সাক্ষাৎকার
গর্তে মাথা ঢুকিয়ে গান চর্চা করতাম : খুরশিদ আলম
বয়স তখন ছয় কি সাত। রেডিওতে গান শুনে ভালো লাগা থেকে আগ্রহ হলো গান করার। দাদা চেয়েছিলেন পড়ালেখা করে সরকারি কোনো চাকরি করুক নাতি। শিল্পী নিজেও চাইতেন আর্মিতে চাকরি করতে। কিন্তু উঠতি বয়সে গানের পোকা শিল্পীহৃদয়কে নাড়া দিল। পরিবারের অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও তাই শুরু হলো গান শেখা। এ পর্যন্ত প্রায় ৪২৫ =টি ছবিতে গেয়েছেন গান। গড়ে প্রতিটি ছবিতে পাঁচটি করে গান হলেও প্রায় দুই হাজারের বেশি গান তিনি আমাদের সংগীতাঙ্গনে উপহার দিয়েছেন। বর্তমান জেনারেশনের শিল্পীদের নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন ভালো কিছুর। এখনো গান করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের গুণী জনপ্রিয় প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এখনো গেয়ে যাচ্ছেন গান। বর্তমানে যাঁরা গান করছেন, তাঁদের মাধ্যমে দেখে যেতে চান আরো ভালো কিছু।
প্রশ্ন : গান শেখার শুরুটা হলো কীভাবে। আপনার বেড়ে ওঠা নিয়ে কিছু বলুন।
খুরশিদ আলম : আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। আজিমপুরে ওয়েস্ট ইন্ড হাই স্কুলে। আমার দাদা এই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে ওঠার সময় আমি দাদিকে বললাম, আমি আর এখানে পড়ব না। কারণ দাদা অনেক মারে। দাদি আমার কথায় সায় দিলেন। আমি যেহেতু ছোট থেকে দাদির কাছেই মানুষ হয়েছি, তাই আমার জীবনে দাদির প্রাধান্য বেশি ছিল। এরপর ক্লাস সিক্সে গিয়ে ভর্তি হলাম নবাবপুর সরকারি হাই স্কুলে। ওখান থেকেই আমি মেট্রিক পাস করি। এই স্কুলে পড়ার সময় আমি টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের অপর পাশে একটা ননবেঙ্গলির পান দোকান ছিল। টিফিন পিরিয়ডে সবাই টিফিন খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকত আর আমি ওই আধা ঘণ্টা পান দোকানে গান শুনতে যেতাম। দোকানদারও একদম নিশ্চিত থাকতেন যে আমি গান শুনতে যাব। রেডিও সিওন শুনতাম। এই শোনাটাই আমার অনেক বড় একটা শিক্ষা দিয়েছে। বীণাকায়, গীতমালায় ভারতীয় সব শিল্পীদের গান হতো। আমি প্রত্যেকের গানই শুনতাম। এই গানগুলো শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা করে ফেলেছিলাম। আমার স্কুলের বন্ধুরা আমার গান গাওয়াটাকে খুব সাপোর্ট করত। এরপর গান শেখা শুরু করলাম। স্কুলের হেড মাস্টার আবুল ফজল সাহেব এবং আমার চাচার একান্ত অনুগ্রহে আমার সংগীত শিক্ষা শুরু হলো।
ওই স্কুলের শিক্ষক শেখ আবুল ফজল সাহেব এবং আমার চাচা ড. আবু হায়দার সাজেদুর রহমান, ডাক নাম মাস্টানা। ওনারা সবাই মিলে মেডিকেলে একটা সংগঠন করেছিল ঢাকা শিল্পী সংঘ নামে। সেখানে আমি রবীন্দ্রসংগীত শেখা শুরু করি। আমরা যে বাসায় ছিলাম তার সাথেই মসজিদ ছিল। সে সময় গান বাজনা করা হারাম। কিন্তু পুরান ঢাকার বাসাগুলো একটু লম্বা ও চওড়া টাইপের হয়। আমি দেখলাম বাসার ভেতরে একটা জায়গা আছে। একটা গম্ভুজের মতো তাতে একটু গর্ত করা। আমার মাথাটা এই গর্তে ঢুকে যায়। যত চিৎকার করি না কেন আওয়াজ বাইরে যায় না। আমি এই গর্তে মাথা