‘করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে কোনো কোম্পানি আগ্রহ দেখায়নি’
কেউ হয়তো আশা করছেন, কোনো একটি ওষুধ কোম্পানি বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাসের টিকা বা প্রতিষেধক বাজারজাত করে লাখো বা কোটি ডলার আয় করে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এমনটা হচ্ছে না সহসাই। বৈশ্বিক ভ্যাকসিন বাজার চলতি বছরে ছয় হাজার কোটি ডলারে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সেখানে বড় ধরনের লাভের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
‘একটি টিকা বা প্রতিষেধক সফলভাবে বের করে আনা বেশ জটিল কাজ। সাধারণত এর জন্য অনেক সময় ও অর্থ দরকার হয়,’ বলছিলেন জৈবপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘লংকার ইনভেস্টমেন্ট’-এর প্রধান নির্বাহী ব্রাড লংকার।
তিনি বলেন, ‘কোম্পানিগুলোতে ভ্যাকসিন তৈরি করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই।’
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, বৈশ্বিক ভ্যাকসিন বা টিকা শিল্পে বড় নামগুলো যেমন—পিফিজার, মার্ক, গ্লাক্সোস্মিথ ক্লাইন, স্যানোফি ও জনসন অ্যান্ড জনসন। গত বছর বিশ্বব্যাপী টিকা বিক্রি হয়েছিল পাঁচ হাজার ৪০০ কোটি ডলার, যা ২০১৪ সালের দ্বিগুণ। আর এ বৃদ্ধির মূল কারণ হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা, সোয়াইন ফ্লু, হেপাটাইটিস ও ইবোলার মতো রোগগুলো।
‘কেউ ভাবতে পারে যে এবারের (করোনাভাইরাস) চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো অর্থ এই শিল্পের আছে। কিন্তু চারটি সেরা কোম্পানির কেউই এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি,’ বলছিলেন আমস্টার্ডমের ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার গ্রনিনজেনের মেডিসিন ল অ্যান্ড পলিসিবিষয়ক পরিচালক ড. এলেন টি হোয়েন।
বড় কোম্পানিগুলোর বাইরে কিছু ছোট ওষুধ কোম্পানি চেষ্টা করছে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জন্য। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে দেড় হাজারের বেশি মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়োটেক প্রতিষ্ঠান ‘জিলিড’ ঘোষণা করেছে, তারা রেমডিসিভির নামের একটি ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে। অন্যদিকে কালেট্রা চীনে একজন রোগীকে নিয়ে গবেষণা করছে। তবে দুটি পরীক্ষাতেই বিদ্যমান ওষুধই ব্যবহার করা হচ্ছে।
লংকার বলেন, ‘জিলিড বা অ্যাবভাই-এর মতো বড় প্রতিষ্ঠান চিকিৎসার অংশ হিসেবে বিদ্যমান ওষুধ ব্যবহার করবে, কিন্তু এতে করে এসব বড় কোম্পানি স্টক মার্কেটে কতটা সুবিধা পাবে তা অনিশ্চিত।’
করোনাভাইরাসের জন্য টিকা খুঁজতে কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করতে দাতব্য অনুদান ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো অলাভজনক সংস্থা দ্য কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন বা সিইপিআই। এর যৌথ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে আছে নরওয়ে ও ভারত সরকার, বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং দ্য ওয়েলকাম ট্রাস্ট। ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস ও মডার্নার ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট কর্মসূচিতে সহায়তা করছে সিইপিআই। আর বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জিএসকে তাদের হাতে থাকা প্রযুক্তি দিয়ে সিইপিআইকে সহযোগিতার কথা জানিয়েছে।
টিকার ক্ষেত্রে বিক্রির অনুমতি পাওয়ার আগে অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে হাজার মানুষের ওপর পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এর আগে ২০০২ ও ২০০৩ সালে আরেক প্রাণঘাতী সার্স ভাইরাসের মহামারির সময় কোনো টিকাই বাজারে আনা যায়নি। সার্সের জন্য এখনো কোনো টিকা নেই।
এ ছাড়া ইবোলা ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রথম টিকা বাজারে এনেছিল মার্ক। ২০১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় সেটি সফলও হয়েছিল। তবে মার্কের ভ্যাকসিনকে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর পর্যন্ত অনুমোদন দেয়নি। এরপর ২০১৯ সালে কঙ্গোতে ইবোলার আরেকটি ভ্যাকসিন এনেছে জনসন অ্যান্ড জনসন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইবোলা রেসপন্স কর্মসূচির সমন্বয়ক রোনাল্ড ক্লেইন বলেন, ‘আমরা কোম্পানির জন্য কাজ করি না। তবে এটা সত্য যে অনেকে ইবোলার ভ্যাকসিন তৈরি গিয়ে অনেক লোকসানের মুখে পড়েছে।’
তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলেও বাজারজাতকরণের অনুমোদন পেতে অনেক সময় কয়েক বছর লাগে, কারণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে চান যে এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে এমনটা অবশ্য অনুমোদিত ওষুধের ক্ষেত্রেও হতে পারে।
২০০৯-১০ সালে সোয়াইন ফ্লুর প্রাদুর্ভাবের সময় প্রায় ৬০ লাখ মানুষকে গ্লাক্সোস্মিথ ক্লাইনের পানডেমরিক্স ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। পরে কিছু সমস্যার জন্য বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কারণ ভ্যাকসিনটি নেওয়ার পর একজন মানুষ দিনে অনেকবার ঘুমিয়ে পড়ত, অর্থাৎ স্লিপিং ডিজঅর্ডার সমস্যায় আক্রান্ত হতো।
ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের পরিচালক ড. অ্যান্থনি ফৌচি বলছেন, কোনো বড় কোম্পানিই এগিয়ে এসে বলেনি যে তারা কোভিড-নাইনটিন-এর ভ্যাকসিন তৈরি করবে। এটা খুব হতাশাজনক।
তাঁর মতে, করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-নাইনটিন রোগের ভ্যাকসিন আসতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে। ওদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশা করছে, দেড় বছরের মধ্যে এ ভ্যাকসিন বাজারে আসবে। ওষুধ কোম্পানিগুলো এর আগে জনস্বাস্থ্য সংকটের সময়ে ভ্যাকসিন তৈরি করতে এগিয়ে এসেছিল।
ড. অ্যান্থনি ফৌচি বলেন, ‘যখন আমরা ইবোলা নিয়ে কাজ করলাম, তখন একটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন তারা নেই। এখন বড় কোম্পানি পাওয়া অনেক কঠিন হবে।’
বড় কোম্পানিগুলোর মানসিকতার ওপর দৃষ্টি দিয়ে লংকার বলেন, ‘অধিকাংশ কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী দীর্ঘসময় প্রয়োজন, এমন ভ্যাকসিন তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকতে চান না।’