ফ্লোরিডায় ৩১তম ফোবানা সম্মেলন শুরু
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় বসেছিল ৩১তম ফোবানা সম্মেলনের আসর। গত শুক্রবার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফ্লোরিডার উদ্যোগে ফ্লোরিডার মিয়ামির হায়াত রিজেন্সি হোটেলের বলরুমে ফোবানা সম্মেলনের ৩১তম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘মানবতার জন্য ঐক্য’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে ৩১তম ফোবানা সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৩১তম ফোবানা সম্মেলনের সভাপতি মোহাম্মদ এমরান, কনভেনার এম রহমান জহির, সদস্য সচিব আরিফ আহমেদ আশরাফ, প্রধান সমন্বয়ক আতিকুর রহমান, সাংস্কৃতিক কমিটির চেয়ারম্যান এ বি এম মোস্তফাসহ অন্যরা। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত অতিথিদের ৩১তম ফোবানা সম্মেলনের উত্তরীয় পরিয়ে দেন সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়ক আতিকুর রহমান।
শুভ উদ্বোধন শেষে বাংলাদেশ, আমেরিকা ও কানাডার জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে ফ্লোরিডার নতুন প্রজন্মের শিল্পীবৃন্দ এবং উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় শিল্পীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে আসা শিল্পী ফকির আলমগীর, সাবিনা ইয়াসমিনসহ আরো অনেক শিল্পী সংগীত পরিবেশন করেন অনুষ্ঠানে।
৩১তম ফোবানা সম্মেলনের শুরতেই অনুষ্ঠিত হয় ব্ল্যাকটাই ডিনার। ডিনারে অতিথিদের আমন্ত্রণ জানান সম্মেলনের সভাপতি মোহাম্মদ এমরান, কনভেনার এম রহমান জহির ও সদস্য সচিব আরিফ আহমেদ আশরাফ। ডিনারে অংশগ্রহণ করেন ৩১তম ফোবানা সম্মেলনের প্রধান অতিথি পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বিশেষ অতিথি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, মিসেস জিয়াউদ্দিন, বাংলাদেশ থেকে আসা চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, এনআরবি গ্লোবালের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী, শিল্পী ফকির আলমগীর, তাহসান, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর থেকে আমন্ত্রিত অতিথি ও শিল্পীবৃন্দ।
৩১তম ফোবানা সম্মেলন উপলক্ষে একটি বিশেষ ম্যাগাজিন ‘চেতনায় শাণিত বাংলা’ নামে প্রকাশ করা হয়। সম্পূর্ণ রঙিন এই ম্যাগাজিনটির সম্পাদনায় ছিলেন রফিকুল হক, সহসম্পাদক আতিকুর রহমান, এ বি এম গোলাম মোস্তফা, সার্বিক সমন্বয় মোহাম্মদ এমরান, এম রহমান জহির ও রানা হক। ম্যাগাজিনটির প্রচ্ছদ তৈরি করেন লেখক-সাংবাদিক শিব্বীর আহমেদ।
হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহত অবিন্তা কবিরকে স্মরণ
হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত অবিন্তা কবিরকে স্মরণ করল ৩১তম ফোবানা সম্মেলন। সম্মেলন উদ্বোধনের পরপরই মূলমঞ্চে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত অবিন্তা কবিরকে স্মরণে প্রথমে ভিডিও ফুটেজ প্রদর্শন করা হয়। অবিন্তা কবিরের অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে গঠিত ‘অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের’ কার্যক্রম বর্ণনা করা হয়। অনুষ্ঠানে আবেগঘন বক্তব্য রাখেন অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে আবেগঘন কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘অবিন্তা নেই, কিন্তু এই ফাউন্ডেশনের নানান কাজের মধ্য দিয়ে তার উপস্থিতি থাকবে। অবিন্তা বিশ্বাস করত, বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে তার জন্ম। তরুণ বয়সেই অবিন্তা স্বপ্ন দেখেছিল শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে, বিশেষ করে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য, নারীদের জন্য কাজ করতে।’
রুবা আহমেদ বলেন, অবিন্তার স্বপ্ন পূরণে কাজ করবে এই ফাউন্ডেশন। গত এক বছরে এই ফাউন্ডেশন সাতটি বিদ্যালয় স্থাপন করেছে, গাছ লাগানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় সাইবার সেন্টার ও আর্কাইভ করা হয়েছে। তিনি জানান, অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য মেধাবৃত্তির ব্যবস্থা করবে। তিনি আরো বলেন, অবিন্তা তাঁর আত্মার সঙ্গী। অবিন্তাকে নিয়ে তিনি গর্বিত। এ সময় তিনি অবিন্তার সঙ্গে জঙ্গি হামলায় নিহত তাঁর বন্ধু ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও তারিশি জৈনকে স্মরণ করেন।
ফোবানা এক্সিকিউটিভ কমিটির সাধারণ সভার মধ্য দিয়ে গতকাল শনিবার বেলা ১১টায় ফোবানা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়। দিনব্যাপী চলে সভা-সমাবেশ, সেমিনার, সাহিত্য আড্ডাসহ মূলমঞ্চে নাচে-গানে ভরপুর অনুষ্ঠান। রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, ফকির আলমগীর, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, তাহসান, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুসহ আরো অনেকে সাংস্কৃতিক পর্বে অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প শোনালেন পানিসম্পদমন্ত্রী