ঢুকিয়ে গান চর্চা করতাম। রোজ ৭টার পর। যত ধরনের গান আছে গাইতাম। এটা একটা হিন্দুদের বাড়ি ছিল। ওই জায়গাটি প্রদীপ দেওয়ার ঘর ছিল। এটা না দেখলে বোঝানো যাবে না যে কেমন। ১৯৬২-এর দিকে এখন যেটা জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ বলা হয়, তখন সেটা ইস্ট পাকিস্তান এডুকেশন উইক নামে ছিল। আমি পর পর দুই বছর ’৬২, ’৬৩ সালে আধুনিক এবং রবীন্দ্রসংগীতে নাম দেই। দুবারই প্রথম হই। এই প্রতিযোগিতার কারণে সবাই আমার ব্যাপারে জেনে গেল। এরপর আমার চাচা বললেন যে এবার তুই গান শেখা শুরু কর। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাইতাম যে আমি আর্মিতে যাব। আর আমার দাদা চাইতেন পড়ালেখা শেষ করে আমি সরকারি চাকরিতে যোগদান করব। কিন্তু আমার চাচা বললেন যে, ওকে দিয়ে দেখি যদি না হয় তো লাগাম তো আমার হাতেই আছে। শেখা শুরু হলো। এরপর আমি ১৯৬৪ সালে মেট্রিক পাস করে বের হলাম। তখন রবীন্দ্রসংগীতই বেশি করতাম।
প্রশ্ন : কবে থেকে আধুনিক গান গাওয়া শুরু করলেন?
খুরশিদ আলম : আসলে স্কুলে সেই যে ননবেঙ্গলির পানের দোকানে রেডিওতে গান শুনতাম, তখন প্রায় সব গানই আমার মুখস্থ ছিল। এ সময় সবাই মোটামুটি জানত যে আমি ভালো গান গাই। ’৬৫ সালের দিকে আইয়ুব খান রবীন্দ্রসংগীত বেন করে দিল। একদিন জব্বার ভাই বলল, চলো একটা অনুষ্ঠান আছে গান করবে। জব্বার ভাই বলছে দ্যাট ইজ এনাফ, কত টাকা দেবে তার দরকার নাই। পরের দিন জব্বার ভাইয়ের সাথে টাঙ্গাইলের করটিয়ায় গান করতে গেলাম। প্রায় ১০ হাজার মানুষ। সাবিনা ইয়াসমিনও আসছে। আমি জাস্ট একটা শার্ট আর প্যান্ট পরা। কোনো ডায়েরি নাই। সব গান তো মেমোরিতে আছেই। এই অনুষ্ঠানটায় বাংলা-হিন্দি গান করলাম। পরের দিন মর্নিং নিউজে একটা খবর বের হলো যে, এই ছেলেটা একদিন বাংলাদেশের নামকরা গায়ক হবে। জব্বার ভাই আমাকে ১০ টাকা ধরায় দিলো। আমি তো মহাখুশি। তখনকার দিনে ১০ টাকা অনেক টাকা। বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করে ১০ টাকা খেয়ে ফেললাম। ওপেন এয়ারে এটা আমার জীবনে প্রথম অনুষ্ঠান ছিল। এই শুরু হলো আমার আধুনিক গান করা।
প্রশ্ন : বাংলা ফিল্মে তো আপনার অসংখ্য জনপ্রিয় গান আছে। এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসার সুযোগটা কীভাবে হলো।
খুরশিদ আলম : আমি ’৬৫ সালে সেগুনবাগিচায় কলেজ অব মিউজিকে ভর্তি হই। যেটা বারীণ মজুমদার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ’৬৭-তে ইন্টারমেডিয়েট পাস করলাম এই কলেজ থেকে। তারপর জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করেছি। ’৬৬ সালে আমি বাংলাদেশ রেডিওতে অডিশন দিলাম। বাংলাদেশ বেতারে আমি তালিকাভুক্ত হলাম ৭৭ নম্বর শিল্পী হিসেবে। যদিও ছোট থেকেই রেডিওতে ছোটদের অনেক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি। এই অডিশন দিতে গিয়েই সমর দাশের সাথে আমার পরিচয় হয়। উনি আমাকে গান শিখতে ওনার বাসায় যেতে বললেন রোজ সকাল ৭টায়। ছয় মাস সমর দাশ আমাকে গান শেখালেন। এই ছয় মাসই আমার শিল্পী জীবনের বিরাট পরিবর্তন এনে দিল।
