‘প্রজন্মের উপযোগী লোকগান আমৃত্যু গাইতে চাই’
সাজেদ ফাতেমী। সাংবাদিক ও সংগীতশিল্পী। ‘নকশীকাঁথা’ নামে তাঁর লোকগানের দল রয়েছে। দলটির মূল গায়ক তিনি। ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারি দলটির জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠার ১১ বছর পূর্ণ করে ১২-তে পা দিয়েছে দলটি। দলের ১২ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিজের অনুভূতি ও অন্য আরো অনেক বিষয় নিয়ে এনটিভি অনলাইনকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাজেদ ফাতেমী।
এনটিভি অনলাইন : আপনাদের লোকগানের দল ‘নকশীকাঁথা’ এক যুগ পার করল। কেমন লাগছে আপনার? লোকগানের দল করে আপনি কি পুরোপুরি সন্তুষ্ট কিংবা সফল হতে পেরেছেন?
সাজেদ ফাতেমী : সফল হয়েছি কি হইনি, এভাবে বলতে চাই না। আমি সফল হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি। এখনো করছি। দলটি এক যুগ পার করল। মনের মধ্যে ভালোলাগা কাজ তো করছেই।
এনটিভি অনলাইন : লোকগানের দলটির নাম ‘নকশীকাঁথা’ কেন?
সাজেদ ফাতেমী : অনেক রঙিন সুতা দিয়ে নকশীকাঁথা তৈরী করা হয়। তেমনি আমরাও নানা ধরণের গান গাইতে পছন্দ করি। একসময় বাঙালির গোলাভরা ধান ছিল, গলাভরা গান ছিল, পুকুরভরা মাছ ছিল। এখন সেই গোলাভরা ধান কিংবা পুকুরভরা মাছ না থাকলেও বাঙালির গলাভরা গান আছে ঠিকই। তাই সারা বছর বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে গানের জমজমাট আয়োজন করা এখনো বাঙালির রীতিমতো অভ্যাস হয়ে আছে। অক্সিজেন যেমন করে প্রাণ বাঁচায়, গানও তেমনি করে মন বাঁচায়। মন বাঁচিয়ে রাখার এই তাগিদই বাঁচিয়ে রেখেছে নকশীকাঁথাকে। তাঁদের গান গাওয়ার আমন্ত্রণ আসছে ছোট-বড় নানান অনুষ্ঠানে। গানপিপাসু মানুষগুলোর মনের খোরাক মেটাতে তাই নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে নকশীকাঁথা।
এনটিভি অনলাইন : আপনার লোকগানের দলের সদস্যদের সম্পর্কে জানতে চাই।
সাজেদ ফাতেমী : লিড গিটার, রাবাব, ম্যান্ডোলিন ও দোতারায় আছেন জে আর সুমন, বেইজ গিটারে ফয়সাল, কি-বোর্ড, হারমোনিকা ও হারমোনিয়ামে রোমেল এবং কাহন, ঢোল ও তবলায় রয়েছে বুলবুল। নকশীকাঁথার প্রত্যেক সদস্যের হৃদয়ে রয়েছে অফুরান ভালোবাসা ও প্রাণশক্তি। এই ভালোবাসা দেশের জন্য। এই ভালোবাসা বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে থাকা লোকগানের জন্য। সেই ভালোবাসার বিনি সুতো দিয়ে মনের গহিনে থাকা সুপ্ত বাসনাগুলোকে ক্রমশ বুনন করে চলেছেন তাঁরা।
নকশীকাঁথার সদস্যরা বিশ্বাস করেন, একজন সচেতন মানুষের চিন্তা-চেতনার জগৎকে শাণিত করা এবং তাঁর নিজের চেতনার ভেতরে দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত বহু ভ্রান্ত মতামত থেকে তাঁকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো কালচারাল মোটিভেশন। আর এই মোটিভেশনের নিয়ামক শক্তি হলো নিজস্ব সংস্কৃতি, যার অন্যতম উপাদান হলো লোকগান। একটি সুন্দর গান যেমন মুহূর্তে মানুষের দুঃখ-কষ্ট-হতাশা মুছে দিতে পারে, তেমনি সেই গানই মানুষের ভালো কাজে প্রেরণা পাওয়ার অনন্ত উৎস হয়ে উঠতে পারে।
এনটিভি অনলাইন : আপনার গানের হাতেখড়ি কবে হয়েছিল?
