‘যদি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে পারতাম, স্বীকৃতি পেতাম’...
খ্যাতিমান অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু যখন মুঠোফোনে যুক্ত হলেন, তখন তিনি খাচ্ছেন। ৩ সেপ্টেম্বরের দুপুর। মিষ্টি কণ্ঠে সেই কথা জানিয়ে বললেন, সন্ধ্যায় আরাম করে কথা হবে; সময়ও নির্দিষ্ট করে দিলেন। সে সময় রিং বাজতেই ও প্রান্ত থেকে শোনা গেল, ‘কোন বিষয়ে কথা বলতে চান, বলুন।’
সেই আলাপে এনটিভি অনলাইনকে ফজলুর রহমান বাবু শোনালেন তাঁর ৬০ বছরের জীবনের কর্ম, দর্শন, অপূর্ণতা, আকাঙ্ক্ষা ও অভিনয়-ভাবনার কথা।
এনটিভি অনলাইন : জীবনের ষাট বসন্ত দেখে ফেললেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে জীবন কেমন?
ফজলুর রহমান বাবু : জীবন জীবনের মতোই, সবার জীবন তো একই না। ছোটবেলায় জীবন নিয়ে আমার কোনও ভাবনা ছিল না। একটা পর্যায়ে এসে মনে হলো, জীবনটা এমনও হতে পারে। যে কাজটিকে আমার সবচেয়ে পছন্দের, ভালোবাসার হিসেবে নিয়েছি; সেটাকেই আমি পেশা হিসেবে নিতে পেরেছি। সে দিক থেকে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। আমার জীবন নিয়ে আমি অনেক বেশি সুখী। আমার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সংগঠন—সব মিলিয়ে আমি আমার জীবনটা যেমন চেয়েছিলাম, প্রায় সে রকমই হয়েছে আর কি। তবে মানুষের জীবন তো আর নির্ঝঞ্ঝাট হয় না, নানান ধরনের উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাই থাকে। এর মধ্যেও মনে করি, অনেকটাই নির্ঝঞ্ঝাট জীবন আমি পেয়েছি।
এনটিভি অনলাইন : সেই নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের সেরা সময়টা যদি আলাদা করে বলতেন।
ফজলুর রহমান বাবু : সেরা সময় নিয়ে তো আসলে ওই ভাবে চিন্তা করি না। তবে কৈশোরের কিছু দিন, যখন আমার বাবা মারা গেলেন, ওই সময়টা ছাড়া জীবনের আর সব সময়কেই আমার কাছে সেরা সময় মনে হয়। এর কারণ হলো, বর্তমানটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই, যখন যা বর্তমান ছিল সেই সময়টাকেই আমি উপভোগ করেছি। আমি মনে করি, এখন আমার সেরা সময়। অতীত নিয়ে আমি বেশি ভাবি না, আর ভবিষ্যৎ তো অবশ্যই মানুষের আছে, যা আমরা জানি না। তাই বর্তমানের গুরুত্বই আমার কাছে বেশি।
এনটিভি অনলাইন : অভিনয়দক্ষতায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছেন। এই তারকা জীবন কেমন উপভোগ করেন?
ফজলুর রহমান বাবু : আমি আসলে নিজেকে তারকা মনে করি না। আমি মনে করি, আর দশজন অভিনেতার মতো আমিও অভিনয় করি। তবে এই পেশায় কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। যেমন, ভালো কোনও অভিনয়ের পর অনেক মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়, আনুকূল্য, সমর্থন ও প্রশংসা পাওয়া যায়। সেই দিক থেকে আমি তো অবশ্যই সৌভাগ্যবান। আমি মনে করি অন্য দশটা পেশার মতোই আমার পেশা অভিনয়। মানুষ আমাকে ভালোবাসে বলে আমার অনেক দায়িত্বও রয়েছে। দর্শকদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, আমার সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করা—এ সবই আমি সঠিকভাবে করার চেষ্টা করি।
এনটিভি অনলাইন : এবার কাজের কথায় আসা যাক, সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করলেন...