এ সময় ’৬৭ সালে আমার চাচার মাধ্যমে আজাদ রহমান সাহেবের সাথে আমার পরিচয় হলো। উনি সবে ইন্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে আসছেন। আমার জন্য আজাদ সাহেব দুটো গান করলেন। তোমার দুই হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম থাকব তোমারি আমি কথা দিলাম (গীতিকার-কবি সিরাজুল ইসলাম, সুরকার - আজাদ রহমান সাহেব) আর একটি গান হলো- চঞ্চল দু’ নয়নে বল না কি গানটি (এটার কথা জেবুন্নেসা জামান, সুর আজাদ রহমান সাহেব)। এই দুটো গান হলো দুই মেরুর। তখন খুব ফাটাফাটি অবস্থা। অলওভার পাকিস্তানে তোমার দু’ হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম গানটি সেভেন স্টেন্ট করল। এইচ এমভি সেলে। চঞ্চল দু’ নয়নে তো ইয়াং জেনারেশনের মাথা খারাপ করা গান হয়ে উঠল। এই জনপ্রিয়তার রেশ থেকেই আমি ’৬৯ সালে বাংলা ছবিতে গান করলাম। ছবির নাম আগন্তুক। বন্দী পাখির মতো মনটা কাঁদে। এ গানের মাধ্যমে আমার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে সম্পৃক্ততা শুরু হলো। দ্বিতীয় ছবি আমার ‘পিচঢালা পথ’, সুরকার রবীন ঘোষ, গীতিকার আহমেদ জামান চৌধুরী, তৃতীয় ছবি ‘সাধারণ মেয়ে’, সুরকার প্রয়াত সত্য সাহা, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার সাহেব, গানের কথা- ডিম ডিম ডিম মারো গানটি।
প্রশ্ন : গানের রেকর্ডিং নিয়ে কোনো ঘটনা বা স্মৃতি কি আছে যেটি এখনো মনে হয় আপনার।
খুরশিদ আলম : মনে পড়ে ‘একমুঠো ভাত’ ছবির মহরত অনুষ্ঠানের কথা। এখন যেমন কোনো ছবির মহরতে গ্লামারাস কোনো মেয়ে বা মডেলকে নিয়ে দু-একজন ছেলে আর্টিস্ট উপস্থিত রেখে হার্ডলি ২৫ জন মানুষের উপস্থিতিতে একটা ছবির মহরত অনুষ্ঠান হয়। আগে কিন্তু বিয়েতে দাওয়াত দেওয়ার মতো দীর্ঘ সময় কার্ড বিলি করে ৫০০ মানুষের উপস্থিতির আয়োজন করা হতো। তারপর ছবির মহরত অনুষ্ঠান হতো। ‘একমুঠো ভাত’ ছবির মহরতের দিন, আমার দাদি অনেক অসুস্থ। ডাক্তার বলছে দাদিকে ওনার পরিচিত মানুষজনের কাছে রেখে আসতে। তাহলে হয়তো উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমি দাদিকে আমাদের গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ছবির পরিচালক মিজান সাহেবকে বললাম আমি সন্ধ্যা ৭টার আগেই চলে আসব। যদিও মিজান সাহেব বললেন, অনুষ্ঠানটা ক্যান্সেল করে দিই। কিন্তু আমি বললাম, দেখেন ফিল্মে একটা কথা আছে যদি প্রথম কোনো ফিল্মে কোনো নায়িকা সে যত সুন্দরী এবং ভালো অভিনেত্রীই হোক না কেন ফ্লপ করলে পরবর্তীতে যত ভালো কাজই করুক না কেন তা আর জনপ্রিয়তা পায় না। তো আমি যে করেই হোক সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে পৌঁছাব। আমি ঠিক সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিট আগে উসকো-খুসকো চুলে কাকরাইলে স্টুডিতে হাজির। মিজান সাহেব আমার অবস্থা দেখে বললেন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতে। কারণ তখনো অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। আমি তখন পল্টনে থাকতাম। ফ্রেশ হয়ে এসে ‘শোন ভাইয়েরা কথা শোন, এমন একজন মানুষ যে পাপ না করেছো’ গানটির রেকর্ড হলো। গানটি হিট করেছিল। তো কমিটমেন্টটা হলো অনেক বড় ব্যাপার। আমি কথা দিলাম, সেটা রাখতে পারছি। কিছুদিন আগে চলচিত্রের ৫০ বছর পূর্তি হলো সেখানে অনেকেই বলছে খুরশিদ ভাই কি গান করছে সেটার চেয়েও বড় হলো উনি যে কমিটমেন্ট করছে সেটা শতভাগ পূর্ণ করছে। তখন গানগুলো লাইভ রেকর্ডিং হতো। এই যেমন কোনো একটা গান রেকর্ডিং চলছে হঠাৎ মিউজিশিয়ানদের মধ্যে কেউ ভুল করল বা শিল্পী গানের মাঝে কোনো ভুল করল তো তখন সেই গানটা আবার শুরু থেকে করতে হতো। আমার একটা গান, ছবিটার কথা আমার মনে নাই। সাবিনা ইয়াসমিন ও আমি কণ্ঠ দিচ্ছিলাম। রাত ১২টা বেজে গেছে। দুজনেরই জিহ্বা প্রায় মুখের বাইরে। গানের কথাগুলো এ রকম দিনা এসো না হা হা হা, এই ধরনের। এই ধরনের হাসকি কাজ দেওয়াটা খুব কঠিন। যা হোক কণ্ঠ দেওয়া শেষ। রেকর্ডিংটা ঠিকঠাকমতো হলো, আমরা সবাই ভাবছি। এমন সময় সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার বলল গানের মাঝে সাবিনা ইয়াসমিনের ওড়নাটা নিচে পড়ে গেছিল। ওড়নাটা ওঠানোর সময় যেহেতু মাইক্রোফোন একটা সেই শব্দটা ধরা পড়ছে। এখন আবার রেকর্ডিং করতে হবে। এরপর কী আর করা। আবার রেকর্ডিং শুরু হলো।
রাত ৩টা বাজল শেষ হতে। কিছু বিষয় আমার ভালো লাগে, ‘মা গো মা ওগো মা’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু মা নিয়ে আমি প্রায় ৫০টি গান করেছি। এটা ভাবতে আমার ভালো লাগে। আর আমাদের সময় গানের রেকর্ডিং হতো রাত ৮টার পরে। এ সময় কোনো প্লেন চেক ইন বা আউট হতো না। ফলে সে সাউন্ডটা ডিস্টার্ব করত না। যেহেতু তখন গানগুলো এফডিসির খোলা রুমে, রেকর্ডিংগুলো শেষ হতে হতে রাত তিনটে-চারটে বেজে যেত।
প্রশ্ন : বিভিন্ন শিল্পীর সাথে প্রথম গাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল। বিশেষ কোনো স্মৃতি কি আছে?
খুরশিদ আলম : রুনা লায়লা সম্ভবত ’৭৪ সালে বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে আমি তৃতীয় শিল্পী হিসেবে রুনা লায়লার সাথে একটি গান করলাম। ‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার ঠিক যেন নাটরের বনলতা সেন’ এটা আমার জীবনে রুনা লায়লার সাথে গাওয়া প্রথম গান। সে সময় রুনা লায়লা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ব্যাপক জনপ্রিয় গুণী শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। তো সে সময় আমি তার সাথে এই গানটি গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। সেই হিসেবে এটি আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর এটি আমার জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনাও বটে। রুনা লায়লার সাথে গান করতে একটু অসুবিধা হয় যে সে এত গুণী এবং বড় মাপের ওস্তাদের সান্নিধ্যে ছিল যে সে অ-নে-ক জানে। আর সেই সময় রুনা লায়লা একজন বাঙালি কণ্ঠশিল্পী হয়েও পাকিস্তানের মতো জায়গায় নুরজাহানের মতো শিল্পীকে লাথি মেরে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। এটা চাট্টিখানি ব্যাপার না। আর মাত্র ১৪ বছর বয়সে রুনা লায়লা গানেরই ‘খাতায় স্বরলিপি লিখে’ গানটি করে বাংলাদেশেও অনেক পরিচিতি লাভ করে ফেলে। এসবের কারণে গানটি রেকর্ডিংয়ের সময় আমি বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং একটা নার্ভাসনেস কাজ করেছিল। কিন্তু রুনা লায়লা বুঝতেই দিল না যে সে এত বড় মাপের একজন শিল্পী। সে আমাকে সহযোগিতা করল। গানটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এরপর বহু গান রুনা লায়লার সাথে আমার করা হয়েছে। এবং সব গানই জনপ্রিয় হয়েছিল। রুনা লায়লা হলো একজন ডেঞ্জারাস শিল্পী।
সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে আমার প্রথম কাজ ‘মাস্তান’ ছবিতে। গানের কথা তোমার ঐ বুকে থাকব না আমি, নানা কাটা আছে গানটি। ফেরদৌসী আপার সাথে ফিল্মে আমার গান করার সুযোগ হয়নি। সে জন্য একটা অপূর্ণতা এখনো কাজ করে। যদিও ফেরদৌসী রহমান আপার সাথে রেডিওর জন্য ছয়টি গান গেয়েছিলাম। শাহনাজ রহমাতুল্লাহর সাথে প্রথম গান গাইলাম সম্ভবত ‘আপনজন’ ছবিতে। গানটি হলো সালামুআলাইকুম কেন এত দেরি হলো, ওয়ালাইকুম সালাম এখন কোথায় যাবে বলো। আর একটা গান করলাম চলার নাম গাড়ি রে লা লা লা লা। শাহনাজের সাথে যখন গান করি, তখন সে বিয়েও করেনি। পরে আমার স্কুলবন্ধুকে বিয়ে করল। ওর হলো খুব তীক্ষ্ণ গলা। কাঁটার মতো বিঁধে সুর লাগে। ওর গাওয়া সব গানই হিট করে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মোটামুটি সব শিল্পীদের সাথেই আমার গাওয়া হয়েছে।’
প্রশ্ন : মঞ্চে গান করার কোনো ঘটনা বা স্মৃতি কি আছে?
খুরশিদ আলম : আর ভালো অভিজ্ঞতা বলতে একবার কুমিল্লা চাঁদপুরে বর্তমানে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব নিয়ে গেলেন। আমার একটা গান আছে ওই আঁকা বাঁকা নদীর ধারে, ছিল এক কোকিলা বন্ধু মন দিয়েছি যারে’। অনুষ্ঠান শুরুর আগে এক অধ্যাপক এসে আমাকে বলল, আপনি কোন গান করবেন আমার জানার কিছু নেই কিন্তু আপনাকে এই গানটি করতে হবে। তো আমি বললাম, ভাই কিছু মাইন্ড করেন না আমার তো গানের কথা মনে নেই। ভদ্রলোক বলল ঠিক আছে আপনি বসেন আমি কথা এসে দিচ্ছি। আমি আর না করতে পারলাম না। গানটা করলাম। এই গানটা কিন্তু সিনেমার গান না, আধুনিক গান। আর একবার ফরিদপুরে ১৯৭৩ সালে গেলাম। যে বাড়িতে ছিলাম রাতে, ওরা আমাকে আসতে দেবে না। সারা রাত গল্প করে সবাই ঘুমাল। ওরা ভাবছিল যে আমিও ঘুমিয়ে গেছি। কিন্তু আমি সার্কিট হাউসে বলে রেখেছিলাম যেন আমাকে টিঅ্যান্ডটিতে ফোন করে ডেকে দেয়। এরপর অনেক ভোরে ওরা ফোন করে ডেকে দিল আমি বাড়ির কাউকে না জানিয়ে চলে এলাম। আসলে অনেক জায়গাতেই এমন ছোট ছোট অনেক ঘটনা আছে। আর একটা ঘটনা আমার মনে হয়। কুমিল্লাতে কোনো একটা মেয়েদের স্কুলে গান করতে গেলাম। গান করার পর স্টেজ থেমে নেমে এলাম। একটি মেয়ে এসে আমাকে বলল, দেখুন আমি আপনার একজন বড় ভক্ত। কিন্তু আপনি ‘তোমার দু’ হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম গানটি করবেন না। এ সমস্ত আজেবাজে ফালতু গান করবেন না আপনি।
তো আমি আবার একটু মজা করে বললাম, কী ব্যাপার ছ্যাক-ট্যাক খাইছো নাকি। মেয়েটি বলল, তা আপনার জানার দরকার নাই। যা হোক ওই মেয়ের সব বান্ধবীরা বলতে থাকল আরে তুই এই সব কী বলিস। পরে অবশ্য মেয়েটি অনেক মাইর খেয়েছে। এই ব্যাপারটা আমার এখনো খুব মনে হয়।
প্রশ্ন : মঞ্চের কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা আছে কি?
খুরশিদ আলম : সৈয়দপুরে কিশোরগঞ্জ নামে একটা জায়গা আছে। সম্ভবত ১৯৯৬ বা ’৯৭ সালের দিকে আমরা শো করতে গেলাম সেখানে। শো শুরুর আগে আমাদের পেমেন্টটা দিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও ওরা দিচ্ছিল না। বারবার বলছিল অনুষ্ঠান শুরু করেন তারপর। কিন্তু ওরা আমাদের পেপেন্টটা দেয়নি। না দিয়ে বারবার বলছে মঞ্চে ওঠেন। গান করেন আগে। আমি তো পেমেন্ট ছাড়া মঞ্চে যাচ্ছি না। এই সিচুয়েশনের মাঝে হঠাৎ দেখলাম একজন চাকু দিয়ে হাত কেটে দেখাল। আমি বুঝে গেলাম যে সে প্রোফেশনাল মার্ডারার। এরপর যারা আমাদের স্কট দিয়েছিল, আমি ওদের বললাম ব্যাপারটা। ওদের কাছে জানতে চাইলাম যে তাদের বাড়ি কোথায়। ওরা বলল কুমিল্লা। আমি বিয়ে করেছি কুমিল্লায়। ওদের বললাম ভাই, এমন সিচুয়েশনে জীবন-মরণ সমস্যা। গুলিটা বের করেন। আমাকে একটা রাইফেল দেন। এরপর রাইফেলের চিকন দিকটা ধরে উল্টা পাশ দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে লোকজন সরায় দিয়ে আমরা রাস্তায় আসি। পরে প্রায় বিপদেই পড়ে যাচ্ছি এমন শোনা যাচ্ছিল। যেখানেই যাই লোকজন বলতে থাকে ভাই আপনারা পালান, এখনো পালান নাই, বিপদ আছে, ভাগেন। পরে ব্যাপারটা বুঝলাম ওই অনুষ্ঠানটা যারা আয়োজন করেছিল তাদের সাথে স্থানীয় প্রতিনিধিদের কোনো যোগাযোগ বা মিটিং হয়নি। আর আমার সাথে ওদের ওভার ফোনে কথা হয়েছিল। তো পেমেন্ট নিয়ে কথা হয়েছিল। ওরা বলেছিল, ভাই আপনারা আসেন কোনো সমস্যা হবে না। আমিও বিশ্বাসের সাথে চলে গেছি। আমার সাথে পরিচিত একজন ফিমেল আর্টিস্ট ছিল (এই মুহূর্তে নামটা মনে হচ্ছে না) আর নাচের শিল্পী ছিল সুলতানা। অনেক কষ্টে ওইখান থেকে বের হয়ে আমরা রওনা দিলাম। যে জিপটা নিয়ে গেছিলাম, ড্রাইভার বলল স্যার তেল শেষ, যাব কীভাবে। আমি বললাম থানার দিকে যাও দেখি, একটা ব্যবস্থা হবে। সে সময় থানার ওখানে আবার রাত ১২টার পর কোনো যানবাহন ঢোকা নিষেধ ছিল। ওরা এক দুই তিন বলার সাথে সাথে না থামালে ফায়ারিং করত। আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে পুলিশ ফায়ারিং করল। আমি গাড়ি থেকে নামতেই ওরা আমাকে চিনতে পারল। বলল, স্যার কী সমস্যা। আমি পুরো ব্যাপারটা পুলিশকে বুঝিয়ে বলার পর ওরা গাড়িতে তেল দিল। এরপর আমরা একটানে সৈয়দপুর আসলাম। জানটা হাতে নিয়ে ফিরে এলাম ঢাকায়। আমার জীবনে এই অনুষ্ঠানটা একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা দিয়েছে।
প্রশ্ন : আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কোন সময়টা বা কোন গান।
খুরশিদ আলম : যদি গান শেখার কথা বলি তাহলে বলব যে সময়টায় সমর দাশ আমাকে শেখালেন। সেই শিক্ষাটা আমার গান গাওয়ার স্টাইলকে বদলে দিয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে খুব কাজে দিল। আর দ্বিতীয়ত হলো, প্রথম যে গানটি রুনা লায়লার সাথে গাইলাম। পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার ঠিক যেন নাটোরের বনলতা সেন- এই গানটি আমাকে এত ওপরে উঠায় দিয়েছিল যে কেউ ভাবেইনি যে এই গানটি এত হিট করবে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গান করছি এখনো। যতদিন পারি গেয়ে যেতে চাই।