সাজেদ ফাতেমী : লালমনিরহাটের শিল্পকলা একাডেমিতে আমি গান শিখেছি। ক্লাস সিক্স থেকে আমি গান গাইছি। শৈশবে লালমনিরহাট ও রংপুরে অনেক গানের প্রতিযোগিতায় আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম।
এনটিভি অনলাইন : ২০০৩ সালে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সংগীতা থেকে আপনার প্রথম একক অডিও অ্যালবাম ‘কতদিন তোমাকে দেখি না’ প্রকাশিত হয়। অ্যালবামটি শ্রোতারা খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এটা আধুনিক গানের অ্যালবাম ছিল। কিন্তু লোকগানের দল করার ইচ্ছা আপনার প্রথম কবে হয়?
সাজেদ ফাতেমী : ‘কতদিন তোমাকে দেখি না’ অ্যালবামটি সুপারহিট হওয়ার সুবাদে ২০০৪ সালে এনটিভি থেকে ‘মন আমার সন্ধান করি’ শিরোনামে বাউল গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করার জন্য আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানটি সানন্দে আমি উপস্থাপনা করি। মূলত এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের শুরু হয় বাউলদের নিয়ে পথচলা। ২০০৭ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি চলেছিল। অনুষ্ঠানটি করার সময় আমি বাউল গানের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। এখনো ডুবে আছি। অনুষ্ঠানটি করতে গিয়ে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের বাউল শিল্পীদের সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানতে পাই। এভাবে আমিও লোকগান গাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হই। এরপর লোকগানের দল গঠন করি।
এনটিভি অনলাইন : আপনাদের দলের প্রথম গানের অ্যালবাম কবে প্রকাশিত হয়?
সাজেদ ফাতেমী : দলের প্রথম অ্যালবামের নাম ‘নজর রাখিস’। ২০০৮ সালে এটি প্রকাশিত হয়।
এনটিভি অনলাইন : সম্প্রতি আপনারা নতুন কী গান করেছেন?
সাজেদ ফাতেমী : গত বছরের জুনে আমার সুর ও কম্পোজিশনে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের থিম সং ‘বাংলাদেশের দুরন্ত সন্তান’। একই বছর একই মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গড়ে তোলা প্রথম প্রতিরোধ নিয়ে একটি গানের সুর ও কম্পোজিশন করি আমি। ২৫ মার্চ শিরোনামে গানটি পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
এনটিভি অনলাইন : এখন কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
সাজেদ ফাতেমী : সারা দেশে আমরা কনসার্ট করছি। এ ছাড়া দল থেকে নতুন একক গানের কাজ চলছে। আমরা দেশের সব অঞ্চলের লোকগান করি। একেক অঞ্চলের গানের স্বাদ একেক রকম। গানে রয়েছে বিচিত্রতা ও ভিন্ন রং। আসছে পয়লা বৈশাখে আমরা শ্রীলংকা ও নেপালে কনসার্ট করব।
এনটিভি অনলাইন : এখনকার শিল্পীদের নিয়ে আপনার অভিমত কী?
সাজেদ ফাতেমী : এখনকার অনেক শিল্পীই আছেন, যাঁরা দর্শক-শ্রোতাদের খালি গলায় গান শুনাতে দ্বিধা করবেন। তথাকথিত এসব প্লাস্টিক শিল্পী অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শ্রোতাদের ভেল্কিবাজির মধ্যে রেখেছে তারা। দর্শকও অনেক সময় বুঝতে পারছে না তাঁরা এই শিল্পীদের গ্রহণ করবেন নাকি বর্জন করবেন। প্রকৃত অর্থে অনেক শিল্পী, তাঁরা এইসব তথাকথিত শিল্পীদের ভিড়ে চাপা পড়ে যাচ্ছেন।
এনটিভি অনলাইন : আপনার কাছে কারা প্লাস্টিক শিল্পী। তাঁদের নাম জানতে চাই…
সাজেদ ফাতেমী : প্রচুর আছে। তবে নাম বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই, এসব শিল্পীর কাছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি। কিছু কিছু গানের অডিও প্রতিষ্ঠান আছে, তারা এসব শিল্পীর প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের প্রমোট করছে।
এনটিভি অনলাইন : কিন্তু তারা কেন করছে?
