গায়ক না হলে ক্রিকেটার হতাম : শুভ্র দেব

শুভ্র দেব, দেশের খ্যাতিমান একজন সংগীতশিল্পী। ১৯৭৮ সালে বিটিভির নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রেসিডেন্টেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। এরপর ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে সংগীত নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন গুণী এই সংগীতশিল্পী। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম একক অ্যালবাম ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’। এরই মধ্যে ২৬তম অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন শুভ্র দেব। তাঁর শ্রোতাদের জন্য সুখবর হলো, আগামী ৩১ ডিসেম্বর, নতুন অ্যালবাম নিয়ে আসছেন তিনি। অ্যালবামের নাম ‘ককটেল’। নতুন গানের অ্যালবাম, সংগীত জীবনের ৩১ বছর পূর্তি, সংগীত যাত্রাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন শুভ্র দেব।
প্রশ্ন : আপনার জীবনে সংগীতের যাত্রা কীভাবে শুরু হয়েছে?
উত্তর : ক্লাস এইটে পড়ার সময় আমি একটি ব্যান্ড দলে যোগ দিয়েছিলাম। ব্যান্ডটির লিড ভোকালিস্ট ছিলাম আমি। এরপর ধীরে ধীরে সংগীতের সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৮৪ সালে সিলেট থেকে ঢাকায় আসার পর প্রথমে তিনটি গান রেকর্ড করেছিলাম আমি । আমার মামা বিখ্যাত সংগীত পরিচালক সুজেয় সেন। ঢাকায় আমি মামার বাসায় থাকতাম। তাঁর কাছে থাকার কারণে সংগীতচর্চা করা আমার জন্য সুবিধা হয়েছিল। মামা দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত শিল্পীর গান শুনতেন। আমিও শুনতাম।
প্রশ্ন : ৩১ বছর ক্যারিয়ারে আপনি কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন কী?
উত্তর : যখন আমি নতুন কুঁড়িতে চ্যাম্পিয়ন হলাম তখন থেকেই আমার চলার পথ অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। কোনো রকম অডিশন ছাড়াই বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর দেশের সেরা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ ইত্যাদি’ , ‘শুভেচ্ছা’য় গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। এভাবে আমার ক্যারিয়ার সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলতে আমি ক্যারিয়ারে বাধার সম্মুখীন হইনি। কিন্তু আমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। আমার প্রথম অ্যালবাম হিট হওয়ার পর আমি খুব চিন্তা-ভাবনা করেই কাজ করতে শুরু করেছিলাম। সব সময় ভাবতাম নিজেকে কীভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব!
প্রশ্ন : বিশেষ কোনো স্মরণীয় প্রশংসার কথা আপনার মনে আছে?
উত্তর : এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ১৯৯৮ সালের কথা। আমি তখন মিনি বিশ্বকাপের থিম সং গেয়েছিলাম ঢাকা স্টেডিয়ামে। সেই সময় আইসিসির প্রেসিডেন্ট প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়া আমার গান শুনে অনেক প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘উই নিড পিপল লাইক ইউ ইন দিজ ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড।’ তিনি খুব বিস্মিত হয়েছেন এই ভেবে যে, বাংলাদেশে বিশ্বকাপ নিয়ে একটি গান হতে পারে আর সেটা ভেবেছে তরুণ একটি ছেলে!
আর একটা ঘটনা বলি। ১৯৯৯ সালে শচীন টেন্ডুলকার বাংলাদেশে খেলতে এসেছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। শচীন টেন্ডুলকারকে আমি নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রয়াত কিশোর কুমারের গাওয়া একটি গান শুনিয়েছিলাম। আমার গান শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি বোম্বেতে এসে গান গাও না কেন?’ আমি তো শচীন টেন্ডুলকারের অনেক ভক্ত। তাঁর কাছ থেকে প্রশংসা শোনার পর খুব ভালো লেগেছিল আমার।