ফজলুর রহমান বাবু : হ্যাঁ, বিঞ্জের। বাজারে নতুন এসেছে, তারা মনে করেছে যে আমি তাদের বিজ্ঞাপনের মডেল হতে পারি। তারা বলেছে, তাই কাজটি করেছি।
এনটিভি অনলাইন : নাটকে নিয়মিতই অভিনয় করছেন। সিনেমা এবং গানের কী খবর।
ফজলুর রহমান বাবু : সিনেমা তো অভিনয়েরই অংশ। আমি সিনেমায় কাজ করি একজন অভিনেতা হিসেবে। একজন অভিনেতা যে কোনও জায়গায়ই কাজ করতে পারে।
সিনেমাটা আমার পছন্দের একটি জায়গা। টেলিভিশন ফিকশনের চাইতে আমার বেশি ভালো লাগে, আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি চলচ্চিত্রে কাজ করার সময়।
মঞ্চও আমার খুব প্রিয় জায়গা, যেহেতু মঞ্চই আমার অভিনয়ের জন্মস্থান। সে জায়গার প্রতিও আমার একটা নাড়ির টান রয়েছে।
আর গানের ব্যাপারে বলব, আমি নিজেকে আসলে গায়ক ভাবি না। তবে গান যেহেতু করেছি এবং মানুষ আমার গান পছন্দ করেছে, গলা পছন্দ করেছে, সে কারণে মাঝেমধ্যে গান করি। এটাও অবশ্য আমার ইচ্ছামতো করি না। যাঁরা গানের ব্যবসায় যুক্ত, নিয়মিত গান রেকর্ড করেন, বিশেষত বর্তমানে ইউটিউব চ্যানেলে, তাঁদের অনুরোধেই আমার গান করা হয়। নিজের পরিকল্পনামাফিক গাওয়া হয় না। সেটা একেবারে ‘মনপুরা’ সিনেমায় গাওয়া আমার প্রথম গান থেকে বর্তমান পর্যন্ত, সব ক্ষেত্রেই। গান আমি পছন্দ করি, গান গাইতে পছন্দ করি, মানুষ আমাকে পছন্দ করে। এটাই আমার সৌভাগ্য।
এনটিভি অনলাইন : নাটকে ভিউ প্রতিযোগিতা ও সিন্ডিকেটের গল্প শোনা যায়। আপনি তো সিনিয়র অভিনেতা; ব্যাপারগুলো কীভাবে দেখেন?
ফজলুর রহমান বাবু : ভিউভিত্তিক নাটক মানেই যে খারাপ হবে, সেটা আমি মনে করি না। আমি মনে করি, একটি ভালো নাটকেরও অনেক ভিউ হতে পারে, আবার খারাপ নাটকেরও অনেক ভিউ হতে পারে। ভিউ নির্ভর করে দর্শকের ওপর, কেমন দর্শক দেখছে সেটার ওপরে।
উদাহরণ দিয়ে বলি, আমার অভিনীত একটি চলচ্চিত্র ‘অজ্ঞাতনামা’। টিকেট কেটে সিনেমা হলে গিয়ে যত মানুষ এটি দেখেছে, তার চেয়ে বেশি দেখেছে ইউটিউবে। এর ভিউও অনেক বেশি অন্যান্য ফিল্মের চাইতে। কিন্তু এটা তো নিঃসন্দেহে একটি ভালো ছবি। আবার অনেক খারাপ, নিম্নমানের ছবি বা নাটকে আমরা দেখি অনেক ভিউ। এটা নির্ভর করছে কোন শ্রেণির দর্শক দেখছে, তার ওপর।
আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, আমি তিন-চার মিনিটের একটি ছোট্ট শর্টফিল্মে কাজ করেছিলাম, অলিম্পিক বিস্কুটের সৌজন্যে। একজন বাবা নিজের জন্য জুতা কিনতে গিয়েছেন, পরে সন্তানের জন্য কিনে এনেছেন। এটা তো কোটি কোটি ভিউ হয়েছে, কিন্তু এটি তো কোনও নিম্নমানের কাজ নয়। আমাদের দায়িত্ব হলো কোন কনটেন্ট আমরা দর্শককে বেশি দেখাব। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।
