমও জোহেন আহমেদ ও ব্যান্ড ম্যানেজার উদ্দাম হোসেন।
এই সম্মাননা প্রমাণ করে, ‘হা-শো’ কেবল প্রতিযোগিতার মঞ্চ নয়, এটি একটি সম্মিলিত শিল্পযাত্রা—যেখানে পর্দার আড়ালের মানুষরাও আলোর ভাগ পায়।
আনন্দিত আয়োজকরা
আলো-আবেগ-উল্লাসের ফিনালের ঠিক মাঝখানে, যখন পুরস্কারের ঝলকে ঝিকিমিকি করছিল স্টেজ—তখনই সামনে এলেন এই আয়োজনের নেপথ্যের নায়করা। শুধু মঞ্চেই নয়, পর্দার আড়ালেও দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেক মানুষের পরিশ্রম আর ভালোবাসা। এনটিভি ও মার্সেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন পুরস্কার বিতরণী পর্বে। মুখে ছিল আনন্দ, চোখে গর্ব।
এনটিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশফাক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হা-শো আয়োজনের পেছনে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল একটাই—এই যান্ত্রিক জীবনে মানুষের মুখে একটু হাসি ফোটানো। আমরা বিশ্বাস করি, যদি সেই হাসি এনে দিতে পারি, তাহলেই এই আয়োজন সার্থক।এবারের সিজনে যারা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের সবার সঙ্গে এই শোয়ের এক গভীর আবেগ ও অনুভব জড়িয়ে গেছে। তাঁদের হাসি-কান্না, লড়াই আর ভালোবাসায় গড়ে উঠেছে হা-শো সিজন-৭। সারা দেশ থেকে আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি, যা আমাদের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এনটিভি এবং মার্সেল পরিবার এই অসাধারণ যাত্রার অংশ হতে পেরে সত্যিই গর্বিত।’
স্পনসর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মার্সেলের সিএমও গালিব বিন মোহাম্মাদ বলেন, ‘মার্সেল শুধু পণ্য তৈরি করে না—আমরা বিশ্বাস করি, দেশের শিল্প ও সংস্কৃতিতেও আমাদের দায় আছে। সেই বিশ্বাস থেকেই ‘হা-শো’র সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এই শো আমাদের সেই স্বপ্নেরই অংশ, যেখানে বাংলাদেশি কমেডি নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। আমরা এমন একটি রিয়েলিটি শো বানাতে চেয়েছি, যেটা এর আগে কেউ করেনি। অনেকদিন আমরা কেবল বিদেশি কমেডি শো-র উপরই নির্ভর করতাম। একসময় ভাবলাম—যদি অন্য দেশ পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না? সেখান থেকেই শুরু। ধীরে ধীরে হেঁটে আজ আমরা পৌঁছে গেছি সপ্তম সিজনে। এই দীর্ঘ পথচলায় এনটিভিকে আমাদের পাশে পেয়ে আমরা কৃতজ্ঞ। তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন মার্সেলের ডিসিএমও জোহেন আহমেদ, ব্যান্ড ম্যানেজার উদ্দাম হোসেন, হেড অব মিডিয়া মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মো. শাহজালাল হোসেন লিমন, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, মো. তাহাসিনুল হক। এনটিভির পক্ষে ছিলেন হেড অব সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং অঞ্জন কুমার কুণ্ডু, অনলাইনের সম্পাদক খন্দকার ফকরউদ্দীন আহমেদ, অনুষ্ঠান বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আলফ্রেড খোকন এবং এজিএম সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং গৌতম দাস ।
দুই পরিচালকরা যা বলছেন
‘মার্সেল হা-শো’ সিজন–৭ পরিচালনা করেছেন জাহাঙ্গীর চৌধুরী ও কাজী মোহাম্মদ মোস্তফা। এবারের সিজন নিয়ে জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, ‘হাসি মানেই হালকাভাবে নেওয়া—এই ধারণাটা আমরা ভাঙতে চেয়েছি। হা-শো সিজন-৭ ছিল আমাদের সবচেয়ে সাহসী ভ্রমণ। প্রতি পর্বে শুধু প্রতিযোগিতাই নয়, উঠে এসেছে জীবন, সম্পর্ক, সমাজ আর হাজারো না বলা গল্প। আমি জানি এই পথটা সহজ ছিল না। কিন্তু প্রতিটা হাসির ভেতর লুকিয়ে ছিল যত্ন, পরিশ্রম আর ভালোবাসা। দর্শকের হাসিমাখা প্রতিক্রিয়াই আমাদের আসল পুরস্কার। আর এই যাত্রায় আমার সহযোদ্ধা মোস্তফা ভাইকে না বললে চলবে না—তিনি ছিলেন হৃদয়ের মতো পাশে। এই হা-শো আমাদের নয়, এদেশের প্রতিটা মানুষের।’
কাজী মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, ‘হা-শো সিজন-৭ আমার কাছে শুধু একটি প্রজেক্ট ছিল না, এটা ছিল ভালোবাসার একটি সংগ্রাম। এই প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আমরা চেয়েছি সত্যিকারের প্রতিভাকে উঠে আসতে দিতে। হাসির আড়ালে যে কষ্ট, যে লড়াই, সে জায়গাগুলো তুলে ধরাই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য।

যে মুহূর্তগুলোতে প্রতিযোগীরা কাঁদছিল, আবার পরক্ষণেই পুরো মঞ্চে হাসির ঝড় উঠছিল—সেই বৈপরীত্যই এই অনুষ্ঠানের প্রাণ। এই পুরো সফরে আমার সহ-পরিচালক জাহিদ ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের দুজনের বিশ্বাস, আগামী দিনের শিল্পীরা এই মঞ্চ থেকে পথ চলার সাহস পাবে।’
এবারের সিজন নিয়ে এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আলফ্রেড খোকন বলেন, হা-শো এখন ব্রান্ড; আমাদের এই শো বাংলাদেশে অদ্বিতীয়; এই রিয়েলিটি শোকে বিট করার মত কেউ এখন নেই। আমাদের দেশের ছেলে মেয়েদের সেন্স অব হিউমার সেকারণে স্ট্যান্ড আপ কমেডিতে তাঁরা দারুণ সফলতা পাচ্ছে। এই সিজনে আমরা দারুণ সাড়া পেয়েছি, আশা করছি আগামী সিজনে আমরা এই সিজনকেও ছাড়িয়ে যাব, যেমনটা প্রতিবার হয়।