প্রশ্ন : ‘এই মন আমার পাথর তো নয়’ আপনার গাওয়া বিখ্যাত এই গান সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : গানটি লিখেছেন আহমেদ রিজভী। প্রয়াত প্রণব ঘোষ এর সুর করেছিলেন। গানটিতে সকাল বেলা আমি প্রথম কণ্ঠ দিয়েছিলাম এবং তা রেকর্ড করা হয়। গানটি রেকর্ড হওয়ার পর কেন জানি আমার ভালো লাগেনি। এরপর রেকর্ডের পরের দিন বিকেল ৪টায় আবারও এই গানে আমি কণ্ঠ দিয়েছিলাম। গানটি যে তখন এত হিট করবে সেটা ভাবতে পারিনি। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও এই গান অনেক পছন্দ করে। বিভিন্ন মুঠোফোন সেবাদাতা সংস্থার পক্ষ থেকে আমি জানতে পেরেছি টপ রিংটোন চার্টে এই গান রয়েছে এবং ডাউনলোডের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক বেশি। আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে দুঃখের গান এ রকম খুব কমই হিট হয়েছে। আমি সিঙ্গাপুরে একটা কনসার্টে করেছিলাম। সেখান দর্শক ছিল প্রায় ১০ হাজার। আমি খেয়াল করেছি ৮ হাজার দর্শকই এই গান ভালোভাবে গাইতে পারেন। মানে আমার গাওয়া সব গানের মধ্যে এই গানটি দর্শক-শ্রোতারা পুরোই গাইতে পারেন। সবার মুখস্ত এই গান। গানটার বয়স এখন ২১ হলো। তবুও শ্রোতারা এই গান শুনছেন। আর সেই সময় দুঃখের রোমান্টিক গান শাকিলা আপা একটা গেয়েছেন তা হল- ‘ভুলিতে পারি না তাকে, ভোলা যায় না’। এই গানটিও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটা আমার লেখা গান।
প্রশ্ন : আপনার নিজের গাওয়া প্রিয় গান সম্পর্কে জানতে চাই।
উত্তর : ‘আমি মানুষ চিনেছি, তোমায় চিনতে পারিনি...’ এই গান আমার অনেক প্রিয়। গানটি লিখেছেন কবির বকুল এবং সুর করেছেন জাহিদ হোসেন। এই গানের সুর প্রথমে শোনার পর আমার মনে হয়েছিল, আমাকে দিয়ে এই গান হবে না। কারণ গানের সুর আমার কাছে খুব কঠিন লেগেছিল। গানটি রেকর্ড হওয়ার পর মনে হয়েছে আমি পেরেছি।
প্রশ্ন : আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল আমার প্রথম অ্যালবাম ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’। এরপর আমি যখন পেপসির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হই তখন বিপুল সাড়া পেয়েছিলাম। এরপর ১৯৯৮ সালে আইসিসি মিনি বিশ্বকাপের থিম সং আমি গেয়েছিলাম। এটাও টার্নিং পয়েন্ট বলতে পারেন।
প্রশ্ন : ‘আনন্দ বিচিত্রা’ পত্রিকার প্রচ্ছদে একবার আপনার ছবি ছাপা হয়েছিল?
উত্তর : এটা ১৯৮৫ সালের কথা। ‘আনন্দ বিচিত্রা’ ম্যাগাজিন পত্রিকার কাভারে আমার ছবি দিয়ে লেখা হয়েছিল- ‘ক্যাসেটে যাঁর পারিশ্রমিক সর্বোচ্চ!’। আমাকে এই ম্যাগাজিন পত্রিকাটি শুধু প্রচ্ছদের জন্য ২০ হাজার টাকা দিয়েছিল। আর সেই সময় শিল্পীদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ একটা সম্মানজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করেছিলাম। সেই সময় বাজারে আমার আর জেমসের বেশি কাভার স্টোরি করা হয়েছিল।
প্রশ্ন : আপনার প্রথম মিউজিক ভিডিও করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
উত্তর : ইত্যাদিতে সর্বপ্রথম আমার নির্মাণে মিউজিক ভিডিও প্রকাশ হয়েছিল। সেটা ছিল ১৯৯১ সাল। গানের শিরোনাম ছিল ‘শেষ চিঠি’। গানটির শুটিং সুইডেনে করেছিলাম। এই মিউজিক ভিডিওটি বানানোর পিছনে অনেক টাকা ব্যয় করেছিলাম। ভিডিওটি নিয়ে আলোচনাও অনেক হয়েছে। তাই আমার পরিশ্রম ও উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
প্রশ্ন : মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল কীভাবে?
উত্তর : আমার বয়স তখন ২১ হবে। ১৯৯৩ সালে আমি প্রথম আমেরিকায় একটি শো করতে যাই। আমার ১৯ ফেব্রুয়ারি কনসার্ট ছিল। ১৮ তারিখে মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। শাহীন ভাই মাইকেল জ্যাকসনের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করে বলেন, ‘আমাদের দেশে একজন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আছেন তিনি মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে দেখা করতে চান।’ পরে সেই ম্যানেজার মোমের জাদুঘরে এক অনুষ্ঠানে মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। আমি তাঁর অটোগ্রাফ চাইতেই তিনি বলেছিলেন, ‘হাউ ডু ইউ স্পেল ইউর নেম?’ এই কথাটি এখনো আমার কানে বাজে। আমি তাঁকে সামনা সামনি দেখার পর বিশ্বাসই করতে পারিনি। আমার কাছে মনে হয়েছিল পুরো ঘটনাটাই আমি স্বপ্নে দেখছি। আমি আসলে অনেক লাকি।
প্রশ্ন : আপনার জীবনের বড় অর্জন কী বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : জীবনের অর্জন নিয়ে খুব একটা ভাবিনা আমি । আমার কাছে মনে হয় জীবনের প্রথম ইনিংস আমি শেষ করেছি, এখন দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছি।
প্রশ্ন : সংগীতশিল্পী না হলে কী হতেন?