একজন শিল্পী হিসেবে, নাট্যকার হিসেবে কী ধরনের কনটেন্ট আমরা মানুষকে বেশি দেখাব, এই দায়িত্বশীলতার জায়গাটা সবাইকে পালন করতে হবে। দায়িত্বহীনভাবে যারা কাজ করছে, তারা ভিউয়ের পেছনে ছুটছে। আপনি যে ভিউ বোঝাতে চাচ্ছেন, সে ভিউ আসলে আমাদের কাম্য নয়, সে দর্শক আমাদের কাম্য নয়। অনেকে আজেবাজে গান গাইছে, নাটক করছে—এগুলো প্রত্যাশিত নয়। এবং এ ধরনের নাটকে আমি সাধারণত কাজ করি না। আমি বলে দিই যে আমি ওই ধরনের অভিনেতা নই যে ভিউয়ের পেছনে ছুটব। আমি চেষ্টা করি ভালো গল্পে কাজ করব, ভালো ডিরেক্টরের অধীনে এবং ভালো অভিনেতাদের সাথে কাজ করব। তাতেও কিন্তু ভিউ বাড়বে। আর আমি কোনও সিন্ডিকেটের ভেতরে নেই বলে এ সব নিয়ে খুব একটা ধারণা নেই।
এনটিভি অনলাইন : সবাই এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছে, বাংলাদেশে ওটিটির কেমন ভবিষ্যৎ দেখছেন?
ফজলুর রহমান বাবু : আমি মনে করি বাংলাদেশে এর ভবিষ্যৎ ভালো। আমরা একসময় মঞ্চে নাটক করতাম, টেলিভিশনে করতাম। এগুলো একেকটা প্ল্যাটফর্ম। ওটিটিও তেমনই একটি প্ল্যাটফর্ম।
এনটিভি অনলাইন : আমাদের দেশের দর্শক টাকা খরচ করে ওটিটিতে দেখতে আগ্রহী হবেন?
ফজলুর রহমান বাবু : হ্যাঁ, মানুষজন তো খরচ করেই ওটিটিতে কনটেন্ট দেখছে। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই তো ওয়াইফাই ব্যবহার করেন না। একেবারে খেটেখাওয়া যাঁরা, শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষ, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে যে শ্রমিক ভাইবোনেরা কাজ করেন, তাঁরা কিন্তু টাকা দিয়ে ডাটা কিনেই আমাদের নাটক দেখেন।
কেউ যদি ২০ টাকা দিয়ে ডাটা কিনে নাটক দেখতে পারে, তাহলে সে ২০ টাকা দিয়ে একটি অ্যাপও এক সপ্তাহের জন্য বা একমাসের জন্য নিতে পারে। এমন তো নয় যে এগুলো একবছরের জন্য নিতে হয়। আপনি প্রয়োজনমতো কিনতে পারেন।
আমাদের প্রান্তিক মানুষজন একসময় টিকেট কেটে সিনেমা দেখত। আজ থেকে ২০ বছর আগে কি সে ২০ টাকা দিয়ে সিনেমা দেখেনি? সে ২০ টাকার সমান যদি আমি বর্তমানে ৫০ টাকাও ধরি, এটা সে খরচ করতেই পারে কনটেন্ট দেখার জন্য।
এনটিভি অনলাইন : দীর্ঘ তিন যুগের বেশি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। জীবনে অপূর্ণতার হিসাব আছে কতখানি?
ফজলুর রহমান বাবু : না, আমার কোনও অপূর্ণতা নেই। অপূর্ণতা নিয়ে ওভাবে ভাবিও না। এক জীবনে তো সবকিছু করা সম্ভব নয়, জীবনের তো সীমা রয়েছে। সবকিছু করতে গেলে তো অনেক জীবন লাগে। আমার জীবনে যতটুকু সম্ভব আমি করছি।
তবে হ্যাঁ, আমার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আরও ভালো ভালো কাজ যদি করতে পারতাম, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতাম বা আন্তর্জাতিক কোনও কাজ করতে পারতাম, যা বিশ্বব্যাপী দর্শক দেখবে, আমাদের ছবি ভেনিস উৎসবে, কান উৎসবে যাবে; সেখানে সারা পৃথিবীর মানুষ আমাদের অভিনয় দেখবে—এমন অনেক আকাঙ্ক্ষা আমার রয়েছে।