স্বামী ‘হত্যা’র পর এবার প্রেমিকের ফাঁসি চাইলেন মনুয়া
মাত্র ৭২ ঘণ্টা আগে পুলিশ লকআপে বসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উত্তর চব্বিশ পরগনায় নিহত অনুপম সিংহের স্ত্রী মনুয়া মজুমদার জানিয়েছিলেন, জেল থেকে ছাড়া পেলে প্রেমিক অজিত রায়কে বিয়ে করবেন তিনি। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে সেই মনুয়াই স্বামীর খুনের মামলায় রাজসাক্ষী হতে চেয়ে প্রেমিক অজিতের ফাঁসি দাবি করলেন।
তথ্যটি জানিয়েছেন উত্তর চব্বিশ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, নিহত অনুপমের স্ত্রী মনুয়ার এমন দাবিতে রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছে পুলিশকর্তাদের।
এদিকে প্রেমিকার কাছ থেকে এমন কথা শোনার পর পুলিশ হেফাজতে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন অনুপমের আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী ও মনুয়ার প্রেমিক অজিত। পুলিশের কাছে কাঁদতে কাঁদতে অজিত বলছেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেল স্যার। আমি বুঝতে পারিনি ও এত বড় মায়াবিনী।’
পুলিশ কর্মকর্তা অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, গত ২ মে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসত হৃদয়পুরের তালতলার বাসিন্দা অনুপম সিংহ নৃশংসভাবে খুন হন। তদন্তে নেমে এই খুনের মূল পরিকল্পনাকারী অনুপমের স্ত্রী মনুয়া মজুমদার ও মূল খুনি মনুয়ার প্রেমিক অজিত রায়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারপর তাঁদের ১০ দিনের পুলিশি হেফাজতে নিয়ে চলছে ক্রমাগত জেরা। পুলিশি জেরায় এরই মধ্যে অজিত ও মনুয়া হত্যা ও হত্যার পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেছেন।
এর মধ্যে পুলিশ হেফাজতে বসেও একের পর এক বাঁচার পরিকল্পনায় ছক বদলাচ্ছেন মনুয়া। সর্বশেষ এ মামলায় রাজসাক্ষী হতে চেয়ে প্রেমিক অজিতের ফাঁসি চাইলেন তিনি। যদিও পুলিশ কর্মকর্তা অভিজিতের বক্তব্য, মনুয়া রাজসাক্ষী হতে চাইলেও পারবেন না। কারন, তিনি এ মামলায় মূল ষড়যন্ত্রী।
অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায় আরো জানান, মনুয়া অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার মেয়ে। স্বামীকে খুনের পরও কোনো স্ত্রী এতটা মাথা ঠান্ডা রেখে পুলিশ হেফাজতে অভিনয় চালিয়ে যেতে পারেন, তা বিশ্বাস করাই যায় না।
এদিকে প্রেমিকা মনুয়ার ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ বুধবার রাত থেকে চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়েছেন অজিত। জেরার মুখে তিনি পুলিশকে জানান, উত্তর চব্বিশ পরগনার শহরতলির অশোকনগরের উঁচুকয়াডাঙ্গায় তাঁর ছোট্ট টালির বাড়ি। গরিব ঘরের ছেলে তিনি। মনুয়ার প্রেমে পড়ে তিনি অনুপমকে খুন করেছিলেন। নিজের স্ত্রীকেও ছেড়ে চলে এসেছিলেন। ভেবেছিলেন, অনুপম মারা গেলে মনুয়াকে নিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধবেন তিনি।
অজিত বলেন, ‘তিনি মনুয়াকে বলেছিলেন, আমার টাকাপয়সা নেই, আমাকে ভালোবাসবে তো? উত্তরে মনুয়া জানিয়েছিলেন, আমি টাকা ভালোবাসি না। আমি তোমাকেই ভালোবাসি।’
মনুয়ার কথা বিশ্বাস করে খুনের দিন অজিত তাঁর অশোকনগরের বাড়ি থেকে বের হন। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মায়ের কাছে ১০০ টাকা ধার চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মায়ের কাছে ১০০ টাকা না থাকায় ৫০ টাকা নিয়ে বের হন অজিত। মাকে জানিয়েছিলেন, কলকাতায় কাজের খোঁজে যাচ্ছেন তিনি।
বাড়ি থেকে এসে ওই দিন রাতেই পূর্বপরিকল্পনামতো অনুপমকে খুন করেন অজিত। খুনের পর হৃদয়পুর থেকে বেরিয়ে বারাসতে নবপল্লীতে মনুয়ার বাবার বাড়ির সামনে যান তিনি। সেখানে আগে থেকেই অজিতকে দেখার জন্য ছাদে দাঁড়িয়েছিলেন মনুয়া। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখা দিয়ে অজিত সে রাতেই চলে যান কলকাতার শোভাবাজারে। সেখানে একটি মদের দোকানে বসে সারা রাত মদ খান তিনি। এরপর ভোর ৪টার দিকে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরে গিয়ে পূজা দেন।
জেরাতে পুলিশ জানতে পেরেছে, খুনের পর ওই দিন রাতে মোবাইলে অজিত ও মনুয়া ঘনিষ্ঠ প্রেমালাপও করেন। সেই মনুয়াই এখন নিজে বাঁচার তাগিদে এ মামলায় রাজসাক্ষী হতে চাওয়ায় প্রেমিক অজিতের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।
এর আগে গত সোমবার বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন বারাসত ‘লাইভ মার্ডার’-এর অন্যতম চরিত্র নিহতের স্ত্রী মনুয়া। সেখানে জানিয়েছেন স্বামী হত্যার নানা তথ্য।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, এতটা ঠান্ডা মাথায় যে কাউকে খুন করা সম্ভব, তা ভাবতেও পারেননি তাঁরা। তাই ব্যবসায়ী অনুপম নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী মনুয়া মজুমদারকে সন্দেহ করেনি কেউই।
শেষ পর্যন্ত হয়তো করতও না। যদি না পুলিশের গোয়েন্দাদের তৎপরতায় মনুয়ার অন্য আরেকটি মোবাইল ফোনের হদিস মিলত। যে ফোনটি দিয়ে অভিযুক্ত নারী শুনেছিলেন স্বামীর শেষ আর্তচিৎকার।
হত্যাকাণ্ডের বিবরণে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ জানায়, প্রথমে অনুপম সিংহের মাথা রড দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল। আকস্মিক আক্রমণে অনুপমের চিৎকারে আকাশ ভারি তখন। এরপর আততায়ী পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা বের করে একটি নম্বরে ডায়াল করে ধরল আহত অনুপমের সামনে। অনুপমের আর্তচিৎকার মোবাইল ফোনে কেউ শুনছে!