সাজেদ ফাতেমী : টাকার বিনিময়ে করছে। ওই সব শিল্পী তাদের টাকা দিচ্ছে। কোম্পানিগুলো টাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করছে।
এনটিভি অনলাইন : এবার অন্য প্রসঙ্গে জানতে চাই। আপনি তো একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা নাকি গান, কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দেন?
সাজেদ ফাতেমী : চাকরি ও গান একদিনের জন্য থেমে থাকেনি। আমি মনে করি, সাংবাদিকতা আমার গানের কাজে ভূমিকা রাখে। আমি তো অনুসন্ধানীও একজন। বিভিন্ন অঞ্চলের বাউল গান অনুসন্ধান করি। সাংবাদিকতা করি বলে এই কাজটা করতে সুবিধা হয়। অনুসন্ধানীমূলক লোকগানের একটি পাণ্ডুলিপিও আমি প্রস্তুত করেছি। সামনের বছর বইটি প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এনটিভি অনলাইন : গান নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সাজেদ ফাতেমী : প্রজন্মের উপযোগী লোকগান আমৃত্যু গাইতে চাই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম লোকসংগীত যেন বেঁচে থাকে, সেই চেষ্টা আমরা করব। লোকগানের অনেক ধারা আছে। বিলুপ্ত লোকগানগুলো সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা আমার রয়েছে। আজ থেকে ১০০ বছর পর পৃথিবী কেমন হবে, এটা নিয়ে কল্পনা করে সেই বিষয়বস্তু নিয়ে জারি গানের ফরম্যাটে আমরা গান করতে চাই। এ ছাড়া বৃক্ষ বাঁচাতে, পরিবেশ ও নদী বাঁচাতে সচেতনতামূলক গান আমরা করতে চাই। এখন রেডিও ও টেলিভিশনে উপস্থাপকদের বাংলা ভাষার অনেক দুর্ব্যবস্থা। এ বিষয় নিয়েও কাজ করতে চাই।
আমাদের লোকগানের দল মনে করে, গোটা পৃথিবীই হলো লোকসংগীতের বিচরণক্ষেত্র। আর সেই বিচরণক্ষেত্রের প্রতিটি কোণে নিজেদের কীর্তি রেখে যেতে চায় তারা। নিজেদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী লোকগানকে তারা বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে আসছে নিজেদের ঢঙে। সেইসঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকগানগুলো নিজেদের দেশের দর্শকদের সামনে তুলে ধরছে।
এ দেশে বিচিত্র ধরনের লোকগান আছে। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারফতি, কীর্তন, বাউল, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, আলকাপ, মাইজভাণ্ডারির গান, ঘাটুগান, কবিগান, লোটো গান, মেয়েলি গীত, মাগনের গান, পালা গান, ধুয়া গান, গাজীর গান, বিচার গান, গাজীর পট, পাঁচালিসহ নানা জাতের গান। এসব গানের অধিকাংশই আজ বিলুপ্তির পথে। নকশীকাঁথা সেই বিলুপ্তপ্রায় ধারাগুলো থেকে কিছু কিছু ধারা ফিরিয়ে এনে আরো আকর্ষণীয়রূপে সেগুলো পরিবেশন করছে। লোকগানের সঙ্গে এ দেশের মানুষের নাড়ির বন্ধন রচিত হয়েছে বহু আগেই। অধিকাংশ মানুষেরই প্রাণের এই গান নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই। এই আগ্রহটুকুই হলো নকশীকাঁথার ভরসা।