ফোবানা সম্মেলনে বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প শোনালেন বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। গতকাল শনিবার দুপুরে ৩১তম ফোবানা সম্মেলনস্থল মিয়ামি হায়াত রিজেন্সি হোটেলে সম্মেলন কমিটি আয়োজিত ‘বিলিভ ইন বাংলাদেশ ইনভেস্ট ইন বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ফোবানা বিজনেস পাওয়ার লাঞ্চ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন এবং কিনোট স্পিকার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর। এ ছাড়া উপস্থিত ও বক্তব্য রাখেন কেপিসি গ্রুপের চেয়ারম্যান কালিপ্রদীপ দাস, কনর একিউজিশনের সিইও মাইক পাটেল, এনএইচসিজি গ্রুপের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট উইলিয়াম হ্যামিলটন, জিআরপি ক্যাপিটালের ম্যানেজিং পার্টনার রিক পাটেল, আলফা কনস্ট্রাকশনের সিইও মাইক সারোনা, উৎসব গ্রুপের সিইও রায়হান জামানসহ ফোবানা স্বাগতিক কমিটি ও সেন্ট্রাল কমিটির নেতৃবৃন্দসহ আরো অনেকে।
মধ্যাহ্নভোজে আমেরিকার ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বিশ্ব আজ অবাক বিস্ময়ে বাংলাদেশের সাফল্য দেখছে এবং বাংলাদেশের এই সাফল্য লাভ করবে, কেউ কোনোদিন ভাবতে পারেনি। একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হতো। কিন্তু সেই বাংলাদেশ আজ তার আত্মমর্যাদা নিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের নিরাপদ একটি স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। অভিন্ন স্বার্থ ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিকশিত হয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সর্বোত্তম সম্পর্ক উপভোগ করছে।
তিনি বলেন, দারিদ্র্য নিরসন, পুষ্টি, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অর্জন প্রশংসিত হচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে। গত দুই বছরে এই প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৮০ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৬০০ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ৫ দশমিক ৭ শতাংশে ধরে রেখেছে, রফতানি আয় দ্বিগুণ বেড়ে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দাঁড়িয়েছে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (যা আট মাসের আমদানি ব্যয়ের সমতুল্য), খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে।
আমেরিকান ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে পনিসম্পদমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নিরাপদ ব্যবসার স্থান।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমৃদ্ধি এবং লভ্যাংশের অংশীদার হওয়ার মাধ্যমে কোটি মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টায় শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য পূরণে আমি আমেরিকান ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা নেতৃবৃন্দকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমৃদ্ধি এবং লভ্যাংশের অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমেই আমরা কোটি মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন আনতে পারব।’
বাংলাদেশের উদার বিনিয়োগ নীতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বিদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারের দেওয়া সুবিধাদির প্রসঙ্গে বলেন, আইন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা প্রদান, ট্যাক্স হলিডে, যন্ত্রপাতি আমদানিতে কর রেয়াত, রয়্যালটির রেমিট্যান্স, শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগ, অনিয়ন্ত্রিত প্রত্যাহার নীতি, লভ্যাংশ ও পুঁজি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুবিধাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ওষুধ শিল্প দেশের শতকরা ৯৭ ভাগ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ৯২টি দেশে রফতানি হচ্ছে।
তিনি বলেন, গার্টেনারের মতে, সফটওয়্যার ও আইটি সার্ভিসের জন্য বিশ্বের ৩০টি শীর্ষস্থানীয় দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের তৈরি হাজারো সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন এখন আইফোন, স্যামসাং গ্যালাক্সি এবং ব্ল্যাকবেরি ফোনে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত বছর আমাদের আইটি কোম্পানিগুলো এবং ফ্রিল্যান্স আইটি পেশাজীবীরা ৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছেন। প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার আইটি গ্র্যাজুয়েট এই খাতে যোগ দিচ্ছেন।
পানিসম্পদমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের নির্মাতারা বিশ্বমানের হালকা ও মাঝারি সামুদ্রিক জাহাজ নির্মাণ করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই শিল্পের ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক বাজারের ১ শতাংশ শেয়ার এখন বাংলাদেশের দখলে। ব্যবসায়ীদের জন্য বাংলাদেশ ‘সেকেন্ড হোম’ হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভিশন ২০৩০-এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মধ্যাহ্নভোজে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনসহ অন্যদের মাঝে অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেন প্রধান অতিথি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এ ছাড়া মধ্যাহ্নভোজে ফোবানা বিজনেস পাওয়ার লাঞ্চ নামে একটি ম্যাগাজিন এবং ফোবানার বার্ষিক রিপোর্ট ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশ করা হয়।