এরপর রড দিয়ে অনুপমের মুখ থেঁতলে দিল আততায়ী। মোবাইল ফোন তখনো চালু। এরপর ভারী রড দিয়ে ভাঙা হলো অনুপমের নাক। তখনো থামেনি বছর পঁয়ত্রিশের যুবক অনুপমের বাঁচার আকুতি-গোঙানি। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে অনুপমের হাতের রগ কেটে দিল আততায়ী।
পুলিশ জানায়, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড চলাকালীন মোবাইল ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন অনুপমের স্ত্রী মনুয়া। আর যে আততায়ী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, সে মনুয়ার পরকীয়া প্রেমিক অজিত। প্রেমিক অজিতের কাছে মনুয়ার আবদার ছিল, স্বামীর শেষ মরণচিৎকার শোনা!
গত ২ মে হৃদয়পুরে নিজ বাসায় খুন হন অনুপম সিংহ (৩২)। হত্যাকাণ্ডের পর গোয়েন্দা তৎপরতার ভিত্তিতে পুলিশ নিহতের স্ত্রী মনুয়া মজুমদার ও তাঁর প্রেমিক অজিত রায়কে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে দুজনের কাছ থেকেই ওই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পেয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।
জানা যায়, অনুপমের আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশে। বেশ কয়েক বছর আগে অনুপম ভারতে এসে বারাসতের হৃদয়পুরে নিজে বাড়ি করেন। কলকাতার একটি মানি এক্সচেঞ্জারের পাশাপাশি ট্রাভেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনুপম। টানা ছয় বছর প্রেম করার পর বছর দেড়েক আগে মনুয়াকে বিয়ে করেন অনুপম। মনুয়ার বাড়ি বারাসতের নবপল্লী এলাকায়।
এদিকে অনুপমের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করলেও কলেজজীবনের বন্ধু অজিত রায়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখেন মনুয়া। অজিত উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরের বাসিন্দা। তবে এ ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেননি অনুপম।
পুলিশ জানায়, মাসখানেক আগে অনুপমকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন অজিত ও মনুয়া। উভয়ে মনে করছিলেন, তাঁদের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন অনুপম।
গত ২ মে সন্ধ্যায় অফিস থেকে বারাসতের নবপল্লীতে শ্বশুরবাড়ি যান অনুপম। রাতে শ্বশুরবাড়িতে খাওয়া-দাওয়া সেরে একাই হৃদয়পুরের বাড়িতে ফিরে আসেন। মনুয়া ওই রাতে স্বামী অনুপমের সঙ্গে বাড়িতে ফেরেননি।
ওই রাতেই অনুপমের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন অজিত। অনুপম ঘরে ঢোকার পরই রড দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেন অজিত। এরপর ওই রড দিয়ে পিটিয়ে অনুপমকে হত্যা করা হয়। আর দূরে বসে মোবাইল ফোনে অনুপমের শেষ চিৎকার শোনেন মনুয়া।
চলে যাওয়ার সময় অনুপমের আঙুলের আংটিটি নিয়ে যায় অজিত। ওই আংটির সূত্র ধরেই খুনের কিনারা পায় পুলিশ।
এদিকে খুনের পর সারা রাত ফোনে তাঁকে না পাওয়ায় পরের দিন সকালে বাড়িতে পৌঁছান এক আত্মীয়। বারবার কলিংবেল বাজিয়েও সাড়া না পাওয়ায় দরজা ধাক্কা দিতে বোঝেন ভেজানো ছিল সেটি। ভেতরে ঢুকে দেখেন, ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে অনুপমের রক্তাক্ত দেহ।
উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, খুনের পর মনুয়া এত ঠান্ডা ছিল যে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না যে আসলে ওই ছিল অনুপম হত্যাকাণ্ডের নাটের গুরু!
মনুয়া ও অজিতের বিরুদ্ধে খুন, তথ্যপ্রমাণ লোপাট ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারায় মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়।