উত্তর : ক্রিকেটার হতাম। ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল আমার। ক্রিকেট খেলতামও আমি। আমার ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। বাবার কথা মতো আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রিতে ভর্তি হই এবং পড়াশোনা ভালোভাবে শেষ করি।
প্রশ্ন : আপনার প্রিয় সহশিল্পী কে?
উত্তর : শাকিলা আপার সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা অনেক ভালো ছিল। আর সবদিক দিয়ে যদি বলি তাহলে মিতালী মুখার্জির সঙ্গে আমার যৌথ গানের অভিজ্ঞতা ছিল দারুণ। মিতালী মুখার্জি খুব সিম্পল মাইন্ডেড এবং হেল্পফুল।
প্রশ্ন : দীর্ঘ সংগীতজীবন ক্যারিয়ারে আপনার কি কোনো অভিমান জমা আছে?
উত্তর : সত্যি কথা বলতে কী! মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আমার কোনো অভিমান-অভিযোগ নেই। কারণ আমি মানুষের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। আমি ৪০টা ছবিতে গান গেয়েছি। তবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি আমাকে দিয়ে হয়তো আরো অনেক প্লে-ব্যাক করাতে পারত। কিন্তু সেটা তারা করেনি।
আমি বলব, বাংলাদেশে গানের সংস্কৃতি অনেক ভালো। যাঁরা ভালো গান করেন তাঁদের জনপ্রিয়তা আমরা দেখতে পাই। আমার কথাই বলি, গান গেয়ে আমি মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু গণমাধ্যমের খবর আমার ভালো লাগে না, যেমন যাঁরা মূলত গান গাইতে পারেন না, হয়তো সফটওয়্যারের সাহায্যে গান বের করেন, সেসব গায়কেরই বেশি কাভারেজ দেয়। আসলে সেই গণমাধ্যমগুলো অনেক সময় সঠিক শিল্পী নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়।
প্রশ্ন : তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির এই সময়ে এখনো মানুষ সিডি কিনে গান শোনে কি? আপনার মতামত কী?
উত্তর : আমার ধারণা মানুষ এখনো ভালো গানের সিডি কিনে থাকে। এ জন্য গানের আ্যালবামের মার্কেটিং ভালোভাবে করতে হবে। যাতে শ্রোতারা অ্যালবাম কিনতে আকৃষ্ট হন, সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং মানসম্মত গান তো গাইতেই হবে।
প্রশ্ন : আপনার আসন্ন ‘ককটেল’ অ্যালবাম সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : এই অ্যালবামে বিভিন্ন স্বাদের গান থাকবে। আমার বিশ্বাস শ্রোতারা গান শুনে বিরক্ত হবেন না। সেভাবে অ্যালবামের গানগুলো সাজানো হয়েছে। আমার শেষ ‘জলছবি’ অ্যালবামের গানগুলো দর্শক-শ্রোতারা যেভাবে ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন ঠিক তেমনি ‘ককটেল’ অ্যালবামেও নতুন স্বাদ পাবেন তাঁরা ।
প্রশ্ন : একজন শুভ্র দেব হওয়ার পিছনে কার অবদান আপনার কাছে অনেক মূল্যবান?
উত্তর : আমার নিজের চেষ্টা ছিল অনেক বেশি। আমার পরিবারের অনেকে সংগীতচর্চা করতেন। আমার ছোটবোন ও মাসি গান শিখতেন। তাঁরা সংগীত পণ্ডিত রাম কানাই দাশের কাছ থেকে গান শিখতেন আর আমি তাঁর কাছ থেকে শিখতাম তবলা। তখন আমার বয়স ছিল সাত। তবে তবলা বাজানো শেখার আগেই আমি তবলা বাজাতে পারতাম। মাত্র আড়াই বছর বয়সে ভালো তবলা বাজাতে পারতাম আমি। সেই তবলা বাজানোর ছবিও আমার কাছে রয়েছে।
প্রশ্ন : তরুণ শিল্পীদের সম্পর্কে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : আসলে তরুণদের শিল্পী হওয়ার প্রবণতা খুব কম চোখে পড়ে। তাদের মধ্যে স্টার হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখি। আমি তাদের শুধু বলব, ভালো গান সততার সঙ্গে গাইতে হবে। একটা গান করার জন্য বারবার পরিকল্পনা করতে হবে। কমপক্ষে দেড় বছর সময় নিয়ে গানের অ্যালবাম বের করা উচিত। দ্রুত সবকিছু করতে চাইলে ফলাফল ভালো হয় না।
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
উত্তর : গান তো গাইছি। গানই করতে চাই। আর আমার মিউজিক্যাল লাইফ নিয়ে বায়োগ্রাফি লেখার ইচ্ছে আছে। সংগীত নিয়ে নতুন কিছু চিন্তাভাবনা রয়েছে আমার। সেটা সময় হলে সবাইকে